৯/১১-এর ২২ বছর

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-09-12 12:16:30

২২ বছর আগে আমেরিকায় চারটি যাত্রীবাহী জেট বিমান ছিনতাই করে সেগুলো দিয়ে আঘাত হানা হয় নিউইয়র্কের দুটি আকাশচুম্বী ভবনে, যে ঘটনায় নিহত হয় কয়েক হাজার মানুষ। হামলাটি ছিল শতাব্দীর অন্যতম প্রধান ও সবচেয়ে ভয়াবহ একটি হামলা। শুধু আমেরিকানদের জন্যই নয়, গোটা বিশ্ব চমকে গিয়েছিল ঘটনার ভয়াবহতায়। দিনটি ছিল ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার। সংক্ষেপে যাকে উল্লেখ করা হয় ৯/১১ নামে।

২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর দিনটি ছিল অন্যান্য দিনের মতোই। কিন্তু সে দিনটিই যে বিশ্বের ইতিহাসে ভয়াবহ একটি দিনে পরিণত হবে, তা কে জানতো!

দিনটির কথা ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে আছে এখনও। সকাল থেকে ঢাকার আমেরিকান সেন্টারে ফোন করেই চলেছি এবং আশ্চর্যজনকভাবে কেউ তা রিসিভ করছে না। আমেরিকান সেন্টারের উদ্যোগে নেপালে অনুষ্ঠিতব্য আন্তর্জাতিক সেমিনারে প্রবন্ধ পাঠ করতে যেতে হবে আমাকে। নেপালের হিলস্টেশন নাগরকোটের 'ক্লাব হিমালয়া'য় থাকা, খাওয়াসহ যাবতীয় আয়োজন করা হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, কায়সার হক, ফখরুল আলমসহ আরও অনেকেই আমন্ত্রিত হয়েছি। আমেরিকান সেন্টারে আমার পাসপোর্ট দেওয়া আছে নেপালের ভিসা ও আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংকের কাগজপত্র তৈরির জন্য।

ফোনে কাউকে ধরতে না পেরে বিস্মিত হলাম আর তখনই ৯/১১-এর মর্মন্তুদ ঘটনার খরবটি জানতে পারি প্রধানত তখনকার সময়ে স্যাটেলাইট টিভির একচ্ছত্র অধিপতি সিএনএন-এর বরাতে। খবরে আরও জানানো হয়েছে যে, পুরো আমেরিকা স্তব্ধ ও বিমূঢ়। বিশ্বের সর্বত্র আমেরিকান স্থাপনা বন্ধ। মার্কিনিদের তরফে জারি করা হয়েছে সর্বোচ্চ সতর্কতা।

ধীরে ধীরে ৯/১১- এর পুরো ঘটনা সামনে চলে আসে। জানা যায়, দুটি বিমান বিধ্বস্ত করা হয়েছে নিউইয়র্কে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টুইন টাওয়ার ভবনে। যার ছবি ৯/১১-এর আইকনিক ইমেজ রূপে ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে।

সংবাদ মাধ্যম আরও জানায়, প্রথম বিমানটি আঘাত হানে নর্থ টাওয়ারে আমেরিকার পূর্বাঞ্চলীয় সময় সকাল ৮টা ৪৬ মিনিটে। দ্বিতীয় বিমানটি সাউথ টাওয়ারে বিধ্বস্ত করা হয় এর অল্পক্ষণ পর, সকাল ৯টা ৩ মিনিটে। সঙ্গে সঙ্গে ভবন দুটিতে ভয়ঙ্করী আগুন ধরে যায়। ভবন দুটির উপরতলায় মানুষজন আটকা পড়ে। শহরের আকাশে ছড়িয়ে পড়ে ধোঁয়ার কুণ্ডলী। দুটি টাওয়ার ভবনই ছিল ১১০ তলা। মাত্র দুই ঘন্টার মধ্যে দুটি ভবনই বিশাল ধুলার ঝড় তুলে মাটিতে ভেঙে গুঁড়িয়ে পড়ে।

তৃতীয় বিমানটি পেন্টাগনের সদর দপ্তরের পশ্চিম অংশে আঘাত হানে স্থানীয় সময় সকাল ৯টা ৩৭ মিনিটে। রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির উপকণ্ঠে ছিল আমেরিকান প্রতিরক্ষা বিভাগের বিশাল এই সদর দপ্তর পেন্টাগন ভবন।

এরপর, সকাল ১০টা ৩ মিনিটে চতুর্থ বিমানটি আছড়ে পড়ে পেনসিলভেনিয়ার এক মাঠে। ছিনতাই হওয়া চতুর্থ বিমানের যাত্রীরা ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর পর সেটি পেনসিলভেনিয়ায় বিধ্বস্ত হয়।
ধা করা হয় ছিনতাইকারীরা চতুর্থ বিমানটি দিয়ে ওয়াশিংটন ডিসিতে ক্যাপিটল ভবনের ওপর আঘাত হানতে চেয়েছিল।

হামলায় সব মিলিয়ে মারা গিয়েছিল ২,৯৭৭ জন। এই হিসাবের মধ্যে ১৯ জন ছিনতাইকারী অন্তর্ভুক্ত নেই। নিহতদের বেশিরভাগই ছিল নিউইয়র্কের লোক। চারটি বিমানের ২৪৬ জন যাত্রী এবং ক্রুর প্রত্যেকে মারা যান। টুইন টাওয়ারের দুটি ভবনে মারা যান ২,৬০৬ জন - তাৎক্ষণিক ও পরে আঘাত থেকে পেন্টাগনের হামলায় প্রাণ হারান ১২৫ জন। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, সর্বকনিষ্ঠ নিহতের বয়স ছিল দু'বছর। নাম ক্রিস্টিন লি হ্যানসন। তার বাবা মায়ের সাথে সে একটি বিমানের যাত্রী ছিল। নিহত সর্বজ্যেষ্ঠ ব্যক্তির নাম রবার্ট নর্টন। তার বয়স ছিল ৮২। তিনি ছিলেন অন্য আরেকটি বিমানে এবং তার স্ত্রী জ্যাকুলিনের সাথে তিনি একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন।

প্রথম বিমানটি যখন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে আঘাত করে, তখন ভেতরে আনুমানিক ১৭ হাজার ৪০০ জন লোক ছিল। নর্থ টাওয়ারের যে অংশে বিমান আঘাত করে, তার উপরের কোন তলার মানুষই প্রাণে বাঁচেনি। তবে সাউথ টাওয়ারে যেখানে বিমান আঘাত করে, তার উপরের অংশ থেকে ১৮ জন প্রাণ নিয়ে বেরুতে পেরেছিল। হতাহতের মধ্যে ৭৭টি ভিন্ন ভিন্ন দেশের মানুষ ছিলেন। নিউইয়র্ক শহরে যারা প্রথম ঘটনাস্থলে জরুরি অবস্থা মোকাবেলায় দৌড়ে যান, তাদের মধ্যে মারা যান ৪৪১ জন।

হাজার হাজার মানুষ আহত হন, যারা পরে নানাধরনের অসুস্থতার শিকার হন। যেমন দমকলকর্মীদের অনেকে বিষাক্ত বর্জ্যের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের এক মঙ্গলবারের সকালে আমেরিকার চার জায়গায় আছড়ে পড়েছিল আল-কায়দার জঙ্গিরা। তার মধ্যে একটি হামলায় গুঁড়িয়ে যায় লোয়ার ম্যানহাটনের ‘ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে’র জোড়া টাওয়ার। জঙ্গিদের ছিনতাই করা দু’টি বিমান সরাসরি ধাক্কা মেরে গু়ঁড়িয়ে দেয় আমেরিকা তথা বিশ্বের অতি পরিচিত ভবনটিকে। আমেরিকার ইতিহাসে যে দিনটি কালো দিন হিসাবে মনে করা হয়।

জঙ্গিহানায় নিউ ইয়র্কের জোড়া টাওয়ার ধ্বংসের পর কেটে গিয়েছে প্রায় ২২ বছর। তবে আজও সেই হত্যালীলার বিভীষিকাময় স্মৃতি পিছু ছাড়েনি আমেরিকার। জঙ্গিহানার পর উদ্ধারকারীদের মধ্যে মৃতদের তালিকায় ক্রমশ নাম জুড়ছে। গত বুধবার সে তালিকায় আরও ৪৩ জনের নাম শামিল করেছে শহরের দমকল দফতর।

নিউ ইয়র্ক ফায়ার ডিপার্টমেন্ট জানিয়েছে, মৃতদের মধ্যে রয়েছেন দমকলকর্মী, প্যারামেডিকস থেকে শুরু করে সাধারণ শহরবাসী, যাঁরা হামলার পর উদ্ধারকাজে নেমে পড়েছিলেন। সেই প্রচেষ্টা করতে গিয়ে নানা শারীরিক সমস্যা দেখা দিয়েছে তাঁদের। যার জেরে আমরণ ভুগছেন তাঁরা। তার জেরেই প্রাণ হারিয়েছেন আরও ৪৩ জন। সব মিলিয়ে শহরের ৩৩১ জন দমকলকর্মীর মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন নিউ ইয়র্ক ফায়ার কমিশনার লরা কাভানা। হামলার জায়গায় স্মৃতিসৌধে যাঁদের নামের সঙ্গে ছবি খোদিত করা হয়েছে।

সংবাদমাধ্যমের কাছে লরা বলেন, ‘‘৯/১১-র বর্ষপূর্তির দিকে যত অগ্রসর হচ্ছি, ততই সে দিনের অভিঘাতের কথা উপলব্ধি করছে নিউ ইয়র্ক শহরের দমকল দফতর। প্রতি বছর এই স্মৃতিসৌধের দেওয়ালটি আরও দীর্ঘ হচ্ছে। কারণ আমরা এমন অনেককে সম্মানিত করছি, যাঁরা অন্যদের জন্য জীবনদান করেছেন। তাঁদের কখনও ভুলব না আমরা।’’

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

এ সম্পর্কিত আরও খবর