বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থা: একান্ত ব্যক্তিগত ভাবনা

, যুক্তিতর্ক

ড. ভূঁইয়া মো. মনোয়ার কবীর | 2023-08-31 13:27:04

কর্তৃপক্ষ তার চরিত্র নিরপেক্ষ হয়ে পাবলিক উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমুহকে একবিংশ শতাব্দীর চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের অনুগামী, সাপোর্টিভ প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে ওঠার প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক কমিটমেন্টসহ তার অনুষঙ্গ অর্থনৈতিক বিনিয়োগ করতে রাজী আছে কি, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি কমিটমেন্ট থাকে, তবে, আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে, সীমিত অভিজ্ঞতায় বলতেই পারি যে, অন্তত ন্যূনতম নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো সরকারকে অবশ্যই নেয়া দরকার।

১. এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমুহকে প্রকৃত অর্থেই যদি Centers of Academic Excellence হিসাবে রূপান্তরিত করতেই হয়, তবে এগুলোকে নিম্নবর্গের তরুণদের ডাম্পিং গ্রাউন্ডে পরিণত না করে অনার্স লেভেলে শিক্ষার্থী ভর্তি যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনতে হবে। প্রকৃত অর্থেই সাধারণ বাংলাদেশী নাগরিকদের সন্তানদের জন্য যথাযথ শিক্ষাদানের অঙ্গীকার থাকতে হবে। আর তা যদি থাকে, তবে এফেক্টিভ শিক্ষা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহকে গড়ে তোলার বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নিতেই হবে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে কোন অবস্থাতেই সাধারণ পরিবারের সন্তানদের মানবেতর জীবনের ও নিম্নমানসম্পন্ন "শিক্ষা"র বৃত্ত/চক্র ব্রেক করার সিদ্ধান্ত ও বাস্তব পদক্ষেপ নিতেই হবে। ক্লাস সাইজ যৌক্তিক পর্যায়ে আনতে হবে। স্টুডেন্টদের আধুনিক শিক্ষার উপকরণাদি ও সুযোগ-সুবিধাদি পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রোভাইড করতে হবে। উন্নত ও মানসম্পন্ন আবাসন ও খাবারের ব্যবস্থা, সহজলভ্য ও উন্নত আরামদায়ক ট্রান্সপোর্ট সুবিধা, উন্নত লাইব্রেরী, কম্পিউটার ফ্যাসিলিটিজ, ইন্টারনেট সংযোগ, উন্নতমানের ও সকল সুযোগসম্পন্ন শ্রেণীকক্ষের ব্যবস্থা, ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।

২. বর্তমানের মাস্টার্স প্রোগ্রামকে নতুনভাবে পুনর্গঠন করতে হবে। ঢেলে সাজাতে হবে। এক্ষেত্রে, বর্তমানের এক বছরের মাস্টার্স প্রোগ্রামকে দুই বছরের বাধ্যতামুলক গবেষণা ভিত্তিক মাস্টার্স প্রোগ্রামে রূপান্তরিত করতে হবে। এক্ষেত্রে, অভিজ্ঞতার আলোকে এটা বলা চলে যে, বর্তমানে প্রচলিত একবৎসরের মাস্টার্স প্রোগ্রাম একটি চরম রকমের ব্যর্থ ব্যবস্থায় পর্যবসিত হয়েছে। যেহেতু, শুধুমাত্র উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকতার চাকরি ব্যতীত আর সকলপ্রকার জবের জন্য চারবছর মেয়াদী ব্যাচেলর ডিগ্রিই সাফিশিয়েন্ট, সেহেতু মাস্টার্স ডিগ্রি প্রোগ্রামটা সীমিত শিক্ষার্থীদের জন্য নির্দিষ্ট থাকা প্রয়োজন। বর্তমানের মতো অনার্স শ্রেণীর সকল শিক্ষার্থীর জন্য ওপেন থাকা নিষ্প্রয়োজন। বরং, এক্ষেত্রে, চারবছর মেয়াদী অনার্স ডিগ্রী অর্জনকারী সকলেই এই মাস্টার্স প্রোগ্রামে আসতে পারবেনা। শুধুমাত্র যাদের অনার্সের সিজিপিএ বিভাগের শিক্ষক নিয়োগের ন্যূনতম সিজিপিএ (উদাহরণ হিসাবে ৩.২৫ বা ৩.৫০ ইত্যাদি) থাকবে, কেবল তারাই মাস্টার্স শ্রেণীতে ভর্তি হতে পারবে। এ ক্ষেত্রে বাহুল্য এমফিল প্রোগ্রাম বিলুপ্ত করতে হবে। দুই বছরের থিসিস সহ মাস্টার্স করে তারা সরাসরি পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি হতে পারবে।

৩. শিক্ষক নিয়োগের শর্তাবলী ও প্রক্রিয়ায় মৌলিক পরিবর্তন আনা জরুরী। এই নিয়োগের নীতিমালায় সৃজনশীলতা আনতে হবে। আমি বা আমরা যখন শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পাই সেই ১৯৮৩ সালে, এখনও সেই মান্ধাতা আমলের নিয়োগ পদ্ধতি বিদ্যমান রয়েছে। এটা কোনভাবেই চলতে পারেনা।  বরং কোথাও কোথাও লিখিত পরীক্ষার নামে প্রক্রিয়াটাকে আরও জটিল ও অবাস্তব করে তোলা হয়েছে।

৪. আমি স্বয়ং একবার একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ বোর্ডে ছিলাম যেখানে লিখিত পরীক্ষার ব্যবস্থা ছিল। সকাল দশটায় আনুমানিক ২০+ প্রার্থীর লিখিত পরীক্ষা নেয়া হলো। দু'ঘন্টার পরীক্ষা। এরপর বোর্ডের চারজন বোর্ড সদস্যের তিনজন সদস্য (ভিসি মহোদয় বাদে) এই খাতাগুলো দেখা শুরু করে শেষ হতে হতে বেজে গেল প্রায় বিকেল পাঁচটা। ফেব্রুয়ারীর মাঝামাঝি সময়। ছোট বেলা। সন্ধ্যা প্রায় হয় হয়। তখন লাঞ্চের ফুরসৎ হলো। ভিসি মহোদয় ততক্ষণে আরেকটি ডিপার্টমেন্টের নিয়োগ বোর্ডের ভাইভা নিচ্ছিলেন। সেটা শেষ হতে হতে বেজে গেল রাত সাড়ে সাতটা। আমরা ভাইভা নিতে শুরু করলাম রাত পৌনে আটটার দিকে। সবারই মৌখিক পরীক্ষা নেয়া হলো। কারণ, লিখিত পরীক্ষায় বাদ দেয়ার সুযোগ ছিল না। এ আরেক বিড়ম্বনা। তো, ডিনারটা স্ন্যাক্স দিয়ে সারা হলো। বোর্ডের রেজ্যুলেশন হতে হতে বেজে গেল রাত আনুমানিক আড়াইটা। আমি গেস্ট হাউজে গেলাম। হাইপেগ্লাসিমা'র পেশেন্ট। সুগার নেমে যাচ্ছিল। মধ্য-ফেব্রুয়ারীর রাত আড়াইটার সময় গেস্ট হাউজে আমার জন্য রাখা হিম-শীতল ভাত আর ততোধিক শীতল লোহার মত শক্ত মাংস ও রুই মাছের টুকরো নিয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে হাজির গেস্ট হাউজের টেবিল বয়। যে শিক্ষক মহোদয় আমার সাথে ছিলেন, তাঁর চেহারায় লজ্জার ছাপ ছিল স্পষ্ট।

৫. যাহোক, কথা হলো, যেখানে প্রার্থী সংখ্যা এত বেশী, সেখানে লিখিত পরীক্ষার আইডিয়াটা অত্যন্ত অবাস্তব। তদুপরি, যেক্ষেত্রে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞ শিক্ষকমন্ডলী পাঁচ বৎসর নানান জাতের পরীক্ষা নিয়েছেন, গ্রেডিং করেছেন, তাঁদের মুল্যায়নেই তো এই প্রার্থীরা ভালো  করেছে, এখন এই ১-২ ঘন্টার পরীক্ষায় কি মেধা যাচাই করা সম্ভব!! জানিনা। আমার সীমিত অভিজ্ঞতায় আমার কাছে অবাস্তব ও অপ্রয়োজনীয় চর্চা মনে হয়েছে। প্রচলিত মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগের যে ত্রুটিগুলো ও দূর্বলতাগুলো আছে, তা রোধ করতে লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগের পদ্ধতি মোটেও কার্যকর নয়।

৫. আসলে, মাস্টার্স প্রোগ্রাম রিস্ট্রাক্চার করার পাশাপাশি শিক্ষক নিয়োগের শর্তাবলী ও পদ্ধতিতেও আমূল পরিবর্তন আনা অত্যাবশ্যক। যোগ্য, দক্ষ, ডেডিকেটেড শিক্ষক পেতে চাইলে নিয়োগের শর্তাবলী ও পদ্ধতিতে পরিবর্তন মাস্ট।

এক্ষেত্রে,

ক.শিক্ষক নিয়োগের ন্যূনতম শর্ত হওয়া উচিৎ:

(১) হয় প্রস্তাবিত দুই বছরের মাস্টার্স ডিগ্রী ও একটি পাবলিকেশন। আর পুরাতন পদ্ধতি অনুযায়ী ন্যূনতম এমফিল ডিগ্রী ও ন্যূনতম একটি পাবলিকেশন, অথবা, বিদেশী সেকেন্ড মাস্টার্স ডিগ্রী ও ন্যূনতম একটি পাবলিকেশন, অথবা দেশী বা বিদেশী পিএইচডি ডিগ্রী। এক্ষেত্রে, অনার্স ডিগ্রীর নীচের (এসএসসি ও এইচএসসি ও সমমানের) ডিগ্রীর জিপিএ দেখা নিরর্থক।

(২) অথবা, বিকল্প হিসাবে, এখানে প্রস্তাবিত পদ্ধতি অনুযায়ী শিক্ষক হবার জন্য দরখাস্ত করার ন্যূনতম শর্ত হওয়া উচিৎ পিএইচডি ডিগ্রী ও ন্যূনতম একটি পাবলিকেশন। প্রথম নিয়োগপ্রাপ্ত পদ হবে সহকারী অধ্যাপক। আমার ব্যক্তিগত প্রেফারেন্স এই বিকল্পের পক্ষে।

খ. সেক্ষেত্রে, মাস্টার্স প্রোগ্রামের শিক্ষার্থীরা বিভাগের শিক্ষকদের প্রয়োজন মোতাবেক গবেষণা সহকারী হিসাবে, এবং পিএইচডি প্রোগ্রামের শিক্ষার্থীরা চিচিং এসিসট্যান্ট হিসাবে ক্লাশ নেবেন অথবা ক্লাশ নেয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষকগণকে সহায়তা করবেন। গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামের শিক্ষার্থীদেরকে অবশ্যই ফুলটাইম রেগুলার স্টুডেন্ট হতেই হবে। তাদের আ্যাসিসটেন্টশীপ দেয়া হবে যৌক্তিক হারে। কোন শিক্ষক তাঁর গবেষণা প্রকল্প থেকেও নিজের জন্য গবেষণা সহকারীকে নিয়োগ ও ফান্ডিং করতে পারেন। ফান্ডিংটা একবৎসর মেয়াদী ও মুল্যায়নের ভিত্তিতে নবায়নযোগ্য। এর ফলে, এই গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামের শিক্ষার্থীদের আর্থিক সাপোর্টের পাশাপাশি তাদের গবেষণা ও শিক্ষকতায় বিশেষ ট্রেনিংও লাভ করা সম্ভব হবে।

গ. এর ফলে, শিক্ষক হিসাবে যারা নিয়োগ পাবেন, তাঁরা ইতিমধ্যেই গবেষণা, শিক্ষকতা ও পাবলিকেশনের ব্যাপারে অভিজ্ঞ হবেন। ফলে, বর্তমানে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মত তাদেরকে on job training প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কয়েক বছর যেতে হবেনা। শুরু থেকেই এ প্রস্তাবিত নিয়োগ পদ্ধতি অনুযায়ী নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকেরা পুরোপুরি সার্ভিস দিতে পারবেন। তখন তাদের প্রমোশানের শর্তাবলী আরো কিছুটা চ্যালেন্জিং করলেও তারা সেটা মোকাবিলায় সক্ষম হবেন। এতে, সার্বিকভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে গবেষণার সংখ্যা, গুণ ও মান বৃদ্ধি পাবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

ঘ. ফলে, একাধারে দক্ষ, প্রশিক্ষিত ও শিক্ষকতার প্রতি কমিটেড শিক্ষক পাওয়া বহুলাংশে নিশ্চিত হবে। কারণ, চলতি পদ্ধতি অনুযায়ী, একজন স্টুডেন্টের রেজাল্ট ভালো হলেই তার নিয়োগপ্রাপ্তির সম্ভাবনা তৈরী হয়ে যায় যদিও ওই পর্যায়ে তিনি নিশ্চিত থাকেননা যে, তিনি শিক্ষকতাকে ক্যারিয়ার হিসাবে প্রেফার করেন কি-না। হয়তোবা "আয়েশী" চাকরি হিসাবে শিক্ষকতায় যোগ দিতে চান, যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার দাবী ও কমিটমেন্ট সম্পর্কে তাঁর তেমন কোন ধারণাই ডেভেলপ করেনি। নিয়োগদাতাদের রাজনৈতিক-আদর্শিক তরিকা, "সঠিক" আঞ্চলিক ম্যাচ, যারা নিয়োগে ম্যাটার করে, তাদের সাথে গুড" কানেকশন, তদ্বীর ঠিকঠাক মিলে গেলেই শিক্ষকতার "চাকরি" পাওয়া নিশ্চিত হয়ে যেতে পারে। এই প্রক্রিয়া একজন ভালো স্টুডেন্ট হয়তো পাওয়া যেতেও পারে, কিন্তু ভালো শিক্ষক যে পাওয়া যাবে,তা নিশ্চিত করেনা। বরং, ভালো স্টুডেন্টটির হয়তো চাকরি দরকার, তাই "আরামে"র চাকরি  হিসাবেই শিক্ষকতাকে নেয়, অথবা এটা আগে পাওয়া গিয়েছে, তাই শিক্ষক হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু শিক্ষক হবার আগ্রহ বা কমিটমেন্ট তার নাও থাকতে পারে।

ঙ. ফলে, এঁরা কখনোই নিজেদেরকে শিক্ষক হিসাবে গড়ে তোলায় আগ্রহী হননা। তাদের একাংশ যদি আয়েশী হয়, আরেক অংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরেই ক্ষমতা অর্জনের পিছনে ছুটেন। আর এ ব্যাপারে মুরুব্বী বা মেন্টর পাওয়া মোটেও কোন দুষ্কর বিষয় না। প্রক্টরিয়াল বডিতে কাজ করা, হল প্রশাসনে কাজ করা, বিভিন্ন কমিটিতে কাজ করা তাদের নিকট বেশী থ্রিলিং মনে হয়। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের পদোন্নতির শিথিল শর্তের ফলে বিভিন্ন উপায়ে পদোন্নতির জন্য ন্যূনতম পাবলিকেশন "করে" বা "ম্যনেজ" করে পদোন্নতি "সঠিক" সময়ে পাওয়া যায় বিধায় একাডেমীক ডিভোশনের দিকে না গিয়ে অন্য কাজ করলেও কোন সমস্যা হয়না। আর "দল" তো আছেই। সংশ্লিষ্ট দলের এমন "ইমারজিং", "প্রমিজিং" "নেতা" দের প্রমোশন নিশ্চিত করতে। ফলে, বর্তমান নিয়োগ পদ্ধতিতে ও শর্তে ভালো শিক্ষক, গবেষক পাওয়ার অকারণ আশা হাস্যকর ছাড়া আর কিছুই না। তারপরও যদি কালেভদ্রে এক-আধটা পাওয়া যায়, তবে তা ব্যতিক্রম। ব্যতিক্রম দিয়ে একটা সিস্টেম প্রোপারলি চলতে পারেনা। এঁরা ক্রমেই বিরল প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ছেন।

চ. ভালো শিক্ষক ও গবেষক আপনা-আপনি পাওয়ার যুগ শেষ। সেদিন গত হয়েছে, যখন মনে করা হতো, স্বরস্বতী লক্ষী'র উপর প্রাধান্য বিস্তার করবে। মাষ্টার খাক বা না খাক, সে নিবেদিতপ্রাণভাবে মাষ্টারী করবেই। আসলে, এধরণের পারসেপশান একটা শিক্ষক শোষণমূলক আইডিওলজি, যা আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার দৈন্যের অন্যতম বড় কারণ। শিক্ষক শোষণমূলক শিক্ষাদর্শণ কখনোই ভালো শিক্ষক ও উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা প্রোডিউস করতে পারেনা। এই বিষয়ে আমাদের সমাজের ও নীতিনির্ধারকদের চিন্তার ও বোধের ক্ষেত্রে একটা ব্যাপক "প্যারাডাইম শিফট" (Paradigm Shift) অপরিহার্য। এটা মানতে হবে যে, শিক্ষকদের জীবনযাত্রা কম কমফোর্টেবল রেখে তাদের কাছ থেকে বেশী বেশী দাবী করা যায়না। কোনদিনও সেটা হবেনা। আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথেও যদি তুলনা করা হয়, দেখা যাবে, বেতন, ভাতা, সুবিধাদির ক্ষেত্রে  অন্য দেশগুলোর তুলনায় আমরা কি নিদারুণভাবে পিছিয়ে আছি।

ছ. অনেকেই মনে করেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ ক্লাশ নেন না, কোন কাজ করেন না, কেবল বসে বসে বেতন খান, আর দলবাজি, রাজনীতি করেন। লাল, নীল, সাদা, হলুদ, গোলাপী "দল" করেন। দলমন্য শিক্ষকেরা দলবাজী করেন। হ্যাঁ, একটা অংশ শিক্ষক নিশ্চয়ই তেমন আছেন। এ প্রসঙ্গে বলতে দ্বিধা নেই যে, আমিও আমার দৃষ্টভঙ্গীর সাথে সামন্জস্যপূর্ণ শিক্ষক গ্রুপের সঙ্গে কখনো বেশী সক্রিয়ভাবে, কখনো কম সক্রিয়ভাবে, কখনোবা প্রায় নিষ্ক্রিয়ভাবে সেই গ্রুপের সাথে সেই শিক্ষকতা জীবনের শুরুর দিন থেকেই জড়িত আছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ শিক্ষার মান এখনও যুক্তিসাপেক্ষে (arguably) অনেক উন্নত। সেখানেও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ভিতর ডেমোক্র্যাট-রপাবলিকান ডিভিশন স্পষ্ট। দলীয় কারণ কোন কোন ক্ষেত্রে স্থায়ীকরণ না হওয়ার ও ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে চাকরি চলে যাওয়ার ব্যাপারে কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখে। আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন Thomas Vogy. তিনি সক্রিয় শিক্ষকতা করা অবস্থায় Tucson সিটির দলীয় টিকিটে নির্বাচিত মেয়র ছিলেন। আর রাজনীতি বিজ্ঞানের ছাত্র হিসাবে শিখেছি রাজনীতির সর্বব্যাপ্তির বাস্তবতা। ফলে, আমি আপনি চাই বা না চাই, রাজনীতি থাকবেই। আসল কথা হলো, কিভাবে রাজনীতির স্খলন ও তার স্খলিত প্রভাব পাবলিক  বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক এনভায়রনমেন্ট ও মানকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে। কিছু শিক্ষক আছেন, যাঁরা প্রকাশ্যে দল না করলেও কোন না কোন মতের দৃঢ় সমর্থক, বা অন্য কোন একটা মতের কঠিন বিরোধী। বলা চলে, বিদ্বেষী। তাঁরা নিজেদেরকে আপাতঃইনোসেন্ট "বর্ণহীন" বলতে পছন্দ করলেও তাদের কেউ কেউ আসলে "বর্ণহীনে"র আড়ালে "বর্ণচোরা" বলে মনে হয়। এঁদেরকে আমার কাছে  রাজনীতি করা অনেকের চেয়ে বেশী সমস্যাপূর্ণ বলে মনে হয়। তবে, বেশীরভাগ শিক্ষকই এখনও তাঁদের দায়িত্ব পালনে আন্তরিক। তারপরও যদি রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব থেকে একাডেমিক এনভায়রনমেন্ট ও মানকে বিযুক্ত করার জন্য ১৯৭৩ সালের অর্ডিন্যান্সের কোন দিককে রিভিউ করা প্রয়োজন মনে হয়, সেটাও বিবেচনা করতে কোন সমস্যা থাকা উচিৎ নয়।

জ. আচ্ছা, আপনিই বলুন তো, একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের দায়িত্ব কি? আপনি সরলভাবেই বলবেন, "কেন, ঠিকমতো ক্লাস নেয়া ও সে সাথে গবেষনা তথা জ্ঞান দান করা ও জ্ঞান সৃষ্টি করা"। জ্বী, আপনি একদম ঠিক বলেছেন। কিন্ত, আপনি জানেন কি, একজন শিক্ষককে এই দুটি কাজের বাইরে আরো কি কি কাজ করতে হয়? গড়পড়তা ৩৬-৪০ পৃষ্ঠার ১২৫-১৫০ টি বা কখনো কখনো তারও বেশী খাতা একটা ইয়ারের একটি কোর্সের জন্য গ্রেডিং করতে হয়। বছরে প্রায় তিনটে, কোন কোন ক্ষেত্রে, আরো বেশী কোর্সের খাতা গ্রেডিং করতে হয়, টিউটোরিয়াল ক্লাস, পরীক্ষা নিতে হয়, উপস্থিতি ক্যালকুলেট করতে হয়, পরীক্ষা কমিটির কাজ করতে হয়, প্রশ্ন লিখতে, ও ফটোকপি করতে হয়, পরীক্ষার ডিউটি দিতে হয়, বিশাল বিশাল টেবুলশান শীট নিয়ে দিনরাত কাজ করতে হয়, মার্কশীট লিখতে হয়, কারেকশান করতে হয়। এই কাজগুলো কি শিক্ষকের দায়িত্বের মধ্যে পড়ার কথা!! অনেককে আবার প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতে হয়। বলতে পারেন, সবাইকে তো আর করতে হয়না। কথা ঠিক। কিন্তু, কাউকে না কাউকে তো অবশ্যই করতে হবে। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধান মতে, এ কাজগুলো অবশ্যই শিক্ষকদের দ্বারাই সম্পন্ন হতে হবে। এরপর আপনি চাইবেন, ক্লান্ত মন-শরীর নিয়ে, খিটখিটে মেজাজ নিয়ে, "নুন আনতে পান্তা ফুরায়" মাষ্টার সুপারম্যানের মতো ফান্ডিং ছাড়াই দেনা করে, বা পৈতৃক সম্পত্তি ব্যয় করে গবেষণা করবেন, জ্ঞান সৃষ্টি করবেন!! অবশ্য, তেমন "পাগল"ও কিছু নাই যে, তা নয়। এমন গুটিকয়েক "পাগল" দিয়ে তো আর সবকিছু হবেনা।

ঝ. অতএব, শিক্ষকদের বেতন-ভাতা, গবেষণা সুবিধাদী,  উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানো আবশ্যক। এক্ষেত্রে, আমি বলতে চাই যে, এই বৃদ্ধি প্রাথমিক শিক্ষক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক পর্যন্ত সকল পর্যায়ে হতে হবে। প্রয়োজনে শিক্ষকদের আলাদা বেতনস্কেল থাকতে হবে। শিক্ষায় বিনিয়োগ কয়েকগুন বৃদ্ধি করতে হবে, সংস্কার করতে হবে, জবাবদিহিতা তখন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। ইউনেস্কো সম্ভবতঃ শিক্ষাখাতে বরাদ্দ জিডিপির ৬% হওয়া উচিৎ বলে হিসাব করেছে, আমি মনে করি, এই বরাদ্দ ১০% এর কম হওয়া উচিৎ না।

ঞ. শিক্ষকদের কাজের চাপ বাড়িয়ে কিছু হবেনা, যদি না শিক্ষকতার পেশাটা তাদের জন্য রিওয়ার্ডিং হয়; বৈষয়িক ভাবে ও মানসিক ভাবে। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার কোন উন্নতি অসম্ভব শিক্ষকদের জীবনমান, মর্যাদা, গবেষণার সুযোগ সুবিধা না দিয়ে শিক্ষক- শিক্ষার্থীদের উপর বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য হারে না বাড়িয়ে এটা সেটা করে, IQAC র মাধ্যমে তেমন দীর্ঘমেয়াদী কোন সাফল্য আসবেনা বলে আমি মনে করি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর