পথিকৃৎ সাংবাদিক মানিক মিয়া'র অন্যরকম মৃত্যুদিবস

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 14:24:51

১ জুন, ১৯৬৯ রাওয়ালপিন্ডি, পাকিস্তানে মৃত্যুবরণকারী বাংলাদেশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও আপোষহীন সাংবাদিকতার পুরোধা ব্যক্তিত্ব তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া'র অন্যরকম মৃত্যুদিবস পালিত হলো এবার। মরহুমের কনিষ্ঠ পুত্র সাবেক মন্ত্রী ও ইত্তেফাক সম্পাদক আনোয়ার হেসেন মঞ্জু ফেসবুক স্ট্যাটাসে জানান, "আজ আমার বাবা গণমুখী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া'র ৫৩ তম মৃত্যুবার্ষিকী। আজিমপুরে মরহুমের কবরে মিলাদ ও মোনাজাতে অংশগ্রহণ করি আমি এবং আমার বড় ভাই ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন।"

পিতার ৫৩ তম মৃত্যুবার্ষিকীর আগে দুইপুত্রকে একসাথে শেষ কবে দেখা গিয়েছিল, তা চট করে বলা যাবে না। আশি দশকের শেষে ও নব্বই দশকের শুরুতে ইত্তেফাক ভবনে কর্মসূত্রে দুইভাইকে একত্রে দেখার অভিজ্ঞতা আমার মতো অনেকেরই নেই। দু’তলায় ইত্তেফাকের সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন আর তৃতীয় তলায় সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলতে গেলে পৃথক অবস্থানে থেকে পত্রিকা পরিচালনা করতেন। তাদের রাজনৈতিক অবস্থান আর বিশ্বাসও ছিল পরস্পরবিরোধী।

দুজনে শত অমিলের মধ্যেও প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইত্তেফাক ভারসাম্য ও নিয়মনিষ্ঠায় পরিচালিত হতে পেরেছিল এবং মোটের উপর তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া'র গণতন্ত্র ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নীতি মান্য করতে পেরেছিল কাঠামোগত শক্তিতে ও ব্যক্তিত্ববান সাংবাদিকদের কারণে। অতীতের সেইসব বরেণ্য ব্যক্তিগণ উভয় মালিকের মধ্যে কার্যকরী সংযোগসূত্র রূপে কাজ করে ইত্তেফাকের নিরপেক্ষ অবস্থান, পেশাগত বিশুদ্ধতা ও গতিকে নিশ্চিত করেছিলেন।

বহু বছর পর মানিক মিয়া'র দুইপুত্রকে একসাথে দেখা আরেকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। আর তা হলো, সাংবাদিকতার মান, মর্যাদা ও স্বাধীনতা বর্তমানে ক্রমক্ষয়িষ্ণু। ভেতরের ও বাইরের নানা আঘাতে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা জর্জরিত। দুষ্টপুঁজি, ভ্রষ্টনীতি ও নষ্টলোকের পাল্লায় সাংবাদিকতার অধঃপতন ও অবক্ষয় তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এমতাবস্থায়, মানিক মিয়া'র স্মরণ ও আলোচনা জরুরি। এবং সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্রের মর্যাদা রক্ষায় বনেদি ও ত্যাগী প্রতিষ্ঠান ইত্তেফাক-সংশ্লিষ্টদের ভূমিকাও কম নয়।

কারণ, বাংলা সংবাদপত্রের ইতিহাসে কলকাতার আনন্দবাজার শতবর্ষ স্পর্শ করেছে এ বছর। আজাদ লুপ্ত হওয়ায় ইত্তেফাক তেমনই এক ঐতিহাসিক দৈনিক, যার আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ভূমিকা ইতিহাসের অংশ। সেই ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের দায়ও বহুলাংশে তাদের উপর বর্তায়।

ইত্তেফাকের সম্পাদকীয় বিভাগে স্বল্পকালীন যুক্ত থাকার সময় আমার সৌভাগ্য হয় মানিক মিয়া'র নির্বাচিত কলাম গ্রন্থাকারে সংকলনে ভূমিকা পালনের। তার কলামগুলো পড়লে যে কেউই, কোনটা রেখে কোনটা বাদ দেবেন, তা নির্ধারণ করতে পারবেন না। ভাষায়, যুক্তিতে, বিদ্রূপে, আঘাতে প্রতিটি লেখাই তৎকালের স্বাধীনতাকামী বাঙালির মর্মমূলে আলোড়ন জাগিয়েছিল এবং স্বৈরশাসকের বুকে কাঁপন ধরিয়েছিল। তখন মাঠে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আর ইত্তেফাকে মানিক মিয়া ছিলেন বাঙালির অধিকার আদায়ের ভ্যানগার্ড।       

তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার জন্ম ১৯১১ সালে পিরোজপুর জেলা জেলার ভান্ডারিয়া গ্রামে। তার বাবার নাম মুসলেম উদ্দিন মিয়া। শৈশবেই মানিক মিয়ার মা মারা যান। গ্রামের পূর্ব ভান্ডারিয়া মডেল প্রাইমারি স্কুলে মানিক মিয়ার শিক্ষা জীবনের শুরু। সেখানে কিছুদিন পড়ার পর তিনি ভর্তি হন ভান্ডারিয়া হাই স্কুলে।

স্কুল জীবন থেকেই তার মেধার পরিচয় পাওয়া যায়। তখন থেকেই তিনি ছিলেন সহচর-সহপাঠীদের কাছে ক্ষুদে নেতা। ভান্ডারিয়া স্কুলে মানিক মিয়া অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। তারপর চলে যান পিরোজপুর জেলা সরকারী হাই স্কুলে। সেখান থেকেই তিনি কৃতিত্বের সাথে মেট্রিক পাশ করেন। ১৯৩৫ সালে মানিক মিয়া ডিস্টিংশনসহ বরিশাল বিএম কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন।

১৯৪৮ সালেই পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিরা মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে রাজপথে নামে। এই ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই বাঙালির পাকিস্তান মোহ কিছুটা কাটতে থাকে। ১৯৪৯ সালে মুসলীম লীগের বিরোধী প্রতিষ্ঠান হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হয়। একই বছরে এই রাজনৈতিক দলের মুখপত্র হিসেবে আবির্ভাব ঘটে সাপ্তাহিক ইত্তেফাক-এর। আবদুল হামিদ খান ভাসানী পত্রিকাটির আনুষ্ঠানিক সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ১৯৫১ সালের ১৪ আগস্ট থেকে মানিক মিয়া এই পত্রিকার পূর্ণ দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

১৯৫৩ সালে তার সম্পাদনায় সাপ্তাহিক ইত্তেফাক মানিক মিয়া'র নেতৃত্বে দৈনিক ইত্তেফাকে রূপান্তরিত হয়। এ সময়ে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকা আইয়ুব খানের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সামরিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে ১৯৫৯ সালে প্রতিষ্ঠাতাসম্পাদক মানিক মিয়া এক বছর জেল খাটেন।

১৯৬৩ সালে তিনি আবার গ্রেফতার হন। এ সময় দৈনিক ইত্তেফাকের প্রকাশনা নিষিদ্ধ এবং নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্ত করা হয়। এর ফলে তার প্রতিষ্ঠিত অন্য দুটি পত্রিকা ঢাকা টাইমস ও পূর্বাণী বন্ধ হয়ে যায়।

গণআন্দোলনের মুখে সরকার ইত্তেফাকের ওপর বিধি-নিষেধ প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। ফলে ১৯৬৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি পত্রিকাটি আবার প্রকাশিত হয়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টির লক্ষ্যে তিনি ইত্তেফাকের রাজনৈতিক হালচাল ও পরবর্তী সময়ে মঞ্চে নেপথ্যে কলামে মোসাফির ছদ্মনামে নিয়মিত উপসম্পাদকীয় লিখতেন। 

১৯৬৩ সালে তিনি আন্তর্জাতিক প্রেস ইন্সটিটিউটের পাকিস্তান শাখার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৬৪ সালে কাশ্মীরে সৃষ্ট দাঙ্গা ঢাকায় ছড়িয়ে পড়লে তা প্রতিরোধে স্থাপিত দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির প্রথম সভাপতি হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন।

ইত্তেফাক ও মানিক মিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক আন্দোলন, মুক্ত সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার সংগ্রামদীপ্ত গৌরবময় ইতিহাসের অবিচ্ছেদ অংশ এবং অনিবার্য প্রেরণাস্থল। মৃত্যুদিনে বাংলাদেশের সাংবাদিকতার কীর্তিমান, অগ্রণী ও পথিকৃৎ ব্যক্তিত্ব মানিক মিয়া'র প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম।

এ সম্পর্কিত আরও খবর