বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থা

, যুক্তিতর্ক

ড. ভূঁইয়া মো. মনোয়ার কবীর | 2023-09-01 17:00:45

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা সমালোচনার কোন কমতি নাই। এক্সপেরিমেন্টেও কম হয়নি। বিশেষ করে ইদানীং/হালফিল আমলে বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষা নিয়ে বেশ ডামাডোলের সৃষ্টি হয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীদের একটা অংশ, কিছু শিক্ষক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, মূলধারার গণমাধ্যম, সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ, সুশীল সমাজের বিদগ্ধজনেরা, ও বিশেষ করে আমলাগণ বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা নিয়ে গঠনমূলক সমালোচনা থেকে শুরু করে, কটাক্ষ, হেয় প্রতিপন্ন, তুচ্ছতাচ্ছিল্য, ও নির্মম ও নিষ্ঠুর সমালোচনা করছেন।

এইসব নানামুখী ঢালাও কথাবার্তা শুনে মনে হয়, আমাদের উচ্চ শিক্ষার সবটাই শেষ। অথচ এই সমালোচকদের প্রায় সবাই যে আমাদের দেশের প্রচলিত উচ্চ শিক্ষাব্যাস্থারই প্রোডাক্ট, সে কথাটা ওনারা বোধহয় ভুলে যান, বা ভুলে যেতে চান। কিংবা বলতে চান যে, বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত না হলেও তারা বিজ্ঞ হতেন। অর্থাৎ, তাঁদের জীবনে বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষার তেমন কোন বিশেষ ভূমিকা নাই।

এটা অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশের পাবলিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সমস্যা আছে ও তা প্রকট। এগুলোর সমাধানের সময় ও কিছু সুযোগ অনেক আগেই অতিক্রান্ত হয়ে গেছে, তবে এখনও সব শেষ হয়ে যায়নি। এখনও সময় আছে পাবলিক উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কার করার। আর সেজন্য সুসমন্বিত পন্থায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাথমিক থেকে প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় পর্ব পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কার নিয়ে সংশ্লিষ্ট সকলের মধ্যে উচ্চশিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে পারসেপশানের বা চিন্তার ক্ষেত্রে একটা paradigmatic shift আনতেই হবে।

বিক্ষিপ্তভাবে শিক্ষক, ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি, দলীয় প্রভাবে নিয়োগ, ইত্যাদির সমালোচনা করে ও এগুলোর ফয়সালা প্রত্যাশা করে আমাদের উচ্চ শিক্ষার পচন রোধ করা যাবেনা। সমস্যা অনেক গভীর, তাই অগভীর, তাৎক্ষণিক সমাধান বা quick fix না খুঁজে কঠিন বাস্তবতাকে স্বীকার করে এর বাস্তবসম্মত ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সমাধানের দিকে আমাদের সবাইকেই মনোযোগ দিতে হবে ও জোর উদ্যোগ নিতে হবে।

একজন নাগরিক হিসাবে রাষ্ট্রের ও জাতির ভালো মন্দ বিষয়ে মতপ্রকাশের অধিকার প্রত্যেকেরই আছে। সে হিসেবে, সমালোচকদের সমালোচনা ও মতামত ধৈর্যের সাথে, মনোযোগ সহকারে শোনা ও বোঝা, ও সেগুলোর যৌক্তিকতা ও অযৌক্তিকতা অনুধাবন করা ও উত্তর প্রদান করা যেতে পারে। প্রয়োজনে সেগুলোর সমাধানের পথে সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেয়া দরকার হতে পারে।

ব্যক্তিগতভাবে আমি কোন নীতিনির্ধারক নই, নীতিনির্ধারণী কোন পর্ষদের সদস্য নই। নির্বাচিত কোন পর্ষদের সদস্যও আমি নই। আমি মোটামুটি একটা লম্বা সময় ধরে (১৯৮৩ সালের জুলাই মাস থেকে) দেশের একটি পুরনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়) রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষক হিসাবে কর্মরত আছি। স্বাভাবিক অবস্থায় ২০২৫ সালের অক্টোবর মাসে অবসরে (এলপিআরে) যাওয়ার কথা।

আমার মনে হয়েছে যে, আমাদের দেশের উচ্চ শিক্ষা নিয়ে উত্থাপিত নানা বিষয় নিয়ে আমার ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ও এলোমেলো অসংগঠিত কিছু কথা, কিছু আইডিয়া এখানে তুলে ধরি। প্রথমেই বলে রাখা দরকার যে, এটা কোন মেথোডিক্যাল, সিস্টেমেটিক গবেষনা পত্র নয়। এটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত আইডিয়ার অগোছালো  উপস্থাপন মাত্র।

উচ্চশিক্ষার সঙ্কট আসলে আমাদের সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্কট

আমাদের দেশের উচ্চ শিক্ষার সমস্যা বা সংকট আসলে আমাদের দেশের ছত্রখান সার্বিক শিক্ষা (অ)ব্যবস্থার সাথে ওতপ্রোতোভাবে জড়িত। সেখানে যা হচ্ছে বা হচ্ছে না, তার দ্বারা আমাদের উচ্চশিক্ষা সরাসরি প্রভাবিত হচ্ছে।

আমাদের দেশের প্রায় সব শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা বিশেষজ্ঞগণ বহুদিন ধরেই বলছেন যে, প্রাথমিক পর্যায় থেকেই আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নোংরা রকমের বহুধারায় বিভক্ত। এই বিভক্তি আবার পরিষ্কার ও মোটাদাগে বাংলাদেশের শ্রেণি বিভাজন, আঞ্চলিক (গ্রামীণ-মফস্বল-নগর) বিভাজন ও সামান্য আকারে হলেও আদর্শিক বিভাজনের প্রতিফলন বা রিফ্লেকশন ঘটায়।

বিভিন্ন ধারার শিক্ষা কার্যক্রম

কওমি শিক্ষা ধারা: কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক শিক্ষার ধারাটি, বিরল কিছু সাম্প্রতিক ব্যতিক্রম বাদে, হলো দরিদ্র ও হতদরিদ্র শ্রেণির সন্তানদের কিছু একটা লেখা পড়া শেখার একমাত্র মাধ্যম। এখানে সামান্য নামমাত্র বাংলা, ইংরেজি, অংক শেখানো হলেও মুলতঃ এখানে ধর্মীয় টেক্সট শেখানো, অর্থাৎ মুখস্থ করানো হয়। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ স্বীয় চেষ্টায় আরও বেশি পাঠের মাধ্যমে হয়তোবা মোটামুটি মানের ধর্মবেত্তা হন। তবে, বেশিরভাগই মোটামুটি চলনসই মানের দোয়া খায়ের, মাসলা মাসায়েল, শরীয়ার এলিমেন্টারী বিষয়গুলো ও বিভিন্ন স্যোসাল ইস্যু সংক্রান্ত ফতোয়া রপ্ত করেন। এঁরা এগুলোকেই জীবন জীবিকার মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করেন। পেশা হিসাবে এঁদের বিরাট বিপুল অংশই মসজিদের খাদেম, মুয়াজ্জিন, ইমাম সাহেব হিসাবে নিয়োজিত হন। আরেকটি অংশ মাদ্রাসার শিক্ষক হিসাবে নিয়োজিত হন। এঁরা অনেকেই আবার খুবই কম টাকায় প্রাইভেট টিউশানি করেন। অর্থাৎ, বাসায় বাসায় কায়দা, ছিবারা, কোরআন শিক্ষা প্রদান করেন।

এঁদের মধ্যে খুবই নগন্য একটা অংশ বিভিন্নভাবে নিম্নমানের অন্যান্য পেশাগত দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত হন।

একটু যারা মেধাবী বলে পরিচিতি পান অথবা/এবং আর্থিক সক্ষমতাসম্পন্ন, তারা কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষা শেষে সাধারণ ধারায় এসএসসি এইচএসসি পাশ করে জেনারেল লাইনে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। এঁদের উল্লেখযোগ্য অংশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজগুলোতে পড়লেও ক্ষুদ্র একটি অংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশীরভাগ শিক্ষক ও প্রশাসনের একটা উল্লেখযোগ্য অংশের মধ্যে এঁদের প্রতি যে উন্নাসিকতা ও অবহেলার প্রবনতা আছে, সেটা অস্বীকার করা যাবেনা। প্রাইভেটলি, এমনকি কখনো কখনো, পাবলিকলিও এঁদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অযোগ্য মন করেণ অনেক শিক্ষকই। কারণ, তাঁরা নাকি যথেষ্ট "উদার" "আধুনিক" নন।

এই ধারায় পড়াশোনা করা ছেলেমেয়েরা বেশীরভাগই গরীব। বেশীরভাগই এতটাই গরীব যে, মাদ্রাসা-সম্পৃক্ত এতিমখানায় তিন বেলা আহারের সংস্থান হবে বলেই অসহায়, অক্ষম অভিভাবকগণ সন্তানদেরকে কওমি মাদ্রাসায় "পড়াতে দিয়ে আসতে" বাধ্য হন। এখন প্রবণতাটা কিছুটা হ্রাস পেলেও একসময় মুষ্টির চাল তুলে, রেল স্টেশনে, লঞ্চ ঘাটে, বাস ষ্ট্যান্ডে, বাজার গন্জে কওমি মাদ্রাসার এসব ছাত্রদেরকে সাহায্য তুলতে দেখা যেত। এছাড়াও, কোরবানীর ঈদের সময় গরু খাসীর চামড়া সংগ্রহ করতেও দেখা যেত মাদ্রাসা ছাত্রদেরকে। অনেক পরিশীলিত গণ্যমান্য বিদগ্ধ ব্যক্তি এটার বিভিন্ন সমালোচনায় সরব থাকতেন; এখনও আছেন। অবশ্য, এভাবেই তারা তাদের ব্যয়ের বেশীরভাগ অংশই সংগ্রহ করত।

এই কওমি ধারার এমন গ্র্যাজুয়েটগন/হুজুরগণের আর্থিক ভিত্তি নড়বড়ে ও দুর্বল হওয়াতে খুব সহজেই স্থানীয় সমাজপতিদের নানান অন্যায় ও বেঠিক কাজ ফতোয়ার মাধ্যমে জায়েজ করার কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকেন। এঁরা প্রকারান্তরে স্থানীয় ক্ষমতা কাঠামোর সাপোর্টিভ কিন্ত সাবর্ডিনেট ও সহায়ক পক্ষ হিসাবে কাজ করে থাকে। নিজ থেকে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা এঁদের নেই বললেই চলে।

আফগানিস্তানে ১৯৭০-৯০ এর দশক থেকে এই ধারার বিরূদ্ধে ইসলামী জঙ্গীবাদ ছড়ানোর অভিযোগ ব্যাপক হয়েছে। বিশেষ করে সেক্যুলারপন্থী সরকার ও সংবাদমাধ্যমগুলো কর্তৃক। কিন্তু পুলিশের তথ্য এই অভিযোগের পক্ষে জোরালোভাবে বলেনা।

আলিয়া মাদ্রাসা ভিত্তিক শিক্ষা ধারা

আলিয়া মাদ্রাসা ধারা হলো ইসলামী শিক্ষার আরেকটি ধারা। একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা। আলিয়া মাদ্রাসা ব্যবস্থা সরকারী রুলস রেগুলেশন কারিকুলাম অনুযায়ী পরিচালিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এর কার্যক্রম পরিচালিত হয়। কওমির মত এটা কমিউনিটি ফান্ডিং বা চ্যারিটির দ্বারা চলেনা। এই আলিয়া মাদ্রাসাগুলোর গোটা তিনেক সরকারী আলিয়া হলেও বাকীগুলোর অনেকগুলোই সরকারী এমপিওভুক্ত। অর্থাৎ, এই প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতনের একটা অংশ সরকার প্রদান করে থাকে।

এই প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষাকারিকুলাম অদ্ভুত মনে হয়। এটার কারিকুলাম আধুনিক অ-ধর্মীয় ও ধর্মীয় শিক্ষার একটা অদ্ভুত মিশ্রণ যেখানে ধর্মীয় অংশটা অতোটা গভীরভাবে অধ্যয়ন করানো হয়না। আবার আধুনিক অ-ধর্মীয় অংশটাকেও পূর্ণাঙ্গভাবে অধ্যয়ন করানোতে রীতিমতো ঘাটতি থেকে যায়। এখানেও মূলতঃ দরিদ্র, নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা ও ধর্মীয় ভাবধারাসম্পন্ন পরিবারের সন্তানেরা পড়াশোনা করে থাকে।

ফলতঃ এখানকার গ্র্যাজুয়েটগণ না হন ধর্ম বিষয়ে বিশদ জ্ঞানের অধিকারী, না হন অ-ধর্মীয়/আধুনিক শিক্ষায় পারদর্শী। এখানকার আলিম ডিগ্রীটা এইচএসসি ডিগ্রীর সমতুল্য গণ্য করা হয়। ফলে, আলিয়া মাদ্রাসা থেকে পাশ করা ছাত্র ছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার জন্য ভর্তি পরীক্ষায় অংশ গ্রহন করে ও ভর্তি হয়। এখানে জটিলতা দেখা দেয় সেক্যুলার ধারার সঙ্গে এই ধারার। অনেক সেক্যুলার শিক্ষক, ছাত্র, শিক্ষাবিদ মনে করেন যে আধুনিকমনস্ক নয় বিধায় এই ব্যাকগ্রাউন্ডের স্টুডেন্টরা আধুনিক অ-ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবধারা, চেতনা, মুল্যবোধ, এক কথায়, আধুনিক যুক্তিবাদী, মুক্তচিন্তার সাথে মানিয়ে নিতে পারেনা। ফলতঃ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এরা পিছন দিকে টেনে ধরে রাখে এবং সেক্যুলার আধুনিক লিবারেল মু্ক্তমনা ও এমন যারা নয়, তেমন একটি ধারাতে বিভক্ত হয়ে পড়ে।

এই মাদ্রাসা থেকে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের রিক্রুটমেন্ট উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় হয়ে থাকে। এটাও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষায় জটিলতা সৃষ্টি করে থাকে।

এই ধারার ব্যাকগ্রাউন্ডসমপন্ন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক স্টুডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং পরবর্তীতে সাফল্য লাভ করেন।

ইংলিশ মিডিয়াম এডুকেশনের ধারা

এই ধারার পড়ুয়ারা প্রায় সব ক্ষেত্রেই উচ্চবিত্ত ধনী, নব্য ধনী, সুপার ধনী পশ্চিমা মনস্ক পরিবারের সন্তান। এগুলোর অনেকগুলোর পাঠ্যক্রম/কারিকুলাম জাতীয় কারিকুলামের সাথে সম্পর্কহীন। কিছুক্ষেত্রে এইসব ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলি জাতীয় কারিকুলাম ফলো করলেও বেশীরভাগই অক্সফোর্ড কারিকুলাম ফলো করে। এখান থেকে পাশ করা স্টুডেন্টদের বিরাট অংশ A Level, O Level পাশ করে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। তাদের বই পুস্তক সব ভিন্ন। যে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো জাতীয় কারিকুলাম ফলো করে, তারাও বেশ কিছু আলাদা বই-পুস্তক পড়িয়ে থাকে যেগুলো জাতীয় এথোসের সাথে সামন্জস্যপূর্ণ নয়।

এই ধারার নগণ্য একটা অংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসে। বাকীদের একটা অংশ দেশীয় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এবং অন্যরা বিদেশে পড়তে চলে যায়। এদের বেশীর ভাগই আবার বিপুল পরিমাণ টিউশান ফি দিয়ে নিজ খরচে বিদেশে পড়তে যায়।

গ. ফলে, এরাও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অত্যন্ত ক্ষুদ্রাকারে হলেও ভিন্ন একটা উন্নাসিক এলিটিস্ট ধারা মেইনটেইন করে।

মেইনস্ট্রিম বা মূল ধারার শিক্ষা

ক. এটা মূলতঃ নায়েম নির্ধারিত মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাক্রমকে বুঝায়। এই ধারাটিই অধর্মীয় জেনারেল এডুকেশন ধারা। এই ধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সরকার অনুমোদিত, বেশ কয়েকটি শিক্ষাবোর্ড কর্তৃক পরিচালিত হয়ে থাকে। এটাকেই "মূল ধারা" বলে গন্য করা হয়।

খ. এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ধর্ম শিক্ষা হিসাবে একটি কোর্স পড়ানো হয়ে থাকে। তবে, সেটা অনেকটাই তাৎপর্য্যহীন। এর ইমপ্যাক্ট তেমন একটা নাই বললেও চলে। এই ব্যবস্থাতেও কোর্স কারিকুলাম সবার জন্য অভিন্ন হলেও, এই ধারায় পড়া সবাই একইরকম নয়। এমনকি এই ধারায় শিক্ষালভকারী সবার অভিজ্ঞতা একইরকম নয়। এখানে অঞ্চল, আর্থিক সঙ্গতি, ইত্যাদি ভেদে বিভিন্ন স্কুল কলেজের শিষার্থীদের ভিতর বিভাজন পরিষ্কার।

একদা যে গাঁয়ের, মফস্বলের স্কুল কলেজ থেকে তুখোড় মেধাবী শিক্ষার্থী উঠে আসাটাই ছিল নিয়ম, এখন সেটা প্রায় বিরল ব্যাপার। কারণ, শহুরে ও নগুরে গুটিকয়েক সুবিধাসম্পন্ন স্কুল কলেজের পড়ুয়া, শিক্ষক মন্ডলী, পড়ুয়াদের টিউশান ও অন্যবিধ ফি, শিক্ষকমণ্ডলীর বেতন ও আনুষঙ্গিক সুবিধাদি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো, পড়ুয়াদের/শিক্ষার্থীদের পারিবারিক আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট, তথা সার্বিক তুলনায় বলা চলে গুটিকয়েক শহুরে ও নগুরে স্কুল-কলেজ ও বাকী স্কুল-কলেজের তফাৎ আকাশ-পাতাল না হলেও ব্যাপক।

দুর্ভাগ্যজনক সত্য হলো, বিগত কয়েক দশকে গ্রামীণ স্কুলগুলোতে বিজ্ঞান বিষয়ে পড়া ও পড়ানো কমে গিয়েছে উদ্বেগজনকভাবে। সে সাথে ইংরেজী শিক্ষাও একদমই ঠিক মতো হচ্ছে না। তদুপরি, সরকারের সদিচ্ছার কারণে সকল স্কুল-কলেজে তথ্য প্রযুক্তি সুবিধা থাকলেও সেগুলোর ব্যবহার নাই বললেই চলে এসব প্রতিষ্ঠানে।

ফলতঃ এই মূল ধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আসা ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বিভিন্ন মানদন্ডে বিভক্তি উৎকট। ফলে, বড় ও "ভালো" পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মূলধারার শহুরে ও নগুরে স্কুল-কলেজ থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীদের একটা ছোট অংশ ভর্তি হলেও, বাকীরা সামর্থ্য অনুযায়ী বিদেশে বা দেশের বেশী ভালো থেকে কম ভালো বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। আর নিম্ন মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের 'ভরসা" হয়ে রয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এটা ভর্তি পরীক্ষা চলাকালীন অভিভাবকগনের দিকে নজর দিলেই বুঝা যায় তাদের বেশ ভুষা থেকেই। অর্থাৎ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে উঠেছে কিছু মধ্যবিত্ত শ্রেনীর আর বেশীরভাগ নিম্ন মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেনী থেকে আগত প্রধানতঃ গ্রামীণ কলেজ গ্র্যাজুয়েটদের পড়াশোনার স্থান। তাদের  উঠতি তারুণ্য ও যৌবনের পুনর্বাসন কেন্দ্র।

সরকার রাফলি হাজার দশেক কোটি টাকা বরাদ্দ রাখে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য। এই অর্থ হলো deferred unemployment cost. তরুণদের বেকারত্ব ঠেকিয়ে রাখার সামান্য মূল্য। যে মানবেতর পরিবেশে ছাত্ররা তাদের শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করে, সেটা কল্পনা করাটাও লজ্জার।

দুঃখজনক হলেও নির্মম বাস্তবতা এই যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সৃষ্টির কিছুদিনের মধ্যেই রাষ্ট্রটি বেদখল হয়ে যায় ধনাঢ্য শ্রেণীর দ্বারা। অবশ্য, এই বিতর্কে জড়ানোই যায় যে, আসলেই রাষ্ট্র ধনাঢ্য শ্রেণীর হাতছাড়া আদৌ কখনো হয়েছিল কিনা!! তবে, সে বিতর্কে নাই বা গেলাম। ফলে, কাঠামোগতভাবেই একটা প্রশ্ন আসতেই পারে যে, নিম্নশ্রেণীর ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পিছনে এতো "বিপুল" ব্যয় বা "অপচয়" করে কি লাভ!! যৌক্তিকতা কি!! ফলে, স্বাধীনতার মাত্র দশ বৎসরের মাথায় ১৯৮২ সালে পুঁজিবাদের কঠোর সমর্থক সামরিক শাসক এরশাদের শিক্ষা উপদেষ্টা ডঃ আব্দুল মজিদ খানের প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি দেখি, যেটা উচ্চশিক্ষার প্রাইভেটাইজেশানের প্রথম প্রকাশ বলা যেতে পারে। তাদের ধারনায়, "অপরিপক্ক" "অদূরদর্শী"  "বামপন্থী-প্রভাবিত" "ধংসাত্মক" "বিভ্রান্ত" ছাত্র নেতাদের ছাত্র রাজনীতির চাপে এই উচ্চশিক্ষার বাজারীকরণের ও প্রাইভেটাইজেশানের প্রয়াস দুই দশক কোনমতে ঠেকিয়ে রাখা গেলেও সকল প্রতিরোধ ধ্বসে পড়ে বাংলাদেশের অভ্যুদ্যয়ের ঠিক দুই দশকের মাথায়।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতন, বিশ্ব পুঁজিবাদী মতাদর্শের (Liberalization, Privatization, Globalization --- LPG) জয়জয়কার, পৃথিবীর প্রায় সকল দেশের মত বাংলাদেশের বাম রাজনীতির ও সেই সাথে বাম ধারার ছাত্র রাজনীতির দূর্বল হয়ে পড়া, LPG অনুযায়ী আর সব সেক্টরের মতো শিক্ষা সেক্টর বা খাতও বেসরকারীকরণের দিকে ধাবিত হয়। নীচের দিকে যেমন কিন্ডার গার্টেন, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, এ লেভেল, ও লেভেল আর বেসরকারী বিভিন্ন কিসিমে’র মাদ্রাসার ছড়াছড়ি হয়ে পড়ল অতি দ্রুত, তেমনিভাবে ১৯৯২ সাল থেকে অদ্যাবধি বেসরকারী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার ধুম পড়ে যায়। ভালোমন্দ সব একাকার হয়ে যায়।

ফলে, দুঃখজনকভাবে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি রাষ্ট্রের আগ্রহ ক্রমাগত হ্রাস পেয়েই চলেছে। হ্যাঁ, অনেকেই হয়তো বলবেন, কেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথা, মেডিক্যাল কলেজ, ইন্জিনিয়ারিং কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ইত্যাদির সংখ্যা কি অনেক বাড়েনি? পরিসংখ্যান নিয়ে তো আর খেলা করা যায়না। তাই, স্বীকার করায় তো সমস্যা নাই যে, সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই বেড়েছে। জনসংখ্যা দ্বিগুণের বেশী হয়েছে, সেটাও একটা পরিসংখ্যান। উচ্চ মাধ্যমিকে পাশের হার বেড়েছে, সেটাও পরিসংখ্যান। আবার শিক্ষার্থী পিছু রাষ্ট্রীয় অবদান কমেছে না বেড়েছে, সেটাও একটা পরিসংখ্যান।

যাহোক, তো, বৈশ্বিক আর্থ-রাজনৈতিক রূপান্তরের সাথে সাথে বাংলাদেশের পরিস্থিতি বদলের ফলে উচ্চ শিক্ষা খাতেও বেসরকারীকরণের জোয়ার এসে যায়, ব্যবসায়ীক লগ্নি হতে থাকে। ধনীক ও অভিজাতদের যে অংশ শিক্ষার্থী বিদেশে যেতে পারছেননা, তাঁরা এখন এসব বেসরকারী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে  "উন্নত" পরিবেশে অর্থাৎ, রাজনৈতিক ঝামেলামুক্ত আধুনিক প্রযুক্তি সুবিধাসম্পন্ন "উন্নত" উচ্চশিক্ষা ক্রয় করে নিচ্ছেন খুবই চড়া মুল্যে, যে মুল্য দেয়ার ক্ষমতা মধ্যবিত্তের অনেকের, নিম্নমধ্যবিত্ত থেকে দরিদ্র শ্রেণীর নাই। ফলে, তাদের শেষ ভরসা হলো, বিভিন্ন মানের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ স্থানীয় কলেজ সমুহ, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট সমুহ, ছোটখাটো ব্যবসা করা, বিদেশে শ্রমিক হিসাবে যাওয়ার চেষ্টা করা, হতাশ বেকার হওয়া, নিম্নমানের ড্রাগ আসক্ত হওয়া, ক্রিমিনাল গ্যাংয়ে ও রাজনৈতিক দলের একটিভিস্ট বা ক্যাডার হওয়া। বেশী বেশী উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু করা ও সরকারী বেসরকারী কলেজে অনার্স ও মাস্টার্স প্রোগ্রাম চালু করার হিড়িকের আংশিক ব্যাখ্যা এর ভিতরেই পাওয়া যেতে পারে। নিম্নবর্গের শিক্ষিত তরুণদের বেকারত্ব আড়াল করার জন্য এগুলো নিম্নবর্গীয় তরুণদের একটা ডাম্পিং গ্রাউন্ড বা ভাগাড় হিসেবে এগুলোকে দেখা যায়। যদিও কথাগুলো কঠিন, তবে, তা কি সত্য বা বাস্তবতা থেকে খুব বেশী দূরে!! এই প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে পাশ করা গ্রাজুয়েটগন কি করেন পাশ করে?

এদের একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ হয়তোবা বিসিএসে কোয়ালিফাই করে সরকারের উচ্চ আমলাতন্ত্রের অংশ হন। তবে, এই নিয়োগপ্রাপ্তির প্রক্রিয়া অনেক দীর্ঘ। প্রায় আড়াই থেকে তিন বছর লেগে যায় দরখাস্ত করা থেকে যোগদান পর্যন্ত। বাকীরা জনবল হিসাবে নিয়োজিত হয় ব্যাংকসহ বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে, অফিসে নিম্ন থেক মাঝারি পর্যায়ের কর্মচারী পদে, বেসরকারী স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার শিক্ষক পদে, প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক পদে। এরা আরো একটি সেবা প্রদান করে থাকে। তা হলো, একটু স্বচ্ছল থেকে ধনাঢ্য পরিবারের ছোট সন্তানদের প্রাইভেট টিউটর হিসাবে এরা কাজ করে, সেবা প্রদান করে। এটা একটা মিউচ্যুয়াল বেনিফিটের ব্যাপার। তবে, আমার জানা মতে, সাধারণভাবে প্রাইভেট টিউটরদের একটা অসম্মানিত ও হীন জীবন যাপন করতে হয়। কিন্তু, স্বচ্ছল পরিবারের সন্তানদের জন্য অতি কম মুল্যে শিক্ষা সেবা এসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ও অন্যান্য উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীরা দিয়ে থাকে।

এসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি মার্কেট-ওরিয়েন্টেড নয়া-ক্ল্যাসিক্যাল উন্নয়ন মডেলের অনুসারী রাষ্ট্র ও তার নীতি নির্ধারনী ব্যক্তিবর্গ এসব প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় উপযোগীতা অনুযায়ী যেটুকু মনোযোগ পাওয়া দরকার, ততটুকু মনোযোগও হয়তো দেননা। সরকার (তার দলীয় রাজনৈতিক পরিচয় নির্বিশেষে) এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে তার আজ্ঞাবহ হিসাবে ও নিজেদের পছন্দের লোক নিয়োগের বাহন হিসাবে দেখে থাকে ও নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। ফলে, একাধিক দুঃখজনক, কিন্তু প্রায় অনিবার্য ব্যাপারগুলো ঘটে থাকে, যেমন:

১. শিক্ষকদের ভিতর সরকারের নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়োগ প্রক্রিয়া দূষনযুক্ত করা হয়, অযোগ্য হলেও নিজের রাজনীতির অনুগত ব্যক্তিদেরকে মনোনয়ন দেয়া হয়। এক্ষেত্রে, মানের ব্যাপারে কিছু বা ব্যপক ছাড়ের বিষয়টাকে যৌক্তিক মনে করা হয়। ফলে, শিক্ষকদের ও তাদের প্রদত্ত শিক্ষার মান ক্রমেই কমতে থাকে।

২. এই ক্রমনিম্নমানের শিক্ষকদের থেকে উন্নত গবেষণা কর্মকাণ্ড আশা করা কতটুকু ঠিক!! আবার এঁদের দ্বারা শিক্ষাপ্রাপ্ত গ্রাজুয়েটগনের মানও নিম্নমুখী হওয়ারই কথা। হচ্ছেও তাই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর গ্রাজুয়েটদের একটা ক্ষুদ্র অংশ যেহেতু  বাংলাদেশের উচ্চ আমলাতন্ত্রের জনবল হন, ফলে, বিগত বছরগুলোতে আমলাদের মানেও টান পড়তে শুরু করেছে। দুঃখজনক হলেও এ কথা সত্য যে, অনেক আমলা আছেন, যাঁরা শুদ্ধভাবে না বাংলা না ইংরেজী উচ্চারণ করতে পারেন। হতাশাজনক হলেও সত্য যে, পাবলিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষকদের মধ্যেও এই সীমাবদ্ধতাটা প্রকটভাবে উপস্থিত।

৩. পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়ায় সরকার তার অনুগ্রহপুষ্ট বা পছন্দের ব্যক্তিবর্গকে এসব  শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে নিয়োগ দান করে। আর এর মাধ্যমে স্বীয় নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে প্রয়াস নেয়। ফলে, উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অমান্য করা হয়। গনতান্ত্রিক চর্চা বাধাগ্রস্ত হয়।

৪. শিক্ষার্থীদের উপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যম হিসাবে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের হাতে ছাত্রবিষয়ক বিষয় সমূহের দায়িত্ব ও একচ্ছত্র ক্ষমতা নিশ্চিত করা হয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ও উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমুহের প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় ও পুলিশী সহায়তায়। অন্য বা ভিন্ন মতের ছাত্র সংগঠনগুলোর কার্যক্রম প্রায় বন্ধই হয়ে যায়। ফলতঃ কোন বিচারেই এই প্রতিষ্ঠানসমুহকে আর গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত প্রতিষ্ঠান বলা মুশকিল হয়ে পড়েছে। যেহেতু, এই প্রতিষ্ঠানসমুহ তাদের বার্ষিক ব্যয় নির্বাহের জন্য সরকারের আর্থিক বরাদ্দ নামক কৃপার উপর নির্ভরশীল, তাই এদের পক্ষেও স্বাধীনতা দাবী করার মত মাজার জোর থাকেনা। আবার সরকার এদের ব্যয় নির্বাহ করে বিধায় এই প্রতিষ্ঠান সমুহের উপর যাচিত ও অযাচিত নিয়ন্ত্রণ ও শর্ত আরোপ করে ও করতে উদ্যত হয়। সরকার এটা তার বৈধ এখতিয়ার মনে করে। যেহেতু শিক্ষক ও ছাত্র সংগঠন হিসাবে সরকার দলীয়দের নিয়ন্ত্রণ ও প্রাধান্য থাকে, তাই সরকারি এমনকি, সরকারের অযাচিত নিয়ন্ত্রণের বিরূদ্ধে কোন কার্যকরী প্রতিবাদ হয়না।

৫. সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে সরকারের লিয়াজোঁ রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান ইউনিভার্সিটি গ্র্যান্টস কমিশন (ইউ জি সি) মাঝে মধ্যেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দূর্ণীতি, অনিয়ম রোধকল্পে বিভিন্ন শর্ত, বিধিনিষেধ আরোপ করে থাকে। কিন্তু, কার্যকরীভাবে তেমন কিছু হয়নি। হবার তেমন একটা কথাও না।

৬. সদ্য সম্প্রতি (গত পাঁচ সাত-আট বছর যাবত) সরকার Institutional Quality Assurance Program (IQAC) নামক একটি সংস্কার প্যাকেজ চাপানোর চেষ্টা করছে। হতে পারে, উদ্দেশ্য মহৎ। ঘোষিত লক্ষ্য, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার ও গবেষনার গুনগত মান উন্নয়ন ও Outcome-based Education (OBE) চালু করা। এর সীমাবদ্ধতা, অকার্যকারীতা, পশ্চিমা ব্যবস্থা আমাদের দেশে চালু করার বাস্তবতার অনুপস্থিতি, শিক্ষকদের উপর বাড়তি বোঝার প্রস্তাবনা ইত্যাদি ছাড়াও এর আসল সমস্যা ভিন্ন জায়গায়।

৭. সেটা হলো, এটা বাস্তবায়নের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক তথা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরকারের বিনিয়োগ বৃদ্ধির কমিটমেন্টের বিষয়টি। শিক্ষার পিছনে বিনিয়োগের প্রথম কথাই যে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের উপর বিনিয়োগ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি, এইটা স্বীকারের আগে কোন রিফর্মই কোন কাজে আসবেনা শিক্ষা ও গবেষনার মান বৃদ্ধিতে। বরাবরই বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমুহের শিক্ষকদের উপর বিনিয়োগ যেকোন মানদণ্ডেই নিতান্তই নগন্য ও অমর্যাদাকর। শিক্ষার্থীদের উপরও বিনিয়োগ নাই বললেই চলে। তাদের থাকার ব্যবস্থা মেস জীবনের চেয়ে কোন অংশেই ভালো না। হলগুলোর অবস্থা কেমন, সে কথা কে না জানে! তাদের খাবারের মান ও পরিবেশ নিয়ে যত কম বলা যায়, ততই ভালো। ক্লাশরুম, পরিবহন ব্যবস্থা, লাইব্রেরী, কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ফ্যাসিলিটি, ইত্যাদির কথা নীতিনির্ধারকদেরও নিশ্চয়ই জানা আছে।

লেখক: অধ্যাপক-বিশ্লেষক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর