বিপদের মুখে পশ্চিমবঙ্গে মমতা শাসনের ভবিষ্যৎ

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-09-01 23:21:43

বামফ্রন্টের তিন যুগের শাসনের অবসান ঘটিয়ে টানা তিন দফা ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন মমতা সরকারের ভবিষ্যৎ বিপদের মুখে। একচ্ছত্র ক্ষমতার উদগ্র লালসার আগুনে পুড়ছে দলটি। দলের মন্ত্রী ও মহাসচিব গ্রেফতার হয়েছেন দুর্নীতির দায়ে। মন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ একাধিক বান্ধবীর খোঁজও পাওয়া গেছে। যাদের রয়েছে একাধিক বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট এবং সেসব আবাসে পাওয়া গেছে টাকার পাহাড়।

আন্দোলন ও আপোষহীনতার ইমেজ নিয়ে যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গে প্রশ্নাতীত শাসন জারি রেখেছেন, এসব ঘটনা তাতে শুধু কালিমাই লিপ্ত করবে না, শাসক তৃণমূলের নৈতিক শক্তিতেও ক্ষয় ঘটাবে।

চরম ক্ষমতা হস্তগত করার পর মমতা ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে দলের শীর্ষে নিয়ে এসেছেন, যার বিরুদ্ধে রয়েছে দুর্নীতির এন্তার অভিযোগ। আদর্শের বারোটা বাজিয়ে ইচ্ছেমত দলে নিয়ে এসেছেন দলত্যাগী, দুর্নীতিবাজ, স্বজনপোষণকারী, সাম্প্রদায়িক ও মাফিয়া নেতাদের। পরিস্থিতি এমন তৈরি করা হয় যে, 'সঠিক বা বেঠিক হলেও নেত্রীর আদেশ মানতেই হবে।' স্বৈরতন্ত্রী একনায়কের দুর্গন্ধ দলকে ঘিরে ধরলেও সেসব পরোয়া করেন নি প্রবলভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত মমতা ও তার দল তৃণমূলের নেতৃত্ব।

কংগ্রেসের ঐতিহ্য বেয়ে তৃণমূল কংগ্রেস গঠন করলেও দলনেত্রী মমতা গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতার ঘোষিত মতাদর্শ রক্ষা করতে পারেন নি। জাত-পাত, সংখ্যালঘুদের নিয়ে রাজনীতির অভিযোগ বার বার উত্থাপিত হয়েছে তার দলের বিরুদ্ধে। মুসলিম এলাকায় জমি অধিগ্রহণ ও পুড়িয়ে নারী-পুরুষ হত্যার একাধিক রোমহর্ষক ঘটনা ঘটছে পশ্চিমবঙ্গে। সাম্প্রাদায়িক শক্তি বিজেপির উত্থান ঠেকাতে তৃণমূল যথেষ্ট কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে নি। মমতার শাসনে তিন থেকে সত্তর আসনে পরিবর্ধিত হয়েছে বিজেপি। ভারতের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতেও তৃণমূল অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষ দৃঢ় ও স্বচ্ছ অবস্থানের বদলে দোদুল্যমান থেকেছে।

দুর্নীতি ও সুশাসনের প্রশ্নে বার বার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে তৃণমূল। চাকরি নিয়ে সীমাহীন দুর্নীতি, কয়লা, গরু পাচার, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস প্রসঙ্গেও অভিযোগের তীর বারবার বিদ্ধ করেছে তৃণমূলকে। এসবক্ষেত্রে কখনোই আত্মসমালোচনা বা আত্মশুদ্ধির পথের ধারেকাছেও যায় নি তৃণমূল।

তৃণমূলের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলোকে প্রায়শই কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের ষড়যন্ত্র বলা হলেও মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় গ্রেফতার ও কোটি কোটি নগদ টাকা সামনে আসায় মমতার নেতৃত্বাধীন তৃণমূলের মুখ কালো হবে স্বাভাবিকভাবেই। যে মমতা ভারতের আঞ্চলিক রাজনীতিতে নিজের উত্থান ঘটিয়ে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে শক্তিশালী ও সম্মানজনক অবস্থান পাওয়ার সম্ভাবনায় উজ্জ্বল ছিলেন, তাকেই এখন দলীয় নীতি ও নেতাদের কর্মকাণ্ডের জন্য নিষ্প্রভ মুখ করে চলতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষিত, উদার ও নীতিনিষ্ঠ নাগরিকদের চোখের সামনে মমতা ও তৃণমূলের যে ক্ষত তৈরি হয়েছে, তা অবক্ষয়ের পথই প্রশস্ত করবে। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে নীতিভ্রষ্টতা, স্বৈরতান্ত্রিকতা ও দুর্নীতির যে বিষবৃক্ষ তৃণমূলকে ঘিরে তৈরি হয়েছে, সাধারণ ভোটাররা তা আর সহ্য না-ও করতে পারে। ফলে একথা বলা যেতে পারে যে, বিপদের মুখে পশ্চিমবঙ্গে মমতা শাসনের ভবিষ্যৎ।

তবে, সবচেয়ে বড় বিপদ তৈরি হবে মমতার পরের পরিস্থিতিতে। সাম্প্রাদায়িক বিজেপি মমতার বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান। বামপন্থী ও কংগ্রেস তুলনায় অনেক পেছনে। ফলে একদা বিজেপি-মিত্র মমতা নিজে নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার আগে বিজেপির উত্থান ঘটিয়ে গেলে পশ্চিমবঙ্গের অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির উদারতান্ত্রিক পরিবেশের বারোটা বাজবে।

অতএব, মমতা ও তৃণমূলের সঙ্কটকে আবর্তিত করে পুরো পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিই চরম অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হবে সামনের দিনগুলোতে, যা ঐতিহ্য ও গৌরবের বঙ্গীয় রাজনীতির জন্য আগাম অশনিসঙ্কেত স্বরূপ।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪ কম

এ সম্পর্কিত আরও খবর