কাদের যেন এরশাদেরই ‘ছায়া’!

, যুক্তিতর্ক

কবির য়াহমদ | 2023-08-30 03:25:16

সংসদের আনুষ্ঠানিক প্রধান বিরোধীদল জাতীয় পার্টি। পার্টির নেতৃত্বে এরশাদের ভাই গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদের। এখনও অখণ্ড থাকলেও এই দলে আবার আরেক গ্রুপ নিয়ে আছেন এরশাদপত্নী বেগম রওশন এরশাদ। তিনি আবার সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রী। সাম্প্রতিক সময়ে এ দু’জনের দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে ওঠেছে। রওশন এরশাদ যেখানে সরকার-দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকতে চান সেখানে জিএম কাদের চান সরকারবিরোধী বলয়ে যেতে। এনিয়ে দলেও আছে বিভক্তি। পার্টির মহাসচিবকে অব্যাহতি দিয়েছেন চেয়ারম্যান। অব্যাহতি পাওয়া মহাসচিব বাইরে থেকে ফুঁসছেন, বক্রোক্তি করেছেন চেয়ারম্যানকে নিয়েও।

স্বৈরশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ তার জীবদ্দশায় এক রাজনৈতিক কৌতুক-চরিত্রে পরিণত হয়েছিলেন। স্বৈরতান্ত্রিক রাজনৈতিক দর্শনের কারণে তার দলটিও একই চরিত্রের। এরশাদই ছিলেন একমাত্র নেতা দলটির, যদিও প্রায় একই চরিত্রের অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোও। এরশাদের দলটি আবার ভিন্ন চরিত্রের। আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রথমে জোট গড়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল; সংসদে বিরোধীদল আবার সরকারের মন্ত্রিসভার অংশও হয়েছিল। এরশাদ আমৃত্যু ছিলে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত, যদিও এ বিশেষ দূতের কী কাজ ছিল সেটা যেমন ওই দূতই জানতেন না, তেমনি জানার সুযোগ ছিল না দেশবাসীরও। এবার অবশ্য সংসদে বিরোধীদল হলেও তারা সরকারের অংশ হয়নি। গত নির্বাচনের আগে যখনই এরশাদ সরকারবিরোধী কথা বলেছেন তখনই অসুস্থ হয়ে সিএমএইচে ভর্তি হয়েছেন। এছাড়া ছিল সকালে এক কথা, দুপুরে আরেক; বিকালে যদি অন্য কথা বলেন, রাতে বলতেন তার উলটো কথা! এতে করে তাকে বিশ্বাস করার সুযোগ হয়নি কারও।

আওয়ামী লীগের জ্বালানিতে জাতীয় পার্টির টিকে থাকা বলে রাজনৈতিক মহলে যে আলোচনা আছে সেটা মিথ্যা নয়। এককভাবে নির্বাচন করে কোন সংসদীয় আসন থেকে তাদের বিজয়ী হওয়ার জনসমর্থন নাই। দেশের নানা প্রান্তে ছটিয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু ভোট আছে তাদের সত্য, কিন্তু এটা সংসদে বিরোধীদল হওয়ার মতো আসনে জয়লাভের জন্যে যথেষ্ট নয়। সবশেষ নির্বাচনেও জাতীয় পার্টি যেখানে প্রার্থী দিয়েছে সেখানে আওয়ামী লীগ ছাড় দিয়েছে। এ কারণে কয়েকজন সদস্য হতে পেরেছেন সংসদের। আওয়ামী লীগের বদান্যতায় জাতীয় পার্টির এই রাজনীতিতে অনেকেই দলটিকে গৃহপালিত বিরোধীদল আখ্যা দিয়েও থাকেন। জীবদ্দশায় এরশাদ এটা শুনে গেছেন। তার মৃত্যুর পর দলের কিছু নেতার বক্তব্যে এই গৃহপালিত তকমায় কিছুটা হলেও অপমান বোধ হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। ক্ষীণ স্বরে হলেও অন্তত তাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে ক্রমে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠছে।

কিছুদিন ধরে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের বক্তব্যে সরকারবিরোধী সুর লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এটা দলীয় অবস্থান, নাকি সরকারের সঙ্গে দর কষাকষির মাঠ তৈরির পরিকল্পনায়; এটা এখনও স্পষ্ট নয়। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রওশন এরশাদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব। রওশন যেখানে বিনাপ্রশ্নে সরকারপন্থী বলয়ে থাকতে আগ্রহী, যেখানে জিএম কাদেরের অবস্থান আপাতত ভিন্ন। যদিও তিনি দলকে নিয়ে সরকারবিরোধী কোন জোটে অংশ নেওয়ার আগ্রহ এখনও প্রকাশ করেননি। দলটির মধ্যে অস্বস্তিকর একটা পরিবেশ বিরাজ করছে। সামনে আসার অপেক্ষায় আছেন এরশাদের আরেক স্ত্রী বিদিশা এরশাদ।

এরই মধ্যে জিএম কাদের সংসদে যাবেন না বলে একবার একটা বক্তব্য দিয়েছেন। কিন্তু পর পরই জানা গেল তারা সংসদে যাচ্ছেন। এখানে স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরীর স্বপ্রণোদিত ভূমিকা রয়েছে। অথচ যখন সংসদে যাবে না বলে জানাচ্ছিল জাতীয় পার্টি, তখন সংসদের কাছে আনুষ্ঠানিক তথ্য থাকার কথা ছিল না, স্পিকার তবু ব্যবস্থা নিয়েছেন। জাতীয় পার্টি সঙ্গে সঙ্গে সংসদে যেতে রাজি হয়েছে। নির্বাচনের এক বছর আগে দলটির আসন ভাগাভাগি বিষয়ক কৌশলী রাজনীতির অংশ হয়তো এটা। কারণ জিএম কাদের ভালো করেই জানেন এককভাবে প্রার্থী দিয়ে সারাদেশ থেকে একটি আসনেও জেতার প্রয়োজনীয় জনসমর্থন তাদের নেই। এরশাদ অন্তত নিজেদের আসনে জেতার সামর্থ্য রাখলেও কাদেরসহ দলের অন্য কারও সেটা নেই। এখানে তাই দরকার কারও সঙ্গে বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি অথবা সমর্থন।

দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত বেগম খালেদা জিয়া সরকারের বদান্যতায় কারাগারে না থেকে নিজ গৃহে অবস্থান করলেও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আদালতের দৃষ্টিতে পলাতক, লন্ডনে আশ্রিত। মাঠের রাজনীতির মূল নেতৃত্বই যেখানে মাঠছাড়া সেখানে দলটিও চলছে কোনোমতে জোড়াতালি দিয়ে। তার ওপর আছে রাজনৈতিক নিপীড়ন, মামলা, হামলা, মামলার ভয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিভাগে-বিভাগে বিএনপি মহাসমাবেশ করছে, সেসব জায়গায় দলটির নেতাকর্মীর উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে ঠিক, কিন্তু নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে সরকারকে বাধ্য করার মতো রাজনৈতিক কর্মসূচি দেওয়া ও বাস্তবায়নের অবস্থায় নেই। বিএনপির মাঠের রাজনীতিতে ফেরার ইঙ্গিতের সময়ে জাতীয় পার্টি ও জিএম কাদের ভালো করেই জানেন নির্দলীয় সরকার ফেরার সম্ভাবনা দেশে নাই। তিনি যতই সরকারবিরোধী বক্তব্য দিন না কেন দিনশেষে তিনিও জানেন তার একমাত্র আশ্রয় এখনও সরকার-দল আওয়ামী লীগ; এবং আওয়ামী লীগের বাইরে আর কারও সঙ্গে জোট করে নির্বাচন অথবা এককভাবে নির্বাচন করলে তিনি নিজেসহ দলের কেউই জিততে পারবে না। ফলে ক্রমে মূল্যহীন হয়ে পড়া দলকে তিনি আওয়ামী লীগের কাছে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার চেষ্টা করছেন। সংসদে যাচ্ছি না বলেও সংসদে গেছেন, একইভাবে বাইরে সরকারবিরোধী অবস্থান নিলেও ভেতরে ভেতরে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ডাক পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন।

রাজনৈতিক ভাবাদর্শের দিক থেকে এরশাদ জাতীয় পার্টিকে যেখানে রেখে গেছেন সেখানেই আছেন জিএম কাদেরও। মাঝেমাঝে চলে যাচ্ছি বলে হুমকি-ধমকি দিয়ে তিনি গুরুত্ব বাড়াতে চাইছেন। ভাবছেন চলে যাওয়ার হুমকিতে তাকে নিয়ে আগ্রহী হবে আওয়ামী লীগ-বিএনপি। দুই দলের রশি টানাটানি হবে তাকে নিয়ে। তিনি একবার ঝুলবেন এদিকে, আরেকবার ওদিকে; এবং দিনশেষে আওয়ামী লীগের সঙ্গেই নির্বাচনে অংশ নেবেন বলে ধারণা করা যাচ্ছে।

জিএম কাদের যা করছেন, এরশাদও আগে তাই করতেন। কাদের যেন এরশাদেরই ‘ছায়া’। এরশাদ যখন খুব বেশি উলটাপালটা করতেন তখন দেখা যেত তাকে সিএমএইচে। ঘন ঘন সিএমএইচ গমনের বিষয়টিকে শারীরিক অসুস্থতা হিসেবে আমরা দেখতে আগ্রহী হলেও রাজনৈতিক মহলে অবশ্য ভিন্ন আলোচনা ছিল, যদিও সেটা অপ্রমাণিত; তাই ওদিকে যাচ্ছি না। জিএম কাদের এবং জাতীয় পার্টি কোন দিকে যায় সেটা ভবিষ্যতই বলবে। তবে এখানে আরেকটা ব্যাপার এরশাদ যেখানে তার দলে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন সেখানে জিএম কাদের দলের মধ্যেই আছেন প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। অবস্থা যদি টালমাটাল হয় তবে আরেকবার দেখা যেতে পারে ভাঙন!

নির্বাচন সামনে এলেই জাতীয় পার্টির মধ্যে অস্থিরতা দেখা দেওয়ার অভ্যাস বেশ পুরনো। তিন/চার বছর সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে নির্বাচনের কাছাকাছি সময়ে এই যাচ্ছি-যাচ্ছি বলে রব তুলে তারা। এরশাদ এটা করতেন, জিএম কাদের ভাইয়ের পথ অনুসরণ করছেন। দিনশেষে এটা হয়তো কৌশল। এই কৌশলে তারা নির্বাচনে আসন ভাগাভাগি প্রশ্নে বাজিমাৎ করতে চায়। আগেও করেছে। এরশাদ যত আসন নিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের কাছ থেকে, জিএম কাদের তারচেয়ে বেশি আসন অথবা অন্তত ততসংখ্যক আসনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন। কাদের-রওশনের দ্বন্দ্ব, বহিষ্কার -বহিষ্কার খেলা মূলত অভ্যন্তরীণ আধিপত্য বিস্তারের, যার পথ ধরে দলটির লক্ষ্য নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি। জিএম কাদের কি সফল হবেন, উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছুদিন!

কবির য়াহমদ: সাংবাদিক, কলাম লেখক, ইমেইল: kabiraahmed007@gmail.com

এ সম্পর্কিত আরও খবর