‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখা’র নামে বিএনপির বিভ্রান্তি

, যুক্তিতর্ক

ভূঁইয়া ইমরুল কায়েস | 2023-08-31 01:56:03

 

সরকারবিরোধী চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিএনপি ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখা’ তুলে ধরেছে। কিন্তু তা কতটুকু কতটুকু বৈধ, সঙ্গত ও প্রাসঙ্গিক? এসব প্রশ্নের মুখে আবর্তিত হচ্ছে বিএনপির রূপরেখা, যা নিয়ে দলটির ভেতরে ও দেশের রাজনৈতিক পরিসরে সৃষ্টি হয়েছে চরম বিভ্রান্তি।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের চর্চায় কোনও রাষ্ট্রে বিদ্যমান সরকার ব্যবস্থার নানা সংস্কার ও পরিবর্তনের কথা আলোচিত হয়। সরকারকে আরও গণতান্ত্রিক ও জনমুখী করতে এবং সুশাসনের পরিসর বাড়াতে সরকার বা শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন ও সংস্কার আইনানুগ রীতি-নীতি অনুযায়ী হতেই পারে। এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের কথা শুনতে পেলে কানে বড্ড বেমানান লাগে। সুদীর্ঘ আন্দোলনের পর্ব পেরিয়ে, অগণিত মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে, লাখো শহিদের রক্তদানে, মা-বোনের ইজ্জতের দামে এবং সমগ্র বাঙালি জাতিসত্তার স্বপ্ন ও সংগ্রামের মূল্যে অর্জিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের এখতিয়ার কার? কোনও একক দল, বিচ্ছিন্ন নেতৃত্বে বাঙালির আত্মপরিচিতির রাজনৈতিক ঠিকানার মেরামতি কাজ করার ক্ষমতা বা ম্যান্ডেট কে দিয়েছে? স্বপ্রণোদিত হয়ে নিজে নিজে এমন একটি দায়িত্ব গ্রহণ করা বিএনপির জন্য কতটুকু বৈধ ও সঙ্গত?

শাসনতান্ত্রিক বিবেচনায় স্বল্প সংখ্যক সংসদ সদস্য পদত্যাগ করায় বিএনপি এখন রাজনৈতিক ব্যবস্থার বাইরের একটি দলে পরিণত হয়েছে। জনরায়ের কোনও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দলটির পেছনে নেই। গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক পরিসরের বৈধ ও আইনানুগ অবস্থান জাহির করার কোনও স্থানে না থেকে খোদ  রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখা দেওয়া বিএনপির জন্য আদৌ মানানসই কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। যেসব বিদেশি বন্ধুরা বিএনপিকে উস্কে দিচ্ছেন গণতন্ত্রের নাম করে, তারা এবার কোন মুখে কথা বলবেন? গণতন্ত্রের পরীক্ষায় পাসে আগেই পুরো সিলেবাস বদলের দাবি করে বিএনপি আসলে কি চাচ্ছে, সেটাই এক রাজনৈতিক রহস্য, যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ধূম্রজালের সঞ্চার করেছে।

প্রাসঙ্গিকভাবে, ১৪ দলীয় জোট নেতারা স্পষ্ট করে বলেছেন যে, রাষ্ট্র সংস্কার নয়, রেইনবো নেশন চায় বিএনপি, যা দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে মীমাংসিত বিষয়কে অমীমাংসিত করার হুমকি স্বরূপ।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রাষ্ট্র সংস্কার নয়, বিএনপি মূলত তাদের অতীতের সামরিক শাসনামলের বৈধতা দিতে চায়। একই সঙ্গে সুবিধাভোগী-সাম্প্রদায়িক-ধর্মভিত্তিক মৌলবাদী গোষ্ঠীর সমন্বয়ে দেশে একটি রেইনবো নেশন প্রতিষ্ঠা করতে চায়। যেভাবে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে পঁচাত্তরের পর রাষ্ট্র সংস্কার করতে গিয়ে প্রথমেই সংবিধানের ওপর আঘাত হানেন, তেমনিভাবে বিএনপির বর্তমান নেতৃত্বও গণতান্ত্রিক-সাংবিধানিক ধারাকে আঘাত করতে উদ্যত।

উল্লেখ্য, বিএনপি বারংবার মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের সংবিধানকে কাটাছেঁড়া করেছে। সামরিকতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করেছে। জামায়াতসহ সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী গোষ্ঠী এবং ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও শক্তিকে এ দেশের রাজনীতিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে। বিএনপি ও জিয়াউর রহমানের হাত ধরেই মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে পরিচালিত হতে থাকে। যার বোঝা এখনো বইতে হচ্ছে দেশের মানুষকে।

সরকারবিরোধী চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিএনপি ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখা’ তুলে ধরে। রাজধানীর এক অভিজাত হোটেলে দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন এ রূপরেখা তুলে ধরেন। এর আগে ঢাকাসহ আট বিভাগেই গণসমাবেশ করে বিএনপি। সর্বশেষ গত ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠে ঢাকার বিভাগীয় গণসমাবেশ হয়। সেখানেই এ রূপরেখা দেওয়ার কথা জানানো হয়। তাদের ঘোষিত ২৭ দফা কর্মপরিকল্পনায় পরপর দুই মেয়াদের বেশি কেউ রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। ক্ষমতায় এলে এমন বিধান করার কথা জানানো হয় বিএনপির পক্ষ থেকে। এছাড়া রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা, উচ্চকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা করা, নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তনের ঘোষণাও দিয়েছে দলটি। কিন্তু এসব প্রস্তাবের পেছনে বিএনপির তরফে জনরায়ের কোনও ম্যান্ডেট নেই। বরং বিএনপির প্রস্তাবে দলটির অতীত মনোভাবই প্রতিফলিত হয়েছে।

কারণ, বিএনপির প্রস্তাবে নতুন কিছু নেই। বরং তারা সংবিধান সংশোধনের কথা বলে জিয়াউর রহমানের আমলের সামরিক শাসনকে বৈধতা দিতে চায়। হ্যাঁ-না ভোট পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চায়। পঁচাত্তর-পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রের সংস্কার করতে গিয়ে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাদ দিয়েছিলেন। তিনি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছিলেন। এখন তারা মূলত অবসরপ্রাপ্ত কিছু সামরিক, অসামরিক, সুবিধাভোগী গোষ্ঠী এবং স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতসহ সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী, ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক চরিত্রটাকে পালটে ফেলে একটি রেইনবো নেশন প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

বস্তুতপক্ষে, বিএনপির ২৭ দফা রাজনৈতিক সংস্কারের চমকবাজির আড়ালে মূলত যুদ্ধাপরাধী, খুনি, সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদী সন্ত্রাসীদের হালাল এবং তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠার কালো দলিল। বিএনপির ১০ দফার পর ২৭ দফায় আবার প্রমাণ হলো যে, জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে ক্ষমতা পুনর্দখল করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়েই সামরিক শাসক জিয়া কর্তৃক সংবিধান থেকে নির্বাসিত স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং রাষ্ট্রীয় মূল চার নীতি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ পুনঃস্থাপিত হয়েছে। বিএনপির ২৭ দফায় সংবিধান সংস্কারের কথার আড়ালে এই সংশোধনী (পঞ্চদশ) বাতিল করে মহান মুক্তিযুদ্ধ, অতীতের ঐতিহাসিক গণআন্দোলনসমূহ, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে মীমাংসিত বিষয়কে অমীমাংসিত করার হুমকি দিয়েছে।

বিএনপি ২৭ দফায় ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার কথা বললেও রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসাবে ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়ে নীরব থেকেছে। তারা অনেক দিন ক্ষমতায় থাকলেও হত্যা, ক্যু, সামরিক শাসন ও অবৈধ ক্ষমতা দখল, সাম্প্রদায়িকতা, রাজাকার-আলবদর-যুদ্ধাপরাধীদের হালাল করা ছাড়া সংবিধানের গণতান্ত্রিক সংস্কারের কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। এমনকি বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় সংবিধানে গণতান্ত্রিক সংস্কারের কোনো প্রস্তাবও দেয়নি। ২৭ দফাতে সংবিধানের ৭০ ধারার আংশিক পরিবর্তন, উচ্চকক্ষ গঠন, সংবিধান সংস্কার কমিশনের কথা ভাসাভাসাভাবে বললেও রাষ্ট্র ও শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তনের কোনোই সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিতে পারেনি। বিএনপি ২৭ দফায় কেবল দেড় দশক অর্থাৎ ২০০৭ সাল পরবর্তীকালের দুর্নীতি, লুট, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিচার-আচারের কথা বলে অতীতের সব অন্যায় অপরাধকে আড়াল করতে চেয়েছে।

প্রকৃত প্রস্তাবে, খোদ রাষ্ট্রকে মেরামত করতে গিয়ে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান দেশটাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে অনেক দূরে নিয়ে গিয়েছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশটাকে পুরোপুরি উলটো পথে নিয়ে যাচ্ছিলেন। ফলে বর্তমানে বিএনপি রাষ্ট্র সংস্কার নয়, মূলত তাদের অতীতের সামরিক শাসনামলের বৈধতা দিতে চায়। একই সঙ্গে সুবিধাভোগী-সাম্প্রদায়িক-ধর্মভিত্তিক মৌলবাদী গোষ্ঠীর সমন্বয়ে দেশে একটি বিপদজনক পরিস্থিতি প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে না গিয়ে বিএনপি 'রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখা'র মাধ্যমে নিজেদের বিভ্রান্ত রাজনীতিকেই উন্মোচিত করেছে, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

ভূঁইয়া ইমরুল কায়েস, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর