‘প্রবাসী প্রার্থী’ কি মেনে নেবে সিলেট নগরবাসী?

, যুক্তিতর্ক

কবির য়াহমদ | 2023-08-31 21:16:06

সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে সামনে রেখে পুরো নগর ছেয়ে গেছে সম্ভাব্য প্রার্থীর ব্যানার-পোস্টার-ফেস্টুনে। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর সমর্থনে স্থানীয় আওয়ামী লীগের মধ্যমসারির অনেকের ছবি শোভা পাচ্ছে তাতে। হাইকমান্ডের সবুজ সংকেত পেয়ে মাঠে নেমেছেন তিনি, এমনটা দাবি আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী ও তার অনুসারীদের। তবে স্থানীয় আওয়ামী লীগ বলছে হাইকমান্ড থেকে এমন কোন নির্দেশনা তারা পায়নি।

২০০২ সালে সিলেট সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠার পর আসছে জুন-জুলাই মাসে সিটির পঞ্চম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এরআগে চারবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় নেতা বদরউদ্দিন আহমেদ কামরান দলের সমর্থন ও মনোনয়নে নির্বাচন করে দুইবার জয়ী হয়েছিলেন। ২০২০ সালের ১৫ জুন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার পর এই সিটিতে প্রার্থী সংকটে ভুগছে আওয়ামী লীগ। দলের স্থানীয় পর্যায়ের একাধিক নেতা নির্বাচনের জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কামরানের অবর্তমানে সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন-লড়াই এতদিন স্থানীয় কয়েকজন নেতার মধ্যে আবর্তিত হচ্ছিল। যাদের মধ্যে আছেন আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আসাদ উদ্দিন আহমদ, সাধারণ সম্পাদক মো. জাকির হোসেন, যুগ্ম সম্পাদক এ টি এম এ হাসান জেবুল ও আজাদুর রহমান আজাদ, সাংগঠনিক সম্পাদক আরমান আহমদ শিপলু ও সদস্য প্রিন্স সদরুজ্জামান চৌধুরী। তবে হঠাৎই বদলে গেছে দৃশ্যপট। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে যুক্তরাজ্য প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী সিলেটে এসে দাবি করছেন তিনি নাকি দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘গ্রিন সিগন্যাল’ পেয়েছেন।

বিভিন্ন মাধ্যমে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী ও তার অনুসারীদের এমন দাবি সত্ত্বেও এতদিন কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি স্থানীয় আওয়ামী লীগ। কিন্তু গত ৬ ফেব্রুয়ারি আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর পক্ষ থেকে অনুষ্ঠিত এক শীতবস্ত্র বিতরণ অনুষ্ঠানে ময়মনসিংহ বিভাগের দায়িত্বে থাকা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল যখন বললেন, ‘জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে আমরা আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর সাথে আছি। সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তাকে নৌকার কাণ্ডারি করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী’ তখনই প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ।

নাদেল ময়মনসিংহ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা হলেও সিলেটেই তার রাজনীতিতে হাতেখড়ি। জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি এবং মহানগর আওয়ামী লীগের শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলনে তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু স্থানীয় আওয়ামী লীগের দায়িত্ব না পেলেও তাকে দেওয়া হয় আরও বড় দায়িত্ব; করা হয় কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক। দেওয়া হয় ময়মনসিংহ বিভাগের সাংগঠনিক দায়িত্ব। তার মতো হাইপ্রোফাইলড নেতার আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর প্রার্থিতার বিষয়ে এমন মন্তব্যের পর নড়েচড়ে বসেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, দিয়েছে তীব্র প্রতিক্রিয়া।

শফিউল আলম চৌধুরী নাদের মন্তব্যের পরের দিন সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মো. জাকির হোসেন সাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে- ‘সোমবার সিটি করপোরেশনের কোনো একটি ওয়ার্ডে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ময়মনসিংহ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক সিলেট সিটি মেয়র নির্বাচনের মনোনয়ন প্রসঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার বরাত দিয়ে যে বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন তা মহানগর আওয়ামী লীগের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য হলো: মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে এ সংক্রান্ত কোনো নির্দেশনা সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবে আমরা পাইনি। অতএব ঐতিহ্যবাহী সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সিলেট মহানগরের শৃঙ্খলাসহ দলীয় ভাবমূর্তি যাতে বিনষ্ট না হয় এবং বিভ্রান্তি যাতে না ছড়ানো হয় সংশ্লিষ্টদের প্রতি এ বিষয়ে আহবান জানানো যাচ্ছে।’

সিলেটের স্থানীয় আওয়ামী লীগ বলছে সিটি নির্বাচন নিয়ে তারা কোন নির্দেশনা পায়নি, আবার যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর অনুসারীরা বলছেন, তিনি হাইকমান্ডের নির্দেশনা পেয়েছেন। এটা নিয়েই এখন বিভক্ত স্থানীয় আওয়ামী লীগ। একদিকে স্থানীয় নেতাদের অন্তত সাতজন মনোনয়ন-প্রত্যাশী, অন্যদিকে প্রবাসী এই মনোনয়ন-প্রত্যাশীর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের মধ্যে আছেন কেবল শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল। এমন অবস্থায় আসছে নির্বাচনেও মাথা চাড়া দিয়ে ওঠতে পারে দলীয় কোন্দল!

মহানগর আওয়ামী লীগের সংবাদ বিজ্ঞপ্তির বাইরে স্থানীয়দের সিলেট সিটি নির্বাচন নিয়ে আর কেউ কিছু বলছেন না ঠিক, তবে ভেতরে-ভেতরে বইছে ক্ষোভের আগুন। আওয়ামী লীগ-যুবলীগ ও ছাত্রলীগের অনেকের সঙ্গে ব্যক্তিগত সখ্যের সুবাদে যা জানলাম তাতে মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি যদি সিলেটের স্থানীয় নেতাদের বাইরে অন্য কাউকে বিবেচনা করে কেন্দ্র তবে ফের হতাশ হতে হবে আওয়ামী লীগকে। অনেকের অভিযোগ, আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী প্রবাসী। তিনি এলাকায় নিয়মিত নন, মাঝেমাঝে আসেন; এই মাঝেমাঝে আসাযাওয়ায় স্থানীয় কর্মীদের সঙ্গে তার যোগাযোগ নেই। তার যোগাযোগ কেবলই নেতাগোত্রীয়দের সঙ্গে। মধ্যমসারির অনেক নেতা তার সঙ্গ দিচ্ছেন ঠিক, কিন্তু তারা কতখানি জনতা-সংশ্লিষ্ট সেটাও প্রশ্ন। কেউ কেউ বলছেন, দলের জন্যে ত্যাগ করবে স্থানীয় নেতারা আর জনপ্রতিনিধি হবে প্রবাসী এবং অতিথিরা—এটা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ঐতিহ্য নয়।

সিলেট সিটি করপোরেশনের বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা। সিটিতে তিনি জনপ্রিয়ও। এছাড়াও আছে মন্ত্রী-পরিবারের সঙ্গে সখ্যের সংবাদ। দেশের অন্য কোথাও যাই হোক না কেন সিলেট রাজনৈতিক সহনশীলতায় অনন্য, যেখানে বিএনপি দলীয় মেয়র সরকারের সার্বিক সমর্থন পেয়ে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে যাচ্ছেন। এমন একজন মেয়র প্রার্থীর বিপক্ষে দ্বন্দ্বে থাকা আওয়ামী লীগ কতখানি সুবিধা করতে পারবে এটা নিয়ে প্রশ্ন আছে সবখানে। যদিও অন্য সকল স্থানীয় নির্বাচনের মতো সিলেট সিটি নির্বাচনও বিএনপি বর্জন করলে সে চিত্র হবে অন্য। এক্ষেত্রে এই নির্বাচন উন্মুক্ত হয়ে যেতে পারে। আর যদি বিএনপি এখানে অংশ নেয় তবে ধারণা করা হচ্ছে বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীই দলটির মনোনয়ন পেতে পারেন। আরিফুল হক চৌধুরী বিএনপির, এমনকি স্বতন্ত্র হিসেবে প্রার্থী থাকলে ভোটের লড়াইয়ে অন্তর্দ্বন্দ্বে থাকা আওয়ামী লীগ টিকতে পারবে বলে মনে হয় না।

শোনা যায়, আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘনিষ্ঠ প্রবাসী। স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন ইউনিটের কমিটি গঠনে তিনি নানাভাবে প্রভাব রাখছেন বলে অভিযোগ। অভিযোগ সত্য হলে এই প্রভাবে যারা লাভবান তারা নিশ্চয় তার পক্ষে থাকবে, কিন্তু দলের কমিটির একাংশ আর ভোটারদের মধ্যে অনেক পার্থক্য। সিলেট সিটির লক্ষ লক্ষ ভোটার এখনও ভালোভাবে চেনে না তাকে। জীবনের বেশিরভাগ সময় প্রবাসে কাটানোর সুবাদে মানুষের কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ হয়েছে তার কম। এই হিসেবে তিনি কি সিলেট মহানগরবাসীর জনপ্রতিনিধি হওয়ার উপযুক্ত প্রার্থী? আওয়ামী লীগের অগণন নেতাকর্মী ও সাধারণ ভোটাররা তাকে কি মেনে নিতে পারবে, এই প্রশ্ন এখন সিলেটজুড়ে?

কবির য়াহমদ: সাংবাদিক, কলাম লেখক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর