বিশ্বব্যাপী শ্রীলংকার ভুল থেকে শিক্ষা নেয়ার তাগিদ

, যুক্তিতর্ক

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মদ (অবঃ) পি এইচ ডি   | 2023-08-30 04:54:25

আজ থেকে ৪০০ বছরেরও বেশী আগে ইংরেজ কবি ও নাট্যকার উইলিয়াম শেকসপিয়ার তাঁর অনবদ্য নাটক ‘হেমলেট’ এর রাজা ক্লডিয়াসের (Claudius) প্রধান পরামর্শকরূপে ‘পলোনিয়াস’ (Poloneous) নামক একটি চরিত্র সৃষ্টি করেন। কালজয়ী এই নাটকের প্রথম অংশের তৃতীয় দৃশ্যে ‘পলোনিয়াস’ তাঁর পুত্র ‘লয়ের্টিস’ (Lecrtes) কে প্যারিসে যাত্রার পূর্বে একটি মূল্যবান উপদেশ দেন; যার সারমর্ম হলো “কখনও ঋণদাতা অথবা ঋণ গ্রহিতা হবে না। এতে অর্থ ও বন্ধুত্ব দুটোই হারাবে’। সম্প্রতিকালে বন্ধু হিসাবে বিবেচিত চীন থেকে অবাধে ঋণ নিয়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটে পড়া শ্রীলংকা এবং ঝুঁকিতে থাকা আরও কিছু দেশের করুন হাল দেখে ৪০০ বছর আগের লেখা হেমলেট নাটকের এই সংলাপটি স্মরণ করেছে ভারতীয় ইংরেজী সাপ্তাহিক ‘ওপেন’ (সূত্র: ওপেনঃ ২৮ মার্চ ২০২২)

আজ থেকে ২৭৭ বছর আগে (১৭৪৫ সাল) ইংল্যান্ডের রাজনীতিবিদ, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট সেমুয়েল জনসন (Samuel Johnson) এক রাজনৈতিক পর্যালোচনা সভায় দেশ প্রেমের ধোঁয়াতুলে মতলববাজ ও পথভ্রষ্ট তথাকথিক রাজনীতিবিদদের সতর্ক করে বলেছিলেন “বদমাশদের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল হল দেশ প্রেম”। আর সে কথাই স্মরণ করেছেন শ্রীলংকার পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় এবং রাষ্ট্রপতির এক সময়ের উপদেষ্টা এবং পশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত পন্ডিত হারিম পেইরিস । (সূত্র: ভারতীয় ‘দি স্টেটস্ ম্যান; ০৩ ফেব্রুয়ারি’২২)

ঠিক একযুগ আগের অর্থাৎ ২০১০ সালের এমনি এক মে মাসের ঘটনা। শ্রীলংকার সদ্য বিদায়ী এবং বিতর্কিত প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজা পাকসে তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে, কারণ তাঁর নেতৃত্বেই তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদিদের বিরুদ্ধে চলা ২৬ বছরের রক্ষক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ বা কাউন্টার ইনসারজেন্সি ওয়ার (Counter Insurgency War) শেষ হয়। তখন  (মে ২০১০) মাহিন্দা রাজা পাকসে দেশের রাষ্ট্রপতি তথা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারি হিসাবে ঐ গৃহযুদ্ধ থেকে শিক্ষনীয় বিষয় ও জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার দিক নির্দেশনা তৈরি করতে শ্রীলংকার এটর্নি জেনারেল সি আর ডি সিলভার (C.R De Silva) নেতৃত্বে ‘লেসন্স লার্নন্ট এন্ড রিকনসেলিয়েশাল কমিশন’ (Lessons Learnt and Reconciliation Commission)  গঠন করেন। ভাগ্যের করুন পরিহাস এবং ভুলের কারণে ক্ষমতা হারানো সেই মাহিন্দা রাজা পাকসে এবং সার্বিক ভাবে শ্রীলংকা থেকে শিক্ষা নেয়ার তাগিদ আসছে বিশ্বের তাবৎ গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

মূলত: ২০১০ সালের পর থেকেই শ্রীলংকাকে সাবধান করে একের পর এক প্রতিবেদন, গবেষণাপত্র এবং নিবন্ধ প্রকাশিত হতে থাকে। বিশ্ব সংস্থা ও বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকেও সতর্ক করা হয় শ্রীলংকাকে। ঠিক ২ বছর আগে অর্থাৎ ২০ মে ২০২০ তারিখে শ্রীলংকারই নাগরিক সাংবাদিকদের (সিটিজেন জার্নাালিস্ট) ওয়েব সাইট ‘গ্রাউন্ড  ভিউজ’ (Ground Views) এ দেশটির রাজনীতিতে ১০টি ভুলের কথা তুলে ধরা হয়। তথ্যমতে ২০২০ সালেল ০২ মার্চ কভিডের ক্রান্তিকালে দেশের রাষ্টপতি নেন্দসে গোতাবায়া রাজাপাকশে মেয়াদ পূর্তির ৬ মাসের আগেই জাতীয় সংসদের রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে পরামর্শ ছাড়াই সংসদ ভেঙ্গে দেন এতে পরবর্তী নির্বাচন সংবিধানের ৭০ (৫) ধারা মোতাবেক ৯০ দিনের মধ্যে কভিড জনিত কারণে আয়োজনের বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতির প্রজ্ঞাপনে ১৪ মে ২০২০ তারিখে নির্বাচনের কথা বলা হলেও নির্বাচন কমিশন পৃথক প্রজ্ঞাপনে ২ জুন ২০২০ তারিখে অর্থাৎ সংসদ ভাঙ্গার ৯০ দিনের পরিবর্তে ১০৮ দিনের মাথায় নির্বাচনের ঘোষণা দেন। এই বিষয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের উপদেশ নেয়ার জন্য নির্বাচন কমিশন প্রস্তাব করলেও তা আমলে নেয়নি রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া। বহু নাটকের পর ০৫ আগস্ট ২০২০ তারিখে নির্বাচন হলেও কোন দলই এই নির্বাচনে একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা পায়নি। ফলে শুরু হয় দর কষাকষির রাজনীতি। যার করুন পরিণতি রাষ্ট্রপতির ভাই প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দার অপমানজনক বিদায়।

অন্যদিকে সংসদীয় নির্বাচনে কোন আসনে জয়লাভ না করেও নির্ধারিত কোটায় মনোনিত ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির সবেধন নীলমনি নেতা ও ৪ বার মেয়াদ পূর্তির আগে বিদায় নেয়া প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রানিল বিক্রমাসিং এর প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণের (১২ মে ২০২২) নাটকীয় ঘটনা ঘটে। রাজনীতিকে কলুষিত করে শিক্ষত, ভদ্র, সৎ ও গ্রহণযোগ্যদের রাজনীতি বিমুখ করার পরিণাম এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক বলে মন্তব্য বিশ্লেষক সমাজের। পরিবারতন্ত্র, গোষ্ঠিতন্ত্র, কিচেন কেবিনেট কিংবা সরকারের ভেতর সরকার থাকলে একটি দেশের পরিণতি কি হতে পারে; শ্রীলংকা তারই একটি সাম্প্রতিক নজির বলে মনে করে দেশ বিদেশের বেশ কিছু গণমাধ্যম। এদেশের নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত এক ওয়েবিনারের বরাতে ইংরেজী দৈনিক দি নিউজ টাইমস ২৪ এপ্রিল ২০২২ তারিখে শ্রীলংকার আর্থিক সংস্থা সর্বোদয় (Sarvodaya) ডেভেলপমেন্ট ফিনান্স লিঃ এর চেয়ারম্যান এবং প্রতিরক্ষা অর্থনৈতিক বিশ্লেষক চান্না ডি সিলভার কিছু বিশ্লেষণ তুলে ধরেছে। তার মতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শ্রীলংকার মোট বার্ষিক বাজেটের প্রায় ৭৫ শতাংশের নিয়ন্ত্রন ছিল রাষ্ট্রপতি নন্দসেনা গোতাবায়া রাজাপাকসে ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হাতে। বিশ্ব মিডিয়ায় শ্রীলংকা সংকটের জন্য বার বার উচ্চাতি হয়েছে রাষ্ট্রপতির বড় ভাই সদ্য ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজা পাকসের নাম। আরও উচ্চারিত হয়েছে রাষ্ট্রপতির মেঝভাই সদ্য ক্ষমতাচ্যুত কৃষিমন্ত্রী চমল জয়ন্ত রাজাপাকসে এবং ছোট ভাই সদ্য ক্ষমতাচ্যুত অর্থমন্ত্রী বাসিল রোহানা রাজা পাকসের নাম। বাদ পড়েনি মাহিন্দা রাজা পাকসের ৩৬  বছর বয়সী পুত্র (রাষ্ট্রপতির ভাতিজা) সদ্য বিদায়ী যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রী লক্ষণ নামাল রাজা পাকসের নামও। এর মধ্যে বাসিল রাজা পাকসে ২০২০ সালে কোভিড মোকাবিলায় গঠিত টাস্ক ফোর্সের নেতৃত্ব দেন। উল্লেখ্য রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া ও তার ভাতিজার (মন্ত্রী) বাসিল একই সাথে শ্রীলংকা ও আমেরিকার দ্বৈত নাগরিক।

বৈশ্বিক অর্থখাতের সংবাদ, তথ্য উপাত্ত, বিশ্লেষণ ও গবেষণার জন্য জগৎ সেরা প্রতিষ্ঠান নিউইয়র্ক ভিত্তিক ‘ব্লুম বার্গ’ (Bloomberg)। প্রতিষ্ঠানটির এশিয়া সংস্করণের প্রকাশনায় ২৭ এপ্রিল ২০২২ তারিখে দি নিউ ইয়র্ক টাইমসের দক্ষিণ এশিয়া ব্যুরোর রিপোর্টার কাই স্কুল্টজ একটি নিবন্ধ লিখেছেন। এই প্রতিবেদন মতে একটি শক্তিশালী পরিবারতন্ত্র মাত্র ৩০ মাসের মধ্যে শ্রীলংকাকে দেউলিয়ায় পরিণত করেছে। এজন্য দায়ী করা হয় রাষ্ট্রপতি গোতাবাায়া, তার তিন ভাই (প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও কৃষিমন্ত্রী), ভাতিজা (যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রী) এবং কয়েক ডজন আত্মীয়-পরিজনকে, যারা গড়ে তুলে ছিলেন ক্ষমতার বলয়। এতে এই পরিবারকে মার্কিন লেখক, নাট্যকার ও সাংবাদিক মারিত্ব পূঁজো রচিত ‘গড ফাদার’ নাটকের মূল চরিত্রের মত ক্ষমতাশীল ব্যক্তি তৈরীর কেন্দ্র বিন্দু এবং শ্রীলংকার শাসন ব্যবস্থাকে প্রচ্ছন্ন বা সহনীয় মাত্রার এক নায়কতন্ত্রের’ সাথে তুলনা করা হয়। মূলত: আর্থিকখাত এবং রাজনীতিসহ অন্যান্য ভুলের মধ্যে এই প্রতিবেদনে ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর ১৫ থেকে ৮ শতাংশে নামানো, চীন ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থা থেকে মাত্রাতিরিক্ত ঋণগ্রহন, ঋণ পরিশোধে  বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনার অভাব, ভুল পথে বা আপাতঃ আনুৎপাদনশীল মেগাপ্রকল্পে বিপুল পরিমাণ ঋণের টাকা ব্যয়, জাতীয় ঐক্যের বদলে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেও ধর্মগোষ্ঠি তথা সিনহালী বুদ্ধদের কাজে লাগানোর চেষ্টা,  জ্বালানি তেল নির্ভর বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, মানবাধিকার লংঘন, দূর্নীতি, যুদ্ধ অপরাধ, কোভিড জনিত সংকট মোকাবিলায় ব্যর্থতা, সামরিক বাহিনীকে দিয়ে গায়ের জোরে সব কিছু ঠিক করার প্রচেষ্টা, স্বচ্ছতার অভাব, জনগণকে সংকট মোকাবিলার জন্য সচেতন করতে ব্যর্থতা, সুশাসনের অভাব, নিত্যপ্রয়োজনীয় ও ভোগ্যপণ্য জোগানে ব্যর্থতা, ১০ বছরে বৈদেশিক ঋণ দ্বিগুণ হয়ে যাওয়া, অর্বাচীনের মতো রাতারাতি সিঙ্গাপুর হওয়ার অলিক স্বপ্ন, ২০১৯ সালে ইস্টার সানডে’তে সন্ত্রাসী হামলা, পর্যটন ও প্রবাসী শ্রমিকদের আয়ের উপর মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরশীলতা, আকস্মিকভাবে রাসায়নিক সারের ব্যবহার নিষিদ্ধ করার বিষয়গুলো প্রাধান্য পায়।

যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক অনলাইন নিউজ ম্যাগাজিন ‘দি ডিপ্লোমেট’ এর ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখের সংখ্যায় অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় সাড়ে ৯ মাস আগে শ্রীলংকার রাষ্ট্রপতি ও সামরিক জান্তাদের এক হাত নিয়েছিলেন ম্যাগাজিনটির দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সম্পাদিকা সূধা রামাচন্দ্র। ২৬ এপ্রিল ১৯৭১ থেকে ০১ নভেম্বর ১৯৯১ পর্যন্ত টানা সাড়ে ২০  বছর শ্রীলংকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকশে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে সেনাবাহিনীতে চাকরী করেন। ২০০৫ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১০ বছর মেয়াদে তাঁকে গায়ের জোরে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সচীব তথা অলিখিতভাবে তিনবাহিনীর প্রধান করা হয়। তবে প্রতিরক্ষার গন্ডি পেরিয়ে তিনি রাজধানী কলম্বোর সৌন্দর্য বর্ধনসহ নানা মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নেরও দায়িত্ব পালন করেন। শ্রীলংকায় সংকট দেখা দিলে স্বাভাবিকভাবে একজন প্রাক্তন সেনা কর্মকর্তা ও প্রাক্তন প্রতিরক্ষা সচীব হিসাবে সর্বাগ্রে সেনানিয়োগের মাঝেই সমাধান খুঁজতেন গোতাবায়া। বিদূষী সাংবাদিক সূধা খাদ্যসহ ভোগ্য পণ্যের সংকট মোকাবিলায় রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া কর্তৃক মেজর জেনারেল সেনারাথ নিউনহেলা’কে ‘জরুরী সেবা প্রদানের কমিশনার’ হিসাবে নিযুক্তির বিষয়টি তুলে ধরেন। এই জেনারেল খাদ্য গুদামে হানা, ব্যবায়ীদের জিজ্ঞাসাবাদ ও তল্লাশি, মূল্য বৃদ্ধির অপরাধে গ্রেফতারের মতো সামরিক কায়দায় সমস্যার সমাধান খুঁজেন, যা দীর্ঘ মেয়াদে কাজে আসেনি। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় গঠিত ‘ন্যাশনাল অপারেশান সেন্টার ফর প্রিভেনশান অব কভিড-১৯ অডিট ব্রেক’ নামক শক্তিশালী টাক্সফোর্স গঠন করা হয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বা স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের বদলে এই টাস্ক ফোর্সের প্রধান করা হয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল সাভেন্দ্র সিলভাকে । ২০২১ সালের জানুয়ারী মাসে আরও ২৫ জন মেজর জেনারেল কে ২১ জেলার করনা মহামারি মোকাবিলার সার্বিক দায়িত্ব প্রদান করা হয়। জেনারেলদের সান্ধ্য আইন ও ধরপাকড়সহ নানা সামরিক তত্ত্বের প্রয়োগ সত্ত্বেও শ্রীলংকায় করোনা জনিত মৃত্যু হার বিশ্বের সর্বাধিক মৃত্যুর হারের কাছাকাছি। সামরিক কায়দায় যে সব জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মিমাংসা হয় না, সেটাই প্রমাণ করল শ্রীলংকা।

মালয়েশিয়ার জাতীয় বার্তা সংস্থার সাবেক প্রধান ও বহু দেশী বিদেশি সম্মাননা বিজয়ী প্রধান সাংবাদিক আজমান উজাং  স্থানীয় ‘দি সান’ প্রত্রিকায় ২১ এপ্রিল ২০২২ তারিখে শ্রীলংকা সংকট থেকে মালয়েশিয়ার জন্য শিক্ষণীয় বিষয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন। দেশের প্রাক্তণ অর্থ সচীব তান শ্রী শরীফ কাসেমের বরাতে এই সাংবাদিকের তীর সরকার কর্তৃক অতিমাত্রায় ভর্তূকী দেয়ার দিকে। বিশেষত জ্বালানি বাবদ বাৎসরিক ২০ বিলিয়ন রিঙ্গিত ভর্তূর্কি এবং শেয়ারের মূল্য ধরে রাখার উদ্দেশ্যে প্রচ্ছন্নভাবে বহুজাতিক বিদ্যুৎ কোম্পানি তেনেগা ন্যাশনাল ভর্তূকি প্রদানের তীব্র সমালোচনা করেন। ভর্তূর্কি দিলেই গরিরেব উপকার হবে, এই সমাজতান্ত্রিক ধারণাকে অর্থনীতির দুষ্টচক্র বলে চিহ্নিত করে তিনি দাবি করেন। মিশর কিংবা গ্রীস আগেই এই দুষ্ট চক্রের বলি হয়েছে, আর এখন হল শ্রীলংকা। কারণ এর ফলে সরকার দেউলিয়া হয়ে পড়লে আদতে গরিবদেরই ভোগান্তিতে পড়তে হয়। তখন অর্থ সংকটে ব্যাংক ঋণ বন্ধ হয়ে গেলে দেশের শিল্পপতিরাও উৎপাদন করার সক্ষমতা হারায়। উদাহারণ হিসাবে বলা যায় সরকারী ভর্তূকি দিয়ে সস্তায় পানি বা বিদ্যুৎ সরবরাহ করলে অপচয়ের হার বেড়ে যায়। সুতরাং দেখা যায় যে, ভর্তুকির ফসল গরিরেব চেয়ে ধনীর ঘরেই বেশী জমা হয়। প্রবন্ধের শেষে বলা হয় জনগন যখন সস্তায় বা বিনামূল্যে কিছু পায়, রাজনৈতিক সরকার তা পরিবর্তন করতে পারে না। ফলে অর্থনীতিতে পচন ধরে। আর অর্থনীতিতে পচন ধরলেই রাজনীতিতে পচন ধরে।

এসব প্রবন্ধ এবং পর্যালোচনার বাইরে আরও কয়েক ডজন লেখা প্রকাশিত হয়েছে দেশ-বিদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং মূলধারার গণমাধ্যমে। এসব লেখার আলোকে দেখা যায় জনগণ অতীতের অর্জন দ্রুত ভুলে যায়, বর্তমান সংকট সামনে আসার কারণে। চাটুকারিতা করে সরকারকে বিভ্রান্তকরা মানুষেরাই সংকটে সুর পাল্টায়। সংকটকালে আগের মত বিশ্বসংস্থা বা বিদেশি রাষ্ট্র অন্ধভাবে এগিয়ে আসে না বরং অনেক ছক কষে পা ফেলে। বিদেশি পেশী শক্তি বা বিদেশি মারণাস্ত্রের চেয়ে বৈদেশিক মুদ্রা তথা ইউরো, রুবেল বা ডলারই এখন বিশ্বের চালিকা শক্তি। জার্মানের প্রখ্যাত স্থপতি এবং ১৮৭১-১৮৯০ মেয়াদের চ্যান্সেলর অটো ভন বিসমার্ক বলেছিলেন “বোকারাই কেবল নিজে ভুল করে কিছু শিখে। যারা বুদ্ধিমান, তারা অন্যের ভুল থেকে শিক্ষা নেয়।” একথা আজ সর্বজন বিদিত যে শ্রীলংকা ভুল করেছে। ভুলের শব্দ শোনা যায় পাকিস্তান, নেপাল, লেবানন, গ্রীস এমনকি খোদ ইংল্যান্ড থেকে। বিশ্বের এই ক্রান্তিকালে আমরা নিজেদের ভুলের খেসারত নয়, বরং অন্যের ভুল থেকে শিখব, এটাই প্রত্যাশা।

লেখকঃ গবেষক, কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক , ইমেই- directoradmin2007@gmail.com

এ সম্পর্কিত আরও খবর