নেতার সংকট, নাকি নেতৃত্বের

, যুক্তিতর্ক

কবির য়াহমদ | 2023-09-01 09:17:48

একজন নাম প্রস্তাব করলেন, আরেকজন সমর্থন; এরপর উপস্থিতির হ্যাঁ-হ্যাঁ; এভাবেই নেতা নির্বাচন। এভাবেই নির্বাচিত হলেন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। এখানে কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, একক প্রার্থীই স্বাভাবিকভাবে নির্বাচিত। ভালো কথা, ওখানে নির্বাচন কমিশনও ছিল; তারা ঘোষণা দিয়েছে নির্বাচিতের নাম। বাংলাদেশে সর্ববৃহৎ ও প্রাচীন রাজনৈতিক দলের কাউন্সিল অধিবেশনে এভাবেই নেতা নির্বাচিত হলেন। এটা আদতে নির্বাচন নয়, পদে নিযুক্তকরণ। কারণ আগে থেকে জানা নির্বাচনে দ্বিতীয় প্রার্থী নেই!

গত শনিবার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলন ও কাউন্সিলে দশমবারের মতো সভাপতি হয়েছেন শেখ হাসিনা, এবং তৃতীয়বারের মতো সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন ওবায়দুল কাদের। সভাপতি হিসেবে শেখ হাসিনার নির্বাচিত হওয়া অনুমিতই ছিল, কারণ আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনার বিকল্প নেতৃত্ব গড়ে ওঠেনি। আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নেতা কে, সেটা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। পরিবারতান্ত্রিক অনুশীলনের ধারাবাহিকতায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের সদস্য বিশেষ করে তার দুই কন্যা ও তাদের পরিবারের কেউ আওয়ামী লীগের শীর্ষ পদে থাকবেন এটা অনিবার্যই, কিন্তু শেখ হাসিনার পর আওয়ামী লীগের হাল ধরবেন কে সে ইঙ্গিত মেলেনি এখনও। শেখ হাসিনার পুত্র সজীব আহমেদ ওয়াজেদ জয় প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করছেন ঠিক, কিন্তু আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে তিনি নেই। নেই রাজনৈতিক কোন কর্মসূচিতেও।

আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে শেখ হাসিনার বিকল্প নেই, এটা সত্য। কিন্তু দলের সাধারণ সম্পাদক পদে ওবায়দুল কাদের এখনও অপ্রতিদ্বন্দ্বী! তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত ও পছন্দের লোক হিসেবেই প্রমাণিত। কেবল তিন-তিনবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়াই নয়, শেখ হাসিনা সরকারের প্রতিটি মেয়াদে তিনি মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। তিনি শারীরিকভাবে শতভাগ সুস্থ নন, তবু প্রধানমন্ত্রীর অগাধ আস্থা তার ওপর। গত দুই মেয়াদে সারাদেশে দলটির সাংগঠনিক অবস্থা অন্য যেকোনো সময়ের চাইতে দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও তার বিকল্প চোখে পড়ছে না দলীয় সভানেত্রীর।

আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ইতিহাস ও বাংলাদেশের জন্ম প্রক্রিয়া অবিচ্ছেদ্য বিষয়। দলটি মুক্তির সংগ্রাম থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমান তার অসম সাহসী নেতৃত্বগুণের কারণে মুক্তির সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুটি পদেই দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৪৯ সালে দল গঠনের পর থেকে এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ইতিহাসকে যদি দুইভাবে চিন্তা করা হয় তবে দেখা যায় দেশ স্বাধীনের আগে-পরে গত ৭৩ বছরে এখন পর্যন্ত মাত্র ছয়জন সভাপতি এবং নয়জন সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এরবাইরে বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৭৬ ও ১৯৭৭ সালে দুইবার দুজন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও আহবায়কের এবং একজন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তার মধ্যে ১৯৮১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে দীর্ঘ সময় সভাপতির দায়িত্বে আছেন শেখ হাসিনা।

মুক্তিযুদ্ধের আগে আওয়ামী লীগের প্রথম সভাপতি ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তিনি ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত এক থেকে চারটি কাউন্সিলে সভাপতি নির্বাচিত হন। এরপর এক বিশেষ কাউন্সিলে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হন আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ। ১৯৬৪ সালে দলের পঞ্চম কাউন্সিলে তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন। ছিলেন ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত। ওই বছর ষষ্ঠ কাউন্সিলে দলের সভাপতি হয়ে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। আওয়ামী লীগের প্রথম কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শামসুল হক। এরপর ১৯৫৩ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন শেখ মুজিবুর রহমান। তাজউদ্দীন আহমেদ ১৯৬৬ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত তিন মেয়াদে দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৪ সালে দশম কাউন্সিলে সভাপতি হন এ এইচ এম কামারুজ্জামান। ১৯৭৫ সালে ঘাতকের গুলিতে কেন্দ্রীয় কারাগারে নিহত হন তিনি। এরপর ১৯৭৮ সালে কাউন্সিলে সভাপতি হন আবদুল মালেক উকিল। তিনি ১৯৮১ সাল পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ৪১ বছরের বেশি সময় ধরে দলের সভাপতি পদে আছেন শেখ হাসিনা। দলের ১৩তম কাউন্সিলে তিনি প্রথম সভাপতি হন। সর্বশেষ ২২তম কাউন্সিলেও তিনি একই পদে নির্বাচিত হয়েছেন। তবে এর মাঝে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতা নিহত হওয়ার পর ১৯৭৬ সালে মহিউদ্দিন আহমেদ ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হন। এর পরের বছর ১৯৭৭ সালে দলের ১১তম কাউন্সিলে সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে আহ্বায়ক করা হয়। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদক পদে ছিলেন জিল্লুর রহমান। এরপর দুই মেয়াদে সাধারণ সম্পাদক হন আবদুর রাজ্জাক। সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ১৯৮৭ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত। তারপর জিল্লুর রহমান আবারও দুই মেয়াদে ২০০২ সাল পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০২ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আবদুল জলিল। এরপর ২০১৬ পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। ২০১৬ থেকে টানা তিন কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন ওবায়দুল কাদের। তিনি আগামী তিন বছর এই দায়িত্ব পালন করবেন।

দেশের প্রাচীন দল হলেও খুব বেশি সংখ্যক নেতা আওয়ামী লীগের দুই শীর্ষ পদে আসতে পারেননি। এরমধ্যে শেখ হাসিনা টানা দশবার, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চারবার করে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান ও জিল্লুর রহমান চারবার করে, এবং তাজউদ্দীন আহমেদ ও ওবায়দুল কাদের টানা তিনবার করে এই দায়িত্ব পেয়েছেন। এছাড়াও একাধিকবার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন আবদুর রাজ্জাক, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী এবং সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।

এবারের কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ওবায়দুল কাদেরের নিযুক্তি অনেককে অবাক করেছে। তার বিরুদ্ধে প্রকাশ্য কোন বিরোধিতার প্রকাশ দেখা না গেলেও সাধারণ নেতাকর্মীর অনেকের ধারণা ছিল নির্বাচনকে সামনে রেখে এবং দলে গতিশীলতা আনতে সাধারণ সম্পাদক পদে নতুন কাউকে নেওয়া হবে, কিন্তু সেটা হয়নি। যে নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বদলের যে ধারণা করা হচ্ছিল ওবায়দুল কাদেরকে স্বপদে রাখাই হয়েছে মূলত সেই নির্বাচনকে সামনে রেখেই। নির্বাচনের এক বছর আগে আওয়ামী লীগ নতুন কাউকে গুরুত্বপূর্ণ এই পদে দায়িত্ব দিয়ে চ্যালেঞ্জ কিংবা ঝুঁকি নিতে চায়নি বলে আগের কমিটির অধিকাংশকেই রেখে দিয়েছে। এতে দলে গতিশীলতা আসবে কি-না সেটাও এখনও স্পষ্ট নয়। তবে গত ছয় বছরের আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থা বিবেচনা করলে নেতাকর্মীরা অন্তত আশাবাদী হতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না!

২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে টানা ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ। এই সময়ে বড়ধরনের রাজনৈতিক বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়নি দলটিকে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে সারাদেশে বিএনপি-জামায়াতের আগুন-সন্ত্রাসের বাইরে মাঠে নেই বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। ওই আগুন সন্ত্রাসের বিপক্ষে রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে দাঁড়াতে পারেনি আওয়ামী লীগ, প্রতিরোধ করেছে প্রশাসন। এরপর থেকে দল চলে গেছে অন্তরালে, বিপরীতে সামনে এসেছে প্রশাসন। যে আওয়ামী লীগের জন্ম, ইতিহাস ও ঐতিহ্য গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ সেই আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এখন দেশব্যাপী জাতীয় দিবসগুলো পালনেরও উদ্যোগের দেখা মেলে না। এরবাইরে আছে সাংগঠনিক স্থবিরতা। দল ক্ষমতায় থাকার কারণে অনুপ্রবেশকারীরা সামনে এসেছে, পেছনে পড়ে গেছে ত্যাগীরা। এখানে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দায় আছে। সাংগঠনিক দিকটি থেকেছে উপেক্ষিত। এতে করে নির্বাচনের আগে কাউন্সিল করলেও কেন্দ্রীয় কমিটিতে হাত দেওয়ার দেওয়ার মতো সাহস দেখাতে দেখাতে পারেননি দলীয় সভানেত্রী। স্বপদে রেখেছেন সাধারণ সম্পাদককে, প্রায় অপরিবর্তিত রাখতে হয়েছে আগের কমিটিকেও।

অনেক আয়োজনের কাউন্সিল ও সম্মেলন করে আগের কমিটির প্রায় অপরিবর্তিত রাখার পর আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক চর্চা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেছে। এত বিশাল ও ঐতিহ্যবাহী একটা দলে সাধারণ সম্পাদক হওয়ার মতো যোগ্য লোকের অভাব, এটা সর্বাংশে সত্য নয়। কিন্তু যখনই সাধারণ সম্পাদক পদে একজনের নাম প্রস্তাবের পর সেটা বিনা প্রশ্নে-বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পাস হয়ে যায় তখন যোগ্য নেতার সংকটের প্রশ্ন কি ওঠবে না? ক্ষীণ স্বরে হলেও এই প্রশ্ন ওঠবে।

আমরা বিশ্বাস করতে চাই সাধারণ সম্পাদক হওয়ার মতো যোগ্য লোক আওয়ামী লীগে রয়েছে। তবে সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে আওয়ামী লীগ ঝুঁকি নিতে চায়নি। বঞ্চিতদের কেউ যদি অসহযোগিতা করে, এই কি ভয়? তবে শেখ হাসিনা যেখানে বর্তমান সেখানে চাইলে এই ঝুঁকি নেওয়াই যেত। শেখ হাসিনা দায়িত্ব পালনকালে যদি এমন ঝুঁকি না নেওয়া হয় তবে আওয়ামী লীগ নেবে কখন?

এ সম্পর্কিত আরও খবর