শব্দ দূষণের প্রভাব এবং প্রতিরোধে করণীয়

, যুক্তিতর্ক

মো. বজলুর রশিদ | 2023-09-01 23:23:38

শব্দ দূষণ বলতে মানুষ বা প্রাণীর শ্রবণ সীমার বাইরে যে কোনও শব্দ তৈরির কারণে শ্রবণশক্তি হ্রাসের সম্ভাবনাকে বোঝায়। কলকারখানা, পরিবহন, নির্মাণকাজ, নির্বাচনী প্রচারণাসহ বিভিন্ন কাজে লাউডস্পিকার ব্যবহার, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে শব্দ সৃষ্টি করে কাউকে বিরক্ত করাকে শব্দদূষণ বলে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে। মানুষ সাধারণত ২০-২০,০০০ হার্টজ সীমার মধ্যে শব্দ শুনতে পায়। এই সীমার বাইরে অতিরিক্ত জোরে শব্দ হলেই তা শব্দ দূষণ হিসেবে পরিগনিত হয়।

শব্দ দূষণ এক ধরনের মারাত্মক পরিবেশ দূষণ। আমাদের সঠিক ধারণার অভাবে এই দূষণের মাত্রা দিন দিন বাড়ছে। অনেক পরিবেশবিদ বাংলাদেশে শব্দ দূষণের বর্তমান পর্যায়কে 'শব্দ সন্ত্রাস' বলে অভিহিত করেছেন।

বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান প্রায় সময়ই প্রথম বা দ্বিতীয় স্থানে থাকে। এর অন্যতম প্রধান কারণ শব্দ দূষণ। এই দূষণ এখন শুধু ঢাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, তা পৌঁছে গেছে অন্যান্য শহরাঞ্চলেও।

শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা (২০০৬) অনুসারে, দিন ও রাত ভেদে পাঁচটি অঞ্চলে শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে যেমন- নিরিবিলি এলাকা, আবাসিক এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা, শিল্প এলাকা এবং মিশ্র এলাকা। কিন্তু বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, বাংলাদেশের কোথাও এই মাত্রা মেনে চলা  হয় না, সর্বত্র এই মাত্রার চেয়ে বেশি শব্দ পাওয়া যায়। ঢাকা শহরের এমন কোনো রাস্তা বা এলাকা খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে শব্দের মাত্রা ওই  নির্ধারিত মাত্রার মধ্যে রয়েছে।

শব্দ দূষণ শ্রবণশক্তি হ্রাসের পাশাপাশি মানুষের স্বাস্থ্য এবং আচরণ উভয় ক্ষেত্রেই সমস্যা সৃষ্টি করে। অপ্রয়োজনীয় এবং অতিরিক্ত শব্দ একজন ব্যক্তির স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক কার্যকলাপকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। শব্দ দূষণ উদ্বেগ, বিরক্তি, উচ্চ রক্তচাপ, শ্রবণশক্তি হ্রাস, ঘুমের ব্যাঘাত এবং অন্যান্য ক্ষতিকারক ও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়াও, অন্যান্য শারীরিক প্রতিক্রিয়া যেমন, স্মৃতিশক্তি হ্রাস, মানসিক অবসাদ ইত্যাদি হতে পারে।

মানুষের কান যেকোনো শব্দ শোনার জন্য যথেষ্ট সংবেদনশীল। তাই অতিরিক্ত আওয়াজ কানের পর্দাকে বেশ জোরে ধাক্কা দেয়, যা কানের পর্দারও ক্ষতি করতে পারে। শিশুদের ক্ষেত্রে এর ক্ষতিকর প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে পারে। শৈশবে বিভিন্ন ধরনের শব্দের কারণে বৃদ্ধ বয়সে কানের বিভিন্ন সমস্যা দেখা যায়। বিভিন্ন অঞ্চলে শব্দ দূষণের কারণগুলি গবেষণার মাধ্যমে অনুসন্ধান করা হয়েছে এবং দেখা গেছে যে সমস্ত অঞ্চলে দূষণের মাত্রা বেশি সেসব এলাকায় নিম্নোক্ত অসুবিধা বা ক্ষতিকর প্রভাবগুলি মানুষের উপর পড়েছে।

দূষণ-আক্রান্ত এলাকার মানুষ খিটখিটে হয়ে পড়ছে; আচরণে অস্বাভাবিকতা এবং মানসিক অশান্তি; মানুষকে শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্লান্ত এবং কাজের প্রতি অমনোযোগী করে তোলা; বয়স্ক মানুষের স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাচ্ছে; এমনকি বধিরতা মতো ঘটনাও ঘটছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ নয়েজ কন্ট্রোল বলছে, শব্দের কারণে উচ্চ রক্তচাপ, আলসার, হৃদরোগ, মাথাব্যথা বা স্নায়ুর সমস্যা হতে পারে। এমনকি অতিরিক্ত শব্দের পরিবেশেও শিশুর জন্মগত ত্রুটি দেখা দিতে পারে। শব্দ দূষণের কারণে রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট এমনকি হজমের সমস্যাও হতে পারে।

শব্দ দূষণ পরিবেশ দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দূষণ ও পরিবেশগত ঝুঁকিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ২৬% মৃত্যু হয় পরিবেশ দূষণজনিত অসুস্থতার কারণে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী গড় মৃত্যুর হার মাত্র ১৬ শতাংশ।

একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, সারা দেশে ২০ শতাংশ মানুষ বধির। এবং ২০ শতাংশের মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ শিশু। প্রায় ১১ শতাংশ ট্রাফিক পুলিশের শ্রবণ সমস্যা রয়েছে। আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা শহরের ৭১ শতাংশ মানুষ শব্দ দূষণের কারণে হতাশা ও উদ্বেগের মতো মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। এ ধরনের সমস্যা মোকাবেলায় সদিচ্ছার পাশাপাশি সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।

শব্দ দূষণ একটি মানবসৃষ্ট নিয়ন্ত্রণযোগ্য পরিবেশগত সমস্যা। আমরা বাড়িতে, অফিসে, রাস্তায় এমনকি অবসর সময়েও শব্দ দূষণের শিকার হই। শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে নিম্নলিখিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।

ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে, বাস, ট্রেন, জাহাজ, কলকারখানা এবং লাউডস্পিকার এর আওয়াজ নির্দেশিত স্তরে বা নীচে বজায় রাখতে হবে; যানবাহন থেকে নির্গত শব্দের তীব্রতা হ্রাস করার জন্য  উন্নত প্রযুক্তির ইঞ্জিন এবং সাইলেন্সার ব্যবহার নিশ্চিত করা উচিত; সামাজিক অনুষ্ঠানে ডিজে পার্টি বা ব্যান্ড মিউজিকের আয়োজন করা হয়, যা শব্দ দূষণের সৃষ্টি করে, যার ফলে শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থ ব্যক্তিসহ আশেপাশের প্রায় সকলের সমস্যা হয়; লাউডস্পিকার ব্যবহার নিষিদ্ধ করা; বিয়ে বাড়ির প্যারেডে ব্যান্ড বাজানো, পটকা ফাটানো বন্ধ করা; শব্দ দূষণ আইন মেনে চলার জন্য সবাইকে অবহিত করা; গণপরিবহনের শব্দ নিয়ন্ত্রণে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সক্রিয় হওয়া; একই সঙ্গে বিবেক নিয়ে সক্রিয় নাগরিকের ভূমিকা পালন করলে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। আমরা বিশ্বাস করি যে জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে  শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

শব্দ দূষণের বর্তমান মাত্রা খুবই উদ্বেগজনক। এটি একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। কিন্তু আমাদের অসচেতনতার কারণে, আমরা প্রায়ই বলি যে এটি সমাধান করা সম্ভব নয়। কিন্তু এই সমস্যাগুলো মানবসৃষ্ট। একটু সচেতন হলেই এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এ জন্য আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও মানুষের প্রতি সহনশীল হতে হবে। অযথা হর্ন বাজানোর দরকার নেই, হাইড্রোলিক হর্ন এড়িয়ে চলুন, সামাজিক অনুষ্ঠানে উচ্চস্বরে গান বা যন্ত্র বাজানো থেকে বিরত থাকুন। নির্মাণ কাজে শব্দের সীমা বজায় রাখুন। আমাদের আচরণগত পরিবর্তনও শব্দ দূষণ কমাতে পারে।

মো. বজলুর রশিদ: সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।

এ সম্পর্কিত আরও খবর