সমকালীন সংকট ও বাঙালির খেলাপ্রীতি

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহবুব মোমতাজ | 2023-08-31 12:02:30

ঢাকা শহরে এখন অনেক উন্নত মানের রেস্তোরাঁ ও ফাস্টফুডের দোকান হয়েছে। মধ্যবিত্ত ও নিন্ম মধ্যবিত্তদের অনেকেই পরিবার পরিজনসহ ছুটির দিনগুলোতে ওইসব রেস্তোরায় যান। খাওয়া-দাওয়া করেন। অনেকে বন্ধু-বান্ধবীসহ যান। তবে অবাক বিষয় হলো কেউই রাজনীতি নিয়ে সেখানে আলোচনা করেন না। অথচ ২০-২৫ বছর আগে যেসব হোটেল, রেস্তোরা ছিল সেখানে রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা হতো। যারা আলোচনা করত তারাও ছিল নিন্ম-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকজন।

রাজনীতি নিয়ে এখন বেশি আলোচনা হয় রাস্তার মোড়ে বা মহল্লার চা, বিস্কুট, পাউরুটি, পান, সিগারেট ও বিড়ি বিক্রীর দোকানগুলোতে। আর এসব দোকানের অধিকাংশ মানুষই হয় নিন্ম-মধ্যবিত্ত বা শ্রমজীবী শ্রেণির। যারা বিভিন্ন কাজ সেরে একটু ফুরসত পেলে এক কাপ চা ও পান,বিড়ি খাওয়ার জন্য এসব দোকানে ভিড় করে। অনেক দোকানের সামনে বেঞ্চ  জাতীয় বসার জায়গা থাকে। সেখানে বসে অনেকেই চা খেতে খেতে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা, পরচর্চা, পরনিন্দাসহ রাজনীতি নিয়েও আলোচনা করেন। করোনা মহামারি শুরুর পর এসব দোকানের ব্যবসাও বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু গত বছর থেকে তা আবার পুরোমাত্রায় শুরু হয়েছে।

সাধারনত এসব দোকানে কখনই আমার খুব বেশি যাওয়া হয় না। সেদিন এক বন্ধুর পীড়পিীড়িতে এমনই এক দোকানে গেলাম চা পানের উদ্দেশ্যে। দোকানে বেশ ভিড়। সামনের বেঞ্চে অনেকেই বসে চা পান করছে। আমরা একটু ফাকা জায়গা পেয়ে সেখানে বসলাম। হঠাৎই কানে এলো একজন মধ্য বয়সী লোক আরেকজনকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, ”ভাই শোনেন, বাঙালি খেলা দেখতে পছন্দ করে। ফুটবল, ক্রিকেট, হা-ডু-ডুসহ সব খেলা। তবে সবচেয়ে বেশি কোন খেলা পছন্দ করে জানেন? সাপের খেলা আর বানরের খেলা্। এই দুই খেলা যখন হয় দেখবেন, লোকজন উপচায়ে পড়ছে। হাতে তালি দিচ্ছে।”

ভদ্রলোকের বক্তব্য শেষে দোকানের সামনে বসা কেউ কেউ সহমত প্রকাশ করলেন। আমার কান একটু খাড়া হয়ে গেল। ঘটনা কী বুঝার চেষ্টা করলাম। যাকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলছিলেন সে এবার আরো সক্রিয় হয়ে উঠল। উচ্চকণ্ঠে বলল,” আরে রাখেন আপনার খেলার কথা। এইটা এখন সময়ের ব্যাপার। শ্রীলঙ্কাতে কী ঘটল দেখলেন না। এই সরকার আর বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারব না। দ্যাখেন না এদের অবস্থা কী হয়?”

আমি স্পষ্ট বুঝলাম এটা পুরোপুরি রাজনৈতিক একটা আলোচনা। সমসাময়িক দেশ যে সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সে বিষয় নিয়েই হয়ত আলোচনা হচ্ছিল। এখানে পক্ষে-বিপক্ষেও অনেকেই হয়ত আছে।  আমরা চায়ের অর্ডার দিয়ে চুপচাপ বসে তাদের আলোচনা শুনতে লাগলাম।

এরই মধ্যে আরেকজন বলে উঠল, “সরকার যে দেশে এত উন্নয়ন করল, পদ্মাসেতু বানাইল— এইগুলা কী আপনাদের চোখে পড়েনা? আজ একটু লোডশেডিং দিতাছে তাতেই আপনাগো মাথা গরম হইয়া গেল? এই সরকারের আগের সরকার বিদ্যুতের জন্য কী ঘটনা ঘটায়ছিল তা ও কী ভুলে গেলেন? সরকার তো বলতেই আছে, যুদ্ধের জন্য  জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। তেলের দাম বাড়ছে। পৃথিবীর সব দেশেই বাড়ছে। সরকার এইটা সামাল দিতে পারবে। তাহলে খামাকা কেন মাথা গরম করছেন?”

ইতিমধ্যে চা চলে এসেছে। আমরা চা পান করতে করতে আরো কিছু শোনার অপেক্ষায় কান খাড়া করে রইলাম। একজন বলল, “শোনেন যাই কিছু কন, পাবলিক যে খারাপ অবস্থায় আছে, সেইটা তো অস্বীকার করার উপায় নাই। পাবলিক এখন কিছু বলতেছে না সত্য। কিন্তু বিরোধীরা যে ভাবে বলতেছে—সরকারের দুর্নীতির কারণে এই অবস্থা হইছে, সেইটাতো পাবলিক বিশ্বাস করতেছে। বিরোধীরাতো পাবলিকরে ক্ষ্যাপায়া তুলতাছে।”

অন্য একজন বলে উঠল, “ পাবলিকরে ক্ষাপায়া বিরোধীরা কী করব। আন্দোলন কইরা ক্ষমতায় আইব। ক্ষমতায় আইয়া হেরা কী করব। এই পরিস্থিতি কী সামলাইতে পারব। তারা তো শুধুই সমালোচনা করতাছে কিন্তু ক্ষমতায় আইলে কী করব হেইডাতো বলতাছে না।  বরং এতদিন ক্ষমতার বাইরে থাকায় তারা ক্ষুর্ধাত অবস্থায় আছে। ক্ষমতায় আইসাই সব কিছু খাওয়া শুরু করব। এইটাতো এখন আন্তর্জাতিক সমস্যা। যুদ্ধকালীন অবস্থা। এই অবস্থায় কেউই এই দেশটারে ভালো করবার পারব না।”

আরেকজন বলল, “একটা বিষয় খেয়াল করছেন। অনেকেই এখন চুপ করে আছে। কিছুদিন আগেও যারা সরকারের পক্ষে কথা বলত, কিংবা সমালোচনা করত তারাও চুপ করে আছে। পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করছে। যেই সরকার পরিবর্তন হইব, অমনি যারা ক্ষমতায় আইব তাদের পক্ষে কথা বলব। অনেকেই মনে মনে আনন্দে আছে। ভাবছে সরকার এইবার বিপদে পড়ছে। এই বিপদ সামাল দিতে পারব না। সরকার পরিবর্তন হইব। তাদের দিন আইব।”

অন্য আরেকজন মন্তব্য করল, “তবে যাই কন, যারা সরকারে আসার জন্য ফাল পাড়তাছে তারা আসলে পাবলিকের ভালো করতে পারব না। কারণ পাবলিক তাদের শাসন আমলও দেখেছে। বরং, যারা ক্ষমতায় আছে, তারাই পাবলিকের ভালো করতে পারব। এই কয় বছরে তার প্রমাণ হইছে। আর যারা এই সরকারের পরিবর্তন চাইতেছে তারা আসলে সাপের খেলা, বানরের খেলা পছন্দ করার মতই সরকার পরিবর্তনের খেলা পছন্দ করে।”

ড. মাহবুব মোমতাজ, শিক্ষক, সমাজকর্ম বিভাগ, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর