কেন আফ্রিকার রাজনীতিতে আবার ফিরে এলো সামরিক হস্তক্ষেপ?

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-09-01 23:46:58

ষাট, সত্তর, আশি দশকের সেই ধারার যেন পুনরাবৃত্তি হচ্ছে আবার। এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার রাজনীতিকে আচ্ছন্ন করেছিল যে সামরিক হস্তক্ষেপ, রাজনীতিতে পুনরায় বাড়ছে সেই সামরিক হস্তক্ষেপ। বিশেষত আফ্রিকার ঘটনাক্রমে তেমন চিত্রই দেখা যাচ্ছে। কেন আফ্রিকার একাধিক দেশেূ আবার ফিরে এলো সামরিক শাসন, তা রাজনৈতিক পণ্ডিতদের সামনে এখন বিরাট বড় এক জিজ্ঞাসা।

আফ্রিকান রাষ্ট্র নাইজারের পর এবার সেনা অভ্যুত্থান হয়েছে গ্যাবনে। জাতীয় টেলিভিশনে ক্ষমতা দখলের কথা ঘোষণা করেছে সে দেশের সেনাবাহিনী। এই ঘটনার জেরে মধ্য আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত গ্যাবনে গৃহযুদ্ধ কিংবা রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে আন্তর্জাতিক মিডিয়া।

বিভিন্ন সূত্রের খবরে জানা যায়, চলতি আগস্ট মাসেই গ্যাবনের নির্বাচন কমিশন বর্তমান শাসক আলি বঙ্গো অনডিম্বাকে ফের প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত ঘোষণা করে। এরপরই সেনা বিদ্রোহের খবর পাওয়া গিয়েছে। জাতীয় টেলিভিশন চ্যানেল ‘গ্যাবন ২৪’-এ বিদ্রোহী সেনাকর্তারা দাবি করেছেন, দেশের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করছেন তাঁরা। বিগত সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করা হল বলেও ঘোষণা করেন তাঁরা। পরবর্তী নোটিস না দেওয়া পর্যন্ত দেশের সব সীমান্ত বন্ধ থাকবে বলেও জানায় অভ্যুত্থানকারীগণ।

গ্যাবনের রাজধানী লিব্রেভিলে তীব্র গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে বলে জানিয়াছে কয়েকটি মিডিয়া। বিদ্রোহী সেনাকর্তারা বলছেন, “গ্যাবনের জনগণের নামে বর্তমান শাসনের অবসান ঘটিয়ে শান্তি রক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।” কারণ, প্রেসিডেন্ট, পার্লামেন্টে ও আইন পরিষদগুলোর নির্বাচন হওয়ার পর থেকেই দেশটিতে তীব্র উত্তেজনা চলছিল। বঙ্গোর পরিবার ৫৬ বছর ধরে দেশটির ক্ষমতা দখল করে রয়েছে, যা নিয়ে চলছে বিক্ষোভ। বঙ্গো ক্ষমতায় থাকতে চাইলেও দেশটির বিরোধীদলগুলো এবং জনতার বড় একটি অংশ পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন করছিল।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, খনিজ তেল এবং কোকোর মতো কৃষিপণ্যে সমৃদ্ধ হলেও গ্যাবন দারিদ্র্যপীড়িত। জনগণের এহেন দুর্দশার নেপথ্যে রাজনেতাদের দুর্নীতিই মূলত দায়ী বলে মনে করা হয়। এবারের নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। কোনও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকও এই নির্বাচনে হাজির ছিলেন না।

গত জুলাই মাসে সেনা অভ্যুত্থান হয় আফ্রিকার আরেক দেশ নাইজারে। ইউরেনিয়াম, কয়লা, সোনার মতো প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে দেশটিতে। দীর্ঘদিন উপনিবেশ থাকার পর ১৯৬০ সালে ফ্রান্সের হাত থেকে স্বাধীনতা পায় নাইজার। তবে আজও দেশটিতে ফরাসি প্রভাব রয়েছে। অভিযোগ, আজও দেশটির সম্পদ লুট করছে প্যারিস। এই প্রেক্ষাপটে, নাইজারে সেনা অভ্যুত্থান ঘটে। রাজধানী নিয়ামেতে নিজের প্রাূূূূ।সাদে রক্ষীদের হাতেই আটক হন প্রেসিডেন্ট মহম্মদ বাজুম।

এসব ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আমেরিকা। তীব্র নিন্দা করেছে আফ্রিকান ইউনিয়ন। ধারণা করা হচ্ছে, এসব অভ্যুত্থানের নেপথ্যে রাশিয়ার ওয়াগনার গ্রুপের হাত রয়েছে। তাছাড়া দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিভেদও সামরিক হস্তক্ষেপের পথ তৈরি করে দিয়েছে বলেও মনে করা হচ্ছে।

উদাহরণ স্বরূপ, একটি পরিবারের কাছে কমপক্ষে ৫৬ বছর জিম্মি থাকার পর আফ্রিকার দেশ গ্যাবনে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছে। এই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছেন গ্যাবোনিজ রিপাবলিকান গার্ডের কমান্ডার ইন চিফ ব্রাইস ক্লোথায়ার ওলিগুই নগুয়েমা। তার সঙ্গে আছে প্রেসিডেন্ট বোঙ্গোর একজন কাজিন। দেশটার অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান হিসেবে নিজের নাম ঘোষণা করেছেন ব্রাইস ক্লোথায়ার ওলিগুই নগুয়েমা।

নগুয়েমা বর্তমানে দেশে সবচেয়ে প্রভাবশালী ও রহস্যময় ব্যক্তিদের অন্যতম। তিনি একজন সেনা কর্মকর্তার ছেলে। মরক্কোর রয়েল মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট বোঙ্গোর আগে তার পিতা ওমর বোঙ্গোর রিপাবলিকান গার্ডের কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। ফলে ক্ষমতার রাজনীতির সঙ্গে আগে থেকেই জানাশোনা রয়েছে নগুয়েমার।

প্রশ্ন হলো, রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপের বিষয়টি বলতে গেলে মুছে গিয়েছিল। গণতান্ত্রিক সুশাসনের জোয়ারের সামনে প্রত্যক্ষ সামরিক হস্তক্ষেপের বিষয়টি হারিয়ে গিয়েছিল। সেটাই আবার ফিরে এলো কেন?

শুধু ফিরেই আসেনি, এক মাসের ব্যবধানে আফ্রিকার দুটি দেশে পর্যায়ক্রমে সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনা বিশেষ তাৎপর্যবাহী, যাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছেন বিশ্লেষকগণ। তাদের মতে, রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও শাসনের দুর্বলতার মধ্যেই নিহিত রয়েছে এসবের কারণ।


ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

এ সম্পর্কিত আরও খবর