ঢাকা দূষণমুক্ত ও বাসযোগ্য হতে পারছেনা কেন?

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-08-31 21:33:45

ছিল প্রাচ্যের রহস্য নগরী। কেউ বলতেন, রমনীয় রমনার শহর। শহরের আইকন মসলিন ছিল জগদ্বিদিত। বুড়িগঙ্গা তীরের অফুরন্ত বাতাস, উদার প্রকৃতি, সস্তা ও সুলভ খাবাব টেনে এনেছিল পুরো বিশ্বের দৃষ্টি। জান্নাতের সঙ্গে তুলনীয় সুবাহ বাঙালার রাজধানী ঢাকা ছিল প্রাসাদ, হর্ম্য, উদ্যানে মোড়ানো মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও আকর্ষণীয় শহর।

আর আধুনিক ঢাকা হলো বায়ু দূষণে পর্যুদস্ত এক নূব্জ্য শহর। নাগরিক ভোগান্তির নামান্তর। বৃহস্পতিবার (২২ জুন) জানা গেলো ঢাকায় বর্তমানে ২ কোটি ১০ লাখ মানুষ বসবাস করে। এদিনই ইকোনমিস্ট ইন্টিলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) নামের এক আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রকাশ করেছে ২০২৩ সালের বাসযোগ্য শহরের তালিকা। যে তালিকার একেবারে শেষের দিকে কয়েকটি যুদ্ধ-বিধ্বস্ত শহরের পাশে কোনক্রমে স্থান পেয়েছে একদার সুরম্য ও তিলোত্তমা নগরী ঢাকা।

দুর্ভাগ্য ঢাকার। তালিকার শেষের দিকে এককভাবে নিজের অবস্থান জাহির করতে পারেনি। তালিকায় লেজে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ সিরিয়া ও ইউক্রেনের শহরের সঙ্গে স্থান পেয়েছে ঢাকা। শেষ দিক থেকে যথাক্রমে ক্যামেরুনের দৌয়ালা, ইউক্রেনের কিয়েভ, যৌথভাবে জিম্বাবোয়ের হারারে ও বাংলাদেশের ঢাকা, পাপুয়া নিউ গিনির পোর্ট মোর্সবি, পাকিস্তানের করাচি, নাইজেরিয়ার লাগোস, আলজেরিয়ার আলজিয়ার্স, লিবিয়ার ত্রিপোলি ও সিরিয়ার দামেস্ক শহর রয়েছে।

যুদ্ধ বা সংঘাত নয়, ঢাকার অধঃপতনের কারণ ভিন্ন। 'বিষন্নতার মেঘে ছেয়ে গেছে ঢাকা শহর'। বায়ুদূষণে থেমে থেমে মেগাসিটি ঢাকা শীর্ষস্থান লাভ করেছে সারা পৃথিবীর মধ্যে আর বাসযোগ্য শহরের তালিকার তলানিতে নেমে গেছে। যে ঢাকার আকাশ আচ্ছন্ন হয়ে আছে বিষবাষ্প, ধূলার আস্তরণ ও ধূয়ার কুণ্ডলীতে, তা আর বাসযোগ্যতায় থাকবে কেমন করে? বরং গবেষকরা বলছেন, বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি বিষণ্ণতায় ভুগছেন ঢাকাবাসী। বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি হারে বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হচ্ছেন ৬৫ বছর কিংবা তার চেয়ে বেশি বয়সী সিনিয়র সিটিজেন শ্রেণি। আর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সাম্প্রতিককালে বায়ুদূষণ ছিল বাংলাদেশে মৃত্যু ও অক্ষমতার দ্বিতীয় বড় কারণ। বছরে প্রায় ৮৮ হাজার মানুষের মৃত্যুর জন্য বায়ুদূষণকে দায়ী করা হয়।

বিশ্ববিশ্রুত পর্যটক, লেখক, শিল্পীর লেখা ও রেখায় বুড়িগঙ্গা তীরের হর্ম্য, প্রাসাদ, বাগিচা ও নান্দনিকতার যে ঢাকা শহরের বিবরণ পুলকিত করে আমাদের, সেই ঢাকা বহু আগেই স্মৃতির অতল গর্ভে হারিয়েছে। ঢাকার বুকের মাঝখানে হৃৎপিণ্ডের মতো যে সবুজ-শ্যামলিম রমনা ছিল, বৃক্ষতলের ধানমণ্ডি, পুরানা পল্টন, গেন্ডারিয়া ছিল সেসব খুলবে খেয়েছে লোলুপ মানুষেরা। ঢাকার ল্যান্ডস্কেপে নিসর্গ ও সবুজ বলতে কিছুই যেন অবশিষ্ট নেই। শতবর্ষী বহু প্রাচীন বৃক্ষ কর্তিত হয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়নের থাবায়। ফলস্বরূপ, ঢাকার স্কাইলাইনে খাঁখাঁ ধূসরতা আর দূষিত বায়ুর আচ্ছাদন, যা একদার সুরম্য নগরীকে পরিণত করেছে বিশ্বের এক নম্বর দূষিত, অস্বাস্থ্যকর এবং বাসের অযোগ্য নগরে।

সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান 'আইকিউ এয়ার' একটি তালিকা প্রকাশ করে ফি বছর। প্রতিদিনের বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা একিউআই সূচক একটি নির্দিষ্ট শহরের বাতাস কতোটুকু নির্মল বা দূষিত, সে সম্পর্কে মানুষকে তথ্য দেয় এবং তাদের জন্য কোনও ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে, তা জানায়। আর এই সংস্থার তথ্যেও ঢাকার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক এবং অবস্থান নিম্নগামী।

পরিবেশ বিপর্যয় কবলিত ঢাকা থেকে মুছে গেছে প্রকৃতির রঙবাহার। বর্ষা এখানে চরম দুর্ভোগ ডেকে আনে। রঙিলা বসন্তেও প্রকৃতি হয়ে যায় ধূসর ও পিঙ্গল। সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদে, ঢাকার জনবহুল এলাকাগুলো গাছ, পাতা ও ফুল প্রাণহীন। সামান্য যা আছে, তার সবুজে ও বর্ণিল শরীরে ধূলা ও ময়লার কালো কালো ছোপ। দূষণের থাবায় রাতেও আচ্ছন্ন ঢাকার আলোর বর্ণালি। মনে হয়, রাস্তার ল্যাম্পপোস্টে জ্বলেনি পুরোটা আলো।

ভুল নগরায়ন ও ভ্রষ্ট পরিকল্পনায় ঢাকার বিকাশ চলছে বিপদজনকভাবে উল্টা পথে। পুরনো ঢাকার বাড়ি ও গলিগুলো আতঙ্কের নামান্তর। গ্যাস লাইন ফাটছে। পানি সরবরাহ কলুষিত। ভবনগুলো নড়বড়ে। পুরো পরিস্থিতিই দুর্ঘটনা-বান্ধব।

নতুন ঢাকায় চলছে শক্তির মচ্ছব। প্ল্যান এড়িয়ে উঠছে বহুতল। দখল হচ্ছে ফুটপাত ও ওপেন স্পেস। শুষে নেওয়া হচ্ছে ভূগর্ভস্থ জলস্তর। জল, বৃক্ষ, উদ্যানগুলোকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে প্রান্তিকতার উপান্তে।

যে ঐতিহ্যবাহী শহর একদা পরিচিত ছিল 'প্রাচ্যের রোমান্টিক নগরী' নামে, সেখানকার আকাশে কমে আসছে আলো, বাতাসে কমছে অক্সিজেন। মনে হয়, এই শহরে নেই কোনো গান ও পাখির কলকাকলি। নীরবতা নেই। অহর্নিশি বেজে চলে হর্ণ। দিগন্তে পাখিদের উড়াউড়ি নেই, নেই সুমধুর সুর। এমন আবছা আলো ও অন্ধকারে হারিয়ে যেতে থাকে একটি শহরের অতীত, এতিহ্য, বর্তমান ও ভবিষ্যত। অন্তর্দৃষ্টিতে তাকালে দিব্যি টের পাওয়া যায়, বিষন্নতার মেঘে ছেয়ে গেছে যান্ত্রিক এ শহর। প্রকৃতি হয়ে আছে বিরূপ। বসবাসের অবস্থা সঙ্কুলতায় পূর্ণ। সামগ্রিক পরিস্থিতি সঙ্গীন।

জানি না, বাসযোগ্য শহরের তালিকার ফের শীর্ষে জায়গা পাওয়া অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনার চেয়ে ঢাকার নগর-মানসিকতার দূরত্ব কত। ভূগোলের মাপে এই দূরত্ব মাপা অসম্ভব। বাসযোগ্য শহরের তালিকা প্রকাশকারী ইকোনমিস্ট ইন্টিলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)-এর ভাষ্যে ভিয়েনা যখন পেছনে ফেলেছে লন্ডন, প্যারিস, নিউইয়র্কের মত শহরকে এবং ভিয়েনা পরিণত হয়েছে ‘সিটি অফ ড্রিম’-এ, তখন ঢাকা বিপরীতমুখী পথে চলেছে পতন ও অবক্ষয়ের দিকে। এই যাত্রা বিপদ, অনিশ্চয়তা ও আতঙ্কে ভরা।

ইআইইউ প্রণীত ২০০টি শহরের ক্রমতালিকায় ১৬০ নম্বরে অবস্থান করছে ঢাকার চেয়ে বয়সে নবীন কলকাতা। কলকাতার পরে ভারতের রাজধানী দিল্লি রয়েছে ১৬১ নম্বরে। ভারতীয় শহরগুলোর মধ্যে ১৩৯ নম্বর স্থান নিয়ে শীর্ষে রয়েছে হায়দরাবাদ। ১৪৪ নম্বরে রয়েছে পুণে, ১৪৫ নম্বরে বেঙ্গালুরু, ১৫০ নম্বরে চেন্নাই এবং ১৫২ নম্বরে মুম্বই। আর একেবারে শেষ দিকে রয়েছে ঢাকা।

স্বাস্থ্য, শিক্ষা, স্থিতিশীলতা, পরিকাঠামো ও পরিবেশগত বিষয় নিয়ে এই তালিকা তৈরি করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, গত কয়েক বছর ধরেই ভিয়েনা এই তালিকায় শীর্ষে রয়েছে। তার পরেই দ্বিতীয় স্থানে আছে ডেনমার্কের কোপেনহেগেন। অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন ও সিডনি বসবাসযোগ্য শহরের তালিকায় যথাক্রমে তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে রয়েছে। আর এতো ঐতিহ্য নিয়ে ঢাকা তালিকার নিম্নসীমা ভেদ করে উঠে আসতে পারছে না। এতো আয়োজন ও উন্নয়নের পরেও ঢাকা দূষণমুক্ত ও বাসযোগ্য হতে পারছেনা কেন? এই প্রশ্নের বস্তুনিষ্ঠ উত্তর কে দেবে?

যুদ্ধ বা সংঘাত নয়, ঢাকার অধঃপতনের কারণ যে ভিন্ন, এই সরল সত্যটি যারা ক্ষুদ্র রাজনীতির বাইরে এসে অনুধাবন ও চিহ্নত করতে সক্ষম, তারাই এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর এবং কার্যকরী সমাধানসূত্র দিতে পারবেন।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম।

এ সম্পর্কিত আরও খবর