আরবরা আজ একই সাথে ভাই ও শত্রু

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-09-01 18:52:18

আরব বিশ্ব জুড়ে কয়েক দশক আগেও এমন সময় ছিল, যখন লোকেদের তাদের ধর্ম বা সম্প্রদায় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা অভদ্রতা মনে করতো। বরং তাদের নাম, তাদের উচ্চারণ, তারা যেখানে বাস করত বা যেরূপ উপাসনা করত বা তাদের দেয়ালে টাঙ্গানো ছবি থেকে বোঝা যেতো তাদের পরিচয়। সবাই ছিল আরব। সুন্নি, শিয়া বা খ্রিস্টান পরিচিতি ছিল অন্তরালেে।

সেই বৃহত্তর আরবভূমি বা মধ্যপ্রাচ্য এখন জাতি ও ধর্মগত পার্থক্যে বিদীর্ণ এবং সংঘাত-জর্জরিত। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চল, গোষ্ঠী, মতাদর্শ ও ধর্মের মানুষগুলোর মধ্যে চলছে অমীমাংসিত লড়াই। অকাতরে ঝরছে প্রাণ। রক্ত ও অস্ত্রের তাণ্ডবে বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে অসংখ্য লোকালয়। থেমে থেমে চলছেই ছোট ও বড় আকারে একাধিক সশস্ত্র সংঘর্ষ।

অথচ উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগের গৌরবময় দিনগুলিতে একটি অত্যধিক-শক্ত আরব জাতীয় পরিচয় তৈরির দিকে মনোযোগ দেওয়া হয়েছিল জাতীয়তাবাদী নেতাদের তরফে। যেমন সিরিয়া। সেখানে সুন্নি, আলাভি শিয়া, কুর্দি, দ্রুজ এবং অনেক খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মোজাইকের মাধ্যমে নির্মাণ হয়েছিল, 'আরবিবাদের স্পন্দিত হৃদয়'।

পাশের লেবাননও ছিল জনবৈচিত্র্যে 'গর্বিত আরব'। লেবাননের নানা বিশ্বাসের মানুষের মধ্যে বিস্তৃত ক্ষমতা ভাগাভাগি ব্যবস্থা ছিল। আর সাধারণ মানুষের স্বীকারোক্তিমূলক পরিচয় একটি ব্যক্তিগত বিষয় ছিল। সেখানে আন্তঃবিবাহ ও আন্তঃসম্প্রদায়ের মেলামেশা গভীরভাবে প্রচলিত ছিল।

বাথ পার্টি, যা ইরাকের বাগদাদ এবং সিরিয়ার দামেস্ক, উভয় রাজধানীতে শাসন করেছিল আর তা ছিল একজন খ্রিস্টান মতাদর্শী মিশেল আফলকের সৃষ্টি। দুই উগ্রপন্থী ফিলিস্তিনি নেতা জর্জ হাবাশ এবং নায়েফ হাওয়াতমেহ ছিলেন খ্রিস্টান। আরব জাতীয়তাবাদের বস্তুবাদী ইতিহাসবিদ জর্জ অ্যান্টোনিয়াসও তাই ছিলেন।

ইরাকের অন্তর্গত তিনটি সাবেক অটোমান প্রদেশের দখল নিয়ে ব্রিটিশরা তীব্র শোষণ করেছিল। ঔপনিবেশিক শাসকরা তিনটি প্রদেশে একটি দরিদ্র আরব-ইরাকি গ্রামীণ জনতাকে নিষ্পেষিত করেছিল, যারা ছিল একটি শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ, একটি সুন্নি সংখ্যালঘু এবং একটি কুর্দি প্রধান গোষ্ঠীর অংশ। সাদ্দাম হোসেন, একজন সুন্নি, তাদেরকেই সমন্বিত করার চেষ্টা করেছিলেন, যারা সবাই ছিলেন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি দ্বারা চরমভাবে নির্যাতিত।

আরব দুনিয়ায় একটি বিরাট পরিবর্তন ঘটে ১৯৭৯ সালে, যা ইরানের ইসলামী বিপ্লব দ্বারা চালিত হয়েছিল। ইরানের বিপ্লব বিশ্বমুসলিম জাগরণের সঙ্গে সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে একটি বিপর্যয়কর মুহূর্তে নিপীড়িত শিয়াদের জন্য একটি অনুপ্রেরণামূলকভাবে উজ্জীবিত হওয়ার মতো ঘটনা ছিল, যার তাৎক্ষণিক প্রভাব দেখা যায় ১৯৮০ সালে। সেবছর ইরানের বিরুদ্ধে ইরাকের সাদ্দামের আগ্রাসনকে পারস্যদের বিরুদ্ধে আরব যুদ্ধ হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল এবং শিয়া ও সুন্নি মেরুকরণের পক্ষে উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলিকে প্রভাবিত করেছিল। বহু বছরেও যা বিভাজন মুছে যায়নি। ২০০৩ সালে সাদ্দামের উৎখাতকে ইরাকি শিয়ারা ৬৮০ সালে কারবালার যুদ্ধে সুন্নি উমাইয়াদের হাতে তাদের শ্রদ্ধেয় ইমাম হুসেনের শাহাদাতের স্মৃতি জাগরণের আহ্বান জানিয়ে উদযাপন করেছিল।

বলার অপেক্ষা রাখেনা, সাম্প্রদায়িকতা প্রকৃত ধর্মীয় পার্থক্যগুলিকে প্রতিফলিত করে এবং "অন্যতা" সংজ্ঞায়িত করে, তবে এটি সর্বদা শক্তি, সম্পদ এবং অঞ্চলের সাথে যুক্ত হয়েছে। বাহরাইনে, শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠের উপর সুন্নি আল খলিফা রাজবংশ শাসন ব্যবস্থায় তার সঠিক স্থান অস্বীকার করেছে, কিন্তু রাজধানী মানামা অশান্তি ছড়ানোর জন্য তেহরানকে দায়ী করেছে। সৌদি আরব একইভাবে শিয়া অধ্যুষিত পূর্বাঞ্চলে সমস্যা সৃষ্টির জন্য ইরানকে অভিযুক্ত করে। উভয় ক্ষেত্রেই অভিযোগ প্রকৃত স্থানীয় সমস্যাকে আড়াল করার মুখোশ মাত্র।

বিগত বছরগলিতে সিরিয়ার ভয়ানক যুদ্ধ সাম্প্রদায়িক মনোভাবকে প্রসারিত করেছে। শিয়া আলাভি গোষ্ঠী এখন বাশার আল-আসাদের সাথে থেকে সুন্নিদের বিরোধিতায় লিপ্ত। লেবাননের হিজবুল্লাহ ইরান সমর্থিত একটি শিয়া গোষ্ঠী এবং আসাদকে সমর্থন করে। এসব বিরোধ অবশ্যই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্যমান অন্যান্য ধর্মীয় পরিচয়কে প্রাধান্য দিচ্ছে।

সৌদি আরব বা কুয়েতে অবস্থিত চরমপন্থি সুন্নি প্রচারকরা শিয়াদেরকে "মূর্তি-পূজক" হিসাবে গালি দেয় আর শিয়ারা তাদেরকে ওয়াহাবি বলে সমালোচনা করে। একইভাবে একচেটিয়াতা ও অসহিষ্ণু ভাষায় ইরানিদেরকে "সাফাভিস" বলে তিরস্কার করা হয়, যা ষোড়শ শতকের সাফাভিদ রাজবংশের নিন্দনীয় ইতিহাসের সমার্থক। আরব বিশ্বের অনেক ধর্মান্ধ গোষ্ঠী প্রতিপক্ষকে 'মুরতাদ' ফতোয়া দিয়ে তাদেরকে হত্যার ন্যায্যতা দেয়।

তথাপি একমাত্র সাম্প্রদায়িকতাই মধ্যপ্রাচ্যে বিভক্তির মূল কারণ নয়। ইয়েমেনের ক্রমবর্ধমান সঙ্কটের সাথে জায়েদি সম্প্রদায়ের বিদ্রোহী হুথিরা জড়িত, যারা শিয়া ইসলামের সাথে যুক্ত কিন্তু দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নি মতবাদের কাছাকাছি। ইরানের কাছ থেকে তারা যে সমর্থন পায় তা মূলত মিত্রদের জয়ী হওয়া এবং শক্তি প্রজেক্ট করার বিষয়ে – প্রধান কারণ সৌদি আরবের সশস্ত্র হস্তক্ষেপের মুখোমুখি হুথিরা।

মধ্যপ্রাচ্যের মার্কিন শিক্ষাবিদ এবং ভাষ্যকার জুয়ান কোল বলেছেন যে, ইরান ধর্মীয় কারণে হুথিদের সমর্থন করে এমন কথা বলাটা 'অনুমান করার মতো যে স্কটিশ প্রেসবিটেরিয়ানরা সর্বদা দক্ষিণী ব্যাপ্টিস্টদের সমর্থন করবে কারণ উভয়ই প্রোটেস্ট্যান্টবাদের রূপ'। ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটই এই সংঘাতকে তার সাম্প্রদায়িক বর্ণ দেয়, অন্যভাবে নয়।

অন্যদিকে, আরবিভাষী মিশরের মুসলমানরা একচেটিয়াভাবে সুন্নি এবং নরমপন্থী হলেও ২০১১ সালের বিপ্লবের দমনমূলক ফলাফলে কপ্টিক খ্রিস্টান সংখ্যালঘুরা পুরানো শাসনের সমর্থক হিসাবে চিহ্নিত হয়ে চরমপন্থীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে।

মাগরেবে, যেখানে তিউনিসিয়ার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আরব বসন্তের সূচনা হয়েছিল, সেখানে সাম্প্রদায়িকতা কোনও সমস্যা নয়, যদিও সিরিয়ার যুদ্ধ এবং আইসিসের বৃদ্ধি থেকে চরমপন্থা বিষাক্তভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। লিবিয়া, মরক্কো এবং আলজেরিয়ায়, বারবার অধিকার এবং পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু একটি সংকটের কেন্দ্রবিন্দু নয়।

এটা মনে রাখা দরকার যে আরব জাগরণ সর্বত্র ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কারের আহ্বানের সাথে শুরু হয়েছিল। লেবাননের কাগজ আল-সাফিরে তালাল সালমান লেখেন, যে গোত্র, গোষ্ঠী, ধর্ম, সম্প্রদায় বা জাতিগত গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত, নাগরিকরা অন্য কিছুর আগে 'মর্যাদা' চেয়েছিল। এটি সময়ের সাথে সাথে সাম্প্রদায়িক প্রবণতাগুলি সামনে এনেছিল। যেহেতু ট্রানজিশনগুলি পশ্চাদপসরণ করছে বলে মনে হচ্ছে, ফলে লোকেরা ক্রমবর্ধমানভাবে রাজনৈতিক নয় বরং উপজাতীয় বা স্বীকারোক্তিমূলক লাইনে নিজেদেরকে চিহ্নিত করাকেই বেছে নিয়েছে।

আরবরা আজ একই সাথে ভাই ও শত্রু। প্রতিটি উপগোষ্ঠী একটি নিরর্থক যুদ্ধে অন্য উপগোষ্ঠীর মোকাবিলা করার জন্য তাদের ধর্মীয় বা জাতিগত পরিচয় প্রকাশ করেছে। অথচ এরূপ লড়াইয়ে কেউ জিতবে না, সবাই হারবে। মধ্যপ্রাচ্যের একীভূত পরিচয় হিসাবে আরব জাতীয়তাবাদের পতন ভাইদের মধ্যে গৃহযুদ্ধের একটি সিরিজের সূচনা করেছে। সেই যুদ্ধগুলিতে তাদের ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়, অঞ্চল এসে উগ্রভাবে মিশেছে। কিন্তু কখন বা কীভাবে এ লড়াই শেষ হবে তা কেউ জানে না।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

এ সম্পর্কিত আরও খবর