এত ভয় ও বেদনার শেষ কোথায়?

, যুক্তিতর্ক

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম | 2023-08-30 02:45:20

গত ৩ ডিসেম্বর একজন বেপরোয়া গাড়ি (কার) চালক রাজধানীর শাহবাগ এলাকায় একটি মোটর সাইকেলকে ধাক্কা দিয়ে পথের পার্শ্বে উল্টিয়ে ফেলে দিয়েছে। মোটর সাইকেলের চালক ও তার পিছনে বসা নারী যাত্রী উভয়েই ছিটকে মাটিতে পড়ে গেছেন। নারী যাত্রীর উপর দিয়ে কারটি চলে যাবার সময় তার পরিধেয় কাপড় বা শাড়ির অংশ বাম্পারে পেঁচিয়ে গেলে তিনি দুর্ভাগ্যবশত: গাড়ির বাম দিকের বাইরে দুই চাকার মাঝে আটকিয়ে আটকিয়ে যান। এমতাবস্থায় গাড়ির চালক দ্রুতগতিতে গাড়ি নিয়ে পালাতে থাকেন। এভাবে নারী যাত্রীকে রাস্তায় ছেঁচড়ে টেনে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি হয়ে এফ রহমান হলের দিকে এক মাইল রাস্তা পার হয়ে যান। এই দৃশ্য দেখে উক্ত গাড়িরচালককে থামানোর জন্য পিছনে কয়েকটি মোটর সাইকেল, পথচারীরা দৃষ্টি আকর্ষণ করে থামানোর চেষ্টা করতে থাকলে গাড়ি চালক আরো দ্রুত বেগে পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে এক সময় নীলক্ষেত চৌরাস্তার মোড়ে আটকা পড়েন। ক্ষিপ্ত জনতা তাকে ধরে গণধোলাই দিয়ে পুলিশের মাধ্যম হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছেন। গুরুতর আহত সেই নারীকে বাঁচানো যায়নি।

এমন দৃশ্য প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সকল গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। যারা টিভিতে এই ভিডিও দৃশ্য দেখেছেন তারা নিশ্চয়ই কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন। এমন হৃদয় বিদারক দুর্ঘটনা জাতির বিবেককে ভীষণভাবে আপ্লুত করেছে। কমপক্ষে দশজন প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য থেকে প্রকাশিত হয়েছে কার চালক বড় বেপরোয়াভাবে গাড়িটিকে চালিয়ে না গেলে হয়তো মহিলাটিকে বাঁচানো যেত। আরো নানা প্রশ্ন অনেকের মনে ঘুরপাক খেয়ে গেছে এই নির্মম ঘটনায়। চালক কেন এত বেপরোয়া ভাব প্রদর্শন করেছে? তার কারণটা আসলে কি ছিল? গাড়ি চালকের পিছনে মোবাইল ফোনের ভিডিও চালু করা অবস্থায় একটি মোটর বাইককে অনুসরণ করতে দেখা গেছে। সেই বাইকে দুজন ছিল। তারা বেপরোয়া কারটি থামানোর জন্য অনবরত চিৎকার করে পিছু ছুটছিলেন। কিন্তু কার চাল এত আরো বেশী দ্রুত পালানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। তার এই পালানোর প্রবণতা গাড়ির নিচে আটকে যাওয়া নারীটির করুণ পরিণতি ডেকে আনে। একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, দুর্ঘটনাকারী কারের চালক বেশী ভয় পেয়ে পালানোর চেষ্ট করছিলেন। ভয়টা তার নিজের জীবন বাঁচানোর তাগিদে ছিল।

আসলে আমাদের দেশে সড়কপথ মানেই ভয়ের জায়গা। এখানে সড়কে চলতে গেলেই নানা ভয় সবার মনের মধ্যে বাসা বাঁধে। এই ভয় শুধু যাত্রীর নয়। এই ভয় পথচারীর ভয়। এই ভয় গাড়ির মালিকের ভয়, এই ভয় গাড়ি চালকের ভয়, পথের ধারে যারা বাস করে, দোকান করে, ব্যবসা করে সবার ভয়। এই ভয় থেকে নানা বেদনার সৃষ্টি হয়-হয় নানা করুণ কাহিনী উপাখ্যান। এই ভয়, কষ্ট ও বেদনার শেষ কোথায়? তা কেউ জানে না।

এই মর্মান্তিক ঘটনায় স্বামীহারা মরহুমা রুবিনার জীবনাবসান হয়েছে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে। তার স্বজনেরা এটাকে মৃত্যু না বলে হত্যাকান্ড হিসেবে বিচার দাবী করেছেন। তার স্কুল পড়ুয়া ছেলেটিকে এখন থেকে কে দেখভাল করবে বলে তার বোনেরা হতাশা ব্যক্ত করছেন ইতোমধ্যে। কিন্তু এমন বিচারের দাবী কার মাধ্যমে কোথায় গিয়ে নিশ্চয়তার বাস্তবতা খুঁজে পাবে তা কেউ হয়তো জানেন না।

প্রতিদিন ঘটছে এমন অনেক ঘটনা। শুধু প্রতিদিন নয়, প্রতিঘণ্টায় এমন নিষ্ঠুর ঘটনা কেড়ে নিচ্ছে বহু মূল্যবান প্রাণ। পঙ্গু করে দিচ্ছে অনেক সম্ভাবনাময় জীবনকে। অনেক আশাবাদী পরিবারের সব আশা ভরসাকে ধূলিস্মাৎ করে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। একই দিনে যশোরের মণিরামপুরের বেগারীতলা বাজারে একটি কাবারের দোকানে কাভার্ডভ্যান ঢুকে বাবা-ছেলে সহ পাঁচজনের করুণ মৃত্যু ঘটেছে। হোটেলটি তছনছ হয়ে গেছে।
সেখানেও একই দৃশ্য দেখা গেছে। কাভার্ডভ্যান ফেলে সেটার চালকও ও হেল্পার উভয়ে পালিয়ে গেছে। এই পালানোর প্রবণতা আমদের দেশে একটি অনৈতিক অনুশীলন।

কোথাও কোন দুর্ঘটনা ঘটলে সবার আগে চালক ও হেল্পার লাপাত্তা হবার প্রবণতা আমাদের জাতিগত দুর্বলতা। এই পলায়নকর প্রবৃত্তি ও চৌর্যবৃত্তির দুর্বলতা আমাদের সকল পরিবহণ সেক্টরের হীনতাকে আরো নগ্নভাবে প্রকাশ করে চলেছে।

এর মাধ্যমে নিজে দোষ করে অপরের ঘাড়ে সেই দোষ চাপানোর মানসিকতা আমরা চাপিয়ে দিই। এটাই জাতির প্রতিটি মানুষকে শেখাই। এই হীন মানসিকতার পরিবর্তন নিয়ে কখনো চিন্তাও করি না। কারণ আমাদের দেশে মানুষের প্রতি মানুষের দরদ নেই। শ্রদ্ধা-ভক্তিও নেই। মানুষের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও সহানুভূতি প্রদর্শন ছাড়া সামাজিক উন্নতি লাভ করা অসম্ভব। এসব কথা এখনও কথার কথা হিসেবে প্রচলিত থেকে গেছে। এগুলোর বাস্তব ভিত্তি উধাও হয়ে গেছে আমাদের নীতিহীনতার কারণে।

ঢাবির সন্নিকটে দুর্ঘটনা ঘটানো গাড়িচালক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন সাবেক শিক্ষক। তিনি মোটর বাইকটিকে ধাক্কা দিয়ে দুই যাত্রীকে আহত করার পর একবারের জন্যেও ভাবলেন না একবার নিজে গাড়ি থেকে নেমে আহতদেরকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করি! যদি এই মানসিকতা থাকতো তাহলে এত বড় করুণ ঘটনার জন্ম নিত না।

এই মানসিকতার জন্ম না হবার পিছনে সরকারী নীতিহীনতাকে দায়ী করা যায়। যেমন, এখনও আমাদের সিংহভাগ গাড়িগুলো ইন্স্যুরেন্সবিহীনভাবে রাস্তায় চলাচল করার অনুমতি পায়। সেজন্য তারা নিদ্বিধায় চলাচলের সাহস করে। এখনও যান্ত্রিকভাবে গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা করা হয় না। সামান্য উপরি দিলেই অচল গাড়ি ফিটনেস সার্টিফিকেট পেয়ে রাস্তায় দৌড়াতে শুরু করে। গাড়ি চালকের কোন সাইকোলজিক্যাল টেষ্ট ব্যতিরেকে লাইসেন্স হাতে তুলে দেয়া হয়।
বিশেষ করে ইন্সুরেন্সের মাধ্যমে বাধ্যতামূলকভাবে দূর্ঘটনার জন্য যথার্থভাবে ক্ষতিপূরণ দেয়া-নেয়ার সিস্টেম চালু না থাকায় মালিক, চালক, যাত্রী পথচারী সবাই ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এমন যদি হতো যে, কেউ কোন দুর্ঘটনায় পতিত হলে তার জন্য ভয়ের কারণ নেই। তার সব ধরণের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করবে ইন্স্যুরেন্স করা প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান প্রতিটি দুর্ঘটনার কারণ ও বাস্তব দিকগুলো যাচাই করে অতিদ্রুত দায়ী চিহ্নিত করবে এবং যে পক্ষ দুর্ঘটনার জন্য যতটুকু দায়ী সাব্যস্ত হবে সে পক্ষ ততটুকু ক্ষতিপূরণ পাবে বা প্রদান করবে।

আমাদের দেশে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে চালকের দ্রুত লাপাত্তা হবার কারণ হলো গণপিটুনিতে তার নিজের জীবন হারানোর ভয়। গাড়ি ধ্বংস হোক কিন্তু নিজের জীবন বাঁচলে মালিক আমাকে আরেকটা গাড়ি কিনে দিবে। কারণ মালিকের অঢেল টাকা আছে। কারণ জনতা নিজের হাতে আইন তুলে নেয়। জনতা মনে করে পুলিশি মামলা হলে নানা জটিলতা ও হয়রানিতে পড়ে এর সুষ্ঠু বিচারে দীর্ঘসূত্রিতা হবে। তাই শাস্তিটা আমরা নিজেরাই দিয়ে নিই। আমাদের দেশে মব বা উচ্ছৃংখল জনতার এরপ আচরণ ও হীন মানসিকতা বেশ ক্ষতিকর।

উন্নত বিশ্বে কোথাও কোন পরিবহন দুর্ঘটনা ঘটলে সেজন্য সরকারি কর্তৃপক্ষকে কোন অর্থ ব্যয় করতে হয় না। এজন্য প্রতিটি যানবাহনের মালিককে দিয়ে বাধ্যতামূলকভাবে করা নির্দিষ্ট ইন্সুরেন্স কোম্পানীগুলো সার্বিক ক্ষতিপূরণ দেবার ব্যবস্থা করে। তাই তাদের কোন অসুবিধা হয় না। যেহেতু সব পক্ষের ক্ষতিপূরণ পাবার ব্যাপারে নিরাপত্তাবোধ থাকে সেহেতু কেউ হতাশ হয়ে গাড়ি চালায় না। কেউ গাড়ি চালাতে গিয়ে ভয় পায় না। এমনকি গাড়ি চালাতে গিয়ে কেউ কোন দুর্ঘটনায় পতিত হলে পালাতে চেষ্টা করে না। দুর্ঘটনা ঘটিয়ে কাউকে লাপাত্তা হবার রেকর্ড নেই সেসব দেশে।

বরং কারো কারণে দুর্ঘটনা ঘটলে তিনি দ্রুত জরুরি নম্বরে নিকটস্থ হাসপাতাল বা পুলিশ স্টেশনে জানিয়ে দেন এবং তার এনআইডি ও ইন্সুরেন্স কোম্পানির তথ্য পাঠিয়ে দেন। এমনকি কারো কর্মস্থলে যাবার পথে যদি পরিবহন দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে তার নিকট থেকে দ্রুত আইডি নম্বর নিয়ে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। এজন্য তার সময় নষ্ট করা হয় না বা কাজে কোন ব্যাঘাত দেয়া হয় না। তাদের সকল তদন্ত হয় নির্ভেজাল বা দুর্নীতিমুক্ত। তদন্তের পর যার যেমন দায় খুঁজে পাওয়া হয় তার তেমন সাজা বা ক্ষতিপূরণ দিতে হয। এমনকি সিগন্যাল অমান্যকারীকেও সিসি ক্যামেরার রেকর্ড দেখে ক্ষতিপূরণ দিতে হয় বাধ্যতামূলকভাবে। এজন্য কাউকে সরাসরি কোন থানা অফিস বা হাজতখানায় আসতে হয় না। বরং পরে তদন্ত করে অফিসের বেতন বা তার ব্যবসার ব্যাংক হিসেব থেকে জরিমানা কর্তন করে বাড়িতে রিপোর্ট পাঠিয়ে দেয়া হয়।

জাপানে কোন গাড়িচালক যদি পথচারী বা রাস্তার কোন লাইটপোষ্টকে ধাক্কা দেয় তাহলে তার জন্য শাস্তি বা ক্ষতিপূরণ অনেক বেশি। কারণ, ধরে নেয় হয় সে চালক অপ্রকৃতিস্থ হয়ে গাড়ি চালিয়েছে। এই ধরণের আইনের কঠোরতায় সেখানে মাতাল হয়ে কেউ গাড়ি চালায় না। অথচ আমাদের দেশে চালকরা কেউ মাদক গ্রহণ করলেও সেটা নিরুপণের ব্যবস্থা নেই, সড়ক আ্ইনের কঠোরতাও নেই। উদাসীনতা ও দুর্নীতির বেড়াজালে নিশচার-এর দেয়া ১১১টি সুপারিশ বাস্তবায়নের সম্ভাবনাও ফাইলবন্দী হয়ে আছে। সড়কে দিন দিন বর্ধিত নিরাপত্তাহীনতায় নানা ভয় ও আশঙ্কা যুক্ত হচ্ছে। এসব ভয় ও বেদনার শেষ কোথায়?

আমরা সবকিছু ডিজিটালাইজড করার চেষ্টা করছি কিন্তু এখনও রাস্তার জরুরী অটো সিগন্যাল বাতিকে বাস্তবে কার্যকরী করতে পারিনি। আধুনিক যুগে বাস করে এখনও মানুষের অঙ্গুলি হেলানে রাস্তায় গাড়ি চালানো হচ্ছে। পরিবহন সেক্টরের বারংবার ডাকা নিষ্ফল ধর্মঘট ও ভুল নীতি সবাইকে ভুলুন্ঠিত করে তুলছে। জনরোষ এখন একটি মূখ্য আলোচনার বিষয়। এটা সেই মিথ্যেবাদী রাখাল বালকের বাঘ আসার মিথকে ছাড়িয়ে গেছে।

কারো অদৃশ্য ইশারায় জনভোগান্তি সৃষ্টিকারী এসব নীতি বাস্তবায়িত হতে থাকলে দুর্ঘটনাকারী চালকরা জনরোষের ভয়ে গাড়ি সহ লাপাত্তা হবার চেষ্টা করতেই থাকবে। এভাবে ঢাবির সাবেক একজন শিক্ষকের মতো গাড়ি চালকরাও মানুষের প্রতি দরদ ভুলে জীবনের ভয়ে পালাতে গিয়ে বড় ভুল করে বসবে। এজন্য বার বার একটি ছোট্ট দুর্ঘটনা আরো ভয়ংকর দুর্ঘটনার জন্ম দেবে বৈকি?

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর