আধুনিক সমাজে সামাজিক মর্যাদা

, যুক্তিতর্ক

মো: বজলুর রশিদ | 2023-08-31 23:12:45

সমাজ বিজ্ঞানে একটি জনপ্রিয় ধারণা রয়েছে যে সম্পদের ভিত্তিতে শিল্প সমাজের বৈষম্য ও পার্থক্য বোঝা যায়। কিন্তু সম্পদ দিয়ে শিল্পোন্নত সমাজের সব বৈষম্য বোঝা অসম্ভব। শিল্পোন্নত সমাজে সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রে আরও কিছু প্রভাবশালী কারণ দেখা যায়।

আধুনিক শিল্পায়িত সমাজে সামাজিক মর্যাদার পার্থক্য খুবই তীব্র দেখা যায় যে । সারাবিশ্বে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করা হয় সামরিক বাহিনী গড়ে তোলার জন্য। এবং সামরিক বাহিনী হল সবচেয়ে নিয়ন্ত্রিত একটি ব্যবস্থা। এখানে প্রতিটি পদ-পদবী স্পষ্টভাবে অন্যান্য পদ-পদবী থেকে পৃথক।

সাধারণ সৈন্যরা সর্বদা অফিসারদের আদেশ পালন করে। এক্ষেত্রে তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো মূল্য নেই। একজন কর্মকর্তার আদেশে মৃত্যুর সম্ভাবনা জেনেও দায়িত্ব পালন করতে হয়। অফিসারদের মধ্যে পদমর্যাদার পার্থক্যও রয়েছে এবং সমস্ত জুনিয়র অফিসার তাদের ঊর্ধ্বতনদের অধীনস্থ। এভাবে একটি দেশের সমগ্র সামরিক বাহিনী একটি পিরামিডের আকার নেয়।

এর সর্বোচ্চ পদে রয়েছেন দেশটির সামরিক বাহিনীর প্রধান। যদি দুই দেশের সামরিক বাহিনী একসাথে একটি অপারেশনে অংশ নেয় — সেক্ষেত্রে, দুর্বল দেশের সামরিক বাহিনীর সদস্যরা একই পদমর্যাদার হলেও শক্তিশালী দেশের সেনাবাহিনীর সদস্যদের অধীনস্থ হয়ে যায়।

সামরিক বাহিনীতে পদ মর্যাদার পার্থক্য অনেক বেশি মনে হতে পারে। কিন্তু আধুনিক সমাজে যে কোনো চাকরিতে এই শ্রেণিবিন্যাস পদ্ধতি লক্ষ্য করা যায়। সেটা ব্যাংক, বীমা বা শিক্ষা খাতে যে কোনো চাকরিই হোক। লিখিত বা অলিখিত সব ক্ষেত্রেই আচরণের নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। এগুলিকে সাধারণত শিষ্টাচার হিসাবে উল্লেখ করা হয় এবং এটি অনুরূপ আর্থিক অবস্থার লোকেদের বিবেচনা করে। চাকরি যদি হয় শ্রমিকের, তাহলে মর্যাদার ঘাটতি হয়।

বাংলাদেশের মতো প্রান্তিক পুঁজিবাদী সমাজে একটি মতাদর্শ চালু আছে যা গভীরভাবে মর্যাদাকেন্দ্রিক। সেটি হল 'খান্দান', এবং এর অর্থ সাধারণত বংশের মর্যাদা। খান্দানের ধারণা সামাজিক মিথস্ক্রিয়া এবং সম্পর্ক নির্মাণে ভূমিকা রাখে।

এজন্য অনেক সময় কাউকে হয়রানি করার জন্য বলা হয়, 'আপনি কোন বংশ থেকে এসেছেন তা দেখতে হবে না!' একজন ব্যক্তি যার পরিবার বা বংশ 'জমিদার' বা ধনী শ্রেণির ছিল তার মযাদা অনেক। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এখানে একটি পুরুষতন্ত্রের কথা ভাবা হয়। যাইহোক, যদি বিবাহিত পরিবারের একটি সমৃদ্ধ অতীত থাকে তবে এটি কখনও কখনও বিবেচনা করা হয়।

যদিও ব্রিটিশ আমলে জমিদারদের সংখ্যা নগণ্য ছিল যারা ব্রিটিশদের অনুগত ছিলেন, তা নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয় না। গত তিন-চার দশকে খান্দান বা বংশের মর্যাদা মাপার আরও কিছু বিষয়ের প্রচলন হয়েছে। যেমন চাকরি বা শিক্ষা। একটি পরিবার কতদিন ধরে 'সম্মানজনক' চাকরি করছে তার উপর ভিত্তি করে সেই পরিবারের বংশের মর্যাদা অনুমান করা হয়। প্রথম পর্যায়ে সরকারি চাকরির দিয়েই বংশের মর্যাদা মাপা হতো।

পরে, উচ্চ বেতনের বেসরকারি চাকরি আরও মর্যাদাপূর্ণ হয়ে ওঠে। শিক্ষার প্রেক্ষাপটও গুরুত্বপূর্ণ এবং চাকরির সাথে সম্পর্কিত। সামাজিক মর্যাদার বিষয়টি এতই প্রবল যে বিয়ে বা অন্যান্য উৎসবে অতিথি হিসেবে দেখা দাওয়াতের ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখে। তাছাড়া পরিবারের সদস্যরা বিয়ের জন্য সঙ্গী নির্বাচনের সময় নিম্ন বংশের কাউকে বিবেচনা করে না। এখানে যে প্রবণতাটি আলোচনা করা হয়েছে তা অবশ্যই, প্রধানত সচ্ছল লোকেদের জন্য প্রযোজ্য ।

তবে একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে শ্রেণির ধরন এবং সামাজিক মর্যাদা অনেকক্ষেত্রে ভিন্নভাবে কাজ করে। যেমন: যে কোনো বিয়েতে বর বা কনের বংশ মর্যাদা অন্য পক্ষের খুব একটা পছন্দ হয় না। সেখানে বর বা কনের পরিবারের আর্থিক অবস্থা মজবুত হলে, সেখানে একটি শক্তিশালী সম্পর্ক হতে পারে।

আধুনিককালে অনেকক্ষেত্রে বেশি ভোগ করা স্ট্যাটাস বজায় রাখার প্রাথমিক মাধ্যম হয়ে উঠেছে। আধুনিক শহুরে সমাজে, যত বেশি ভোগ্যপণ্য ক্রয় করা হয়, তত বেশি মর্যাদা বাড়ে। এই শ্রেণীর লোকেরা এটিকে কথোপকথনে 'স্ট্যাটাস রিটেনশন' বলে।

বর্তমান সময়ে মর্যাদার বিষয়টি অনেক সূক্ষ্ম উদাহরণে দেখা যায়। বড় শহরের প্রায় সব মধ্যবিত্ত পরিবারে কাজের জন্য গৃহকর্মী থাকে এবং তাদের বলা হয় 'বুয়া'। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, তারা সাধারণত মহিলা হয়। এই সমস্ত গৃহকর্মীরা অত্যন্ত দরিদ্র এবং মাসিক চুক্তিতে কাজ করে।

এর মানে হল যে তাদের কাজ বা মজুরি দিনের শ্রম ঘন্টা দ্বারা পরিমাপ করা হয় না। যেহেতু সমস্ত গৃহকর্মীই মধ্যবিত্তের বাড়িতে বাস করে, তাই তাদের অবশ্যই একই জায়গা ব্যবহার করতে হয়। সে কোন ঘরে থাকবে তার একটা ব্যবস্থা আছে; বলা বাহুল্য, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি যতটা সম্ভব নিম্নমানের হয়।

তবে কোন ঘরে সে কাজের জন্য আসতে পারে এবং কোন সময়ে সে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যেতে পারবে না তার উপরও স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা থাকে। শুধু জায়গার ব্যবহারই নয়, টেলিভিশন দেখা, অতিথিদের সঙ্গে কথা বলা বা হাসি-ঠাট্টা করা, গান গাওয়া বা আরও অনেক কিছুর ওপর বিধিনিষেধ বেধে দেয়া হয়।

এই নিষেধাজ্ঞাগুলি কেবল অর্থ বা সম্পদের প্রসঙ্গে বোঝা যায় না। কারণ তার মজুরি দিতে গিয়ে সেই পার্থক্য হারিয়ে গেছে, এখানেই মর্যাদার পার্থক্য। এই নিষেধাজ্ঞার কারণ বাড়ির লোকেরা সবসময় গৃহকর্মীকে তার মর্যাদা সম্পর্কে সতর্ক রাখতে চায়।

আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, তা হল ত্বকের রঙ। প্রচলিতভাবে, আমাদের সমাজে, অনেকক্ষেত্রে ত্বকের রঙের উপর ভিত্তি করে মানুষের মর্যাদা বৈষম্যের শিকার হয়। তুলনামূলকভাবে যাদের গায়ের রং সাদা তাদের বেশি মর্যাদা দেওয়া হয়।

এটি একটি স্থানীয় সমস্যা বলে মনে হতে পারে তবে এর একটি বিশ্বব্যাপী প্রেক্ষাপট রয়েছে। এখন, বেশিরভাগ দেশে কাগজে-কলমে বা নথিতে এই বৈষম্য নেই এবং আইনের অধীনে সবাই সমান। কিন্তু বাস্তবতা হলো এখনো অনেক সমাজে কালো রঙের প্রতি ঘৃণার মনোভাব রয়েছে।

সুতরাং, এটা বলা যেতে পারে যে আধুনিক শিল্পোন্নত সমাজে, একটি সামাজিক অবস্থান বা মর্যাদা অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। তবুও, সম্পদ হল মৌলিক ফ্যাক্টর যা মানুষের সামাজিক মর্যাদা নির্ধারণে অনেক অবদান রাখে।

মো. বজলুর রশিদ: সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর