তেল নিয়ে তেলেসমাতি ও মঈনুদ্দীনের সাথে কথোপকথন

, যুক্তিতর্ক

মো. বজলুর রশিদ | 2023-09-01 13:56:55

মঈনুদ্দীন মিয়া একজন রিকশা চালক। আমার অফিসের সামনে প্রায়ই অপেক্ষা করে যাত্রীর জন্য। গত কয়েক বছর যাবত সে ঢাকা শহরে বসবাস করে পরিবার নিয়ে। ব্যক্তিগত কাজে কোথাও যেতে হলে মঈনুদ্দীনের রিকশাতেই যাতায়াত করি। এবারে ঈদের পরে তার রিকশায় ধানমন্ডি এলাকায় যেতে যেতে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কেমন আছ মঈনুদ্দীন? দিনকাল চলছে কেমন? ঈদ কেমন কাটল? অত্যন্ত হতাশার সুরে সে জবাব দিল, গরীবের আর থাকা কি স্যার! যা ইনকাম তা দিয়ে তো আর জীবন চলে না। জিনিসপাতির যে দাম তাতে সংসার আর চলে কই? রিকশা টাইন্যা শরীর শ্যাষ; জীবনও শ্যাষ! তার কথায় আক্ষেপের সুর।

আমি আর কথা বাড়াতে পারলাম না। ঝিম ধরে রিকশায় বসে থাকার চেষ্টা করলাম। কিন্তুু পারলাম না। এক সিএনসি এসে মঈনুদ্দীনের রিকশার পিছনে বেমক্কা ধাক্কা দিল। পড়তে পড়তে বেঁচে গেলাম। মঈনুদ্দীন সিএনজি চালককে ‘হালার পুুঁত’ বলে কষে এক গালি দিল। তাতে কোনো কাজ হলো না। সিএনজি চালক নির্বিকার মুখে সিএনজির মুখ অন্যদিকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। আমিসহ মঈনুদ্দীনের রিকশা বিশাল এক বাসের পিছনে ও ডানে-বাঁয়ে অন্যান্য যানবাহনের ফাঁকে আটকে পড়লাম। ট্রাফিকের জ্যাম। মিনিম্যাম দশ মিনিটতো লাগবেই জ্যাম ছাড়াতে। বিরক্তি নিয়ে বসে থাকলাম আর চারদিকের অবস্থা দেখতে লাগলাম। মঈনুদ্দীন তার গামছা দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল, ঢাকা শহরের অবস্থা কী হইছে দ্যাখছেন স্যার। মানুষ ক্যামনে যে এই শহরে থাকে বুঝবার পারি না। আমি শুধু বললাম উপায় কী? জীবিকার তাগিদে তো থাকতেই হবে। তুমি যেমন আছ, আমি আছি, অন্যরাও আছে।

মঈনুদ্দীন বলল সবাই কিন্তু জীবিকার জন্য নেই স্যার । অনেকেই আছে ধান্ধাবাজি করতে। দেখছেন না ত্যাল নিয়া কী কা-টায় না চলছে। ঈদের আগে কেজি খানেক গরুর মাংস কিনছিলাম। ৭৫০ টাকা দিয়া। আমার একদিনের ইনকাম। ভাবলাম পোলাপানরা অনেকদিন গরুর মাংস খাইতে পাই নাই। আমি নিজেও তার স্বাদ ভুলতে বসছিলাম। রান্ধন করার সময় বউয়ে কইল ত্যাল নাই। দোকান থেকে ত্যাল নিয়ে আস। বোতল হাতে দিয়া ছোট পোলাটারে দোকানে পাঠাইলাম ত্যাল আনবার জন্য। পোলা খালি বোতল নিয়া ফির‌্যা কয় দোকানথো ত্যার নাই। শেষে আমি নিজেই বারাইলাম। ঘটনাতো সত্য। হালার কোনো দোকানে এক ফোটা ত্যাল নাই। শ্যাষম্যাষ ওর মায়ে কথথোন একটু ত্যাল আইনা রান্ধন সারল। আর এহন শুনি গুদাম থেইক্যা খালি ত্যাল বেরাইতেছে। ব্যবসায়ীগো দোকান। এরা তো স্যার জীবিকার তাগিদে নাই। আছে ধান্ধাবাজি কইরা মানুষরে কষ্ট দিয়া পয়সা বানাবার তালে। আমি বললাম সেকথা ঠিক। তবে তাদেরকে তো ধরারও হচ্ছে। জরিমানা করা হচ্ছে অবৈধভাবে তেল মজুদ রাখার জন্য।

মঈনুদ্দীন এবার একটু ক্ষেপে গেল মনে হয়। ঝাজের সাথে বলল জরিমানাতো স্যার এখন যারা করতাছে তাদেরই করন লাগে। এরা আগে আছিল কই। এই কাজটা যদি ঈদের আগে করত- তাহলে তো মানুষগো ত্যাল নিয়া কষ্ট হইত না। আমার পোলাপানও স্বাদ কইরা একটু গরুর মাংস খাইতে পারত। মঈনুদ্দীন আফসোস ভরা কণ্ঠে বলতে লাগল। এরা তো সবই জানে। তয় আগে থেকে অ্যাকশন লইনা ক্যান?

আমি বললাম, অ্যাকশান নিলে সমস্যা আছে মঈনুদ্দীন। যারা তেল আমদানি করে তারা আমদানি বন্ধ করে দিতে পারে। তখন আরো বেশি সমস্যা দেখা দিবে। মানুষ এখন যেটুকু পাচ্ছে তখন তাও পাবে না। সমস্যা আরো প্রকট হবে। মঈনুদ্দীন বলল এরা বন্ধ করবে কিল্লাই? সরকার আছে না? সরকার ব্যবস্থা নিব। আমি বললাম, সরকার ইচ্ছা করলেই ব্যবস্থা নিতে পারে না। কারণ মুক্তবাজার অর্থনীতি। সরকারের একার পক্ষে তেল আমদানি করা সম্ভব না। তাছাড়া যুদ্ধের জন্য এখন অনেক দেশ তেল রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। সামনে অবস্থা আরো খারাপ হবে বলে সবাই বলাবলি করছে। মঈনুদ্দীন এতো কিছু বুঝল কিনা জানি না। হঠাৎ জ্যাম ছুটে যাওয়ায় সে রিকশা চালাতে শুরু করল।

রিকশা চালাতে চালাতেই সে আবার জিজ্ঞাসা করল স্যার হুনছিতো আমাগো দ্যাশ থেইকা অনেক গার্মেন্টস-এর কাপড় বিদেশ যায়। তয় আমাগো দ্যাশ যদি কাপড় দেওন বন্ধ কইরা দেয় তয় ওইসব দেশের কী হইব? পিন্দনের কাপড় পাইব কই? শরমে পড়বতো? মঈনুদ্দীনের এই কথায় আমি একটু অবাক হলেও স্বাভাবিকভাবেই বললাম- মঈনুদ্দীন অনেক দেশ আছে যেখানে আমাদের দেশ থেকে কাপড় না নিলেও সমস্যা নেই। কারণ শীতকাল বাদে গরমের দিনে তাদের কাপড় চোপড় খুব একটা প্রয়োজন হয় না। একটা গেঞ্জি ও হাফ প্যাণ্ট হলেই তাদের চলে যায়। মঈনুদ্দীন বলল মাইয়ারাও কি তাই পরে? আমি বললাম- হ্যাঁ, মেয়েরাও প্রায় একই ড্রেস পরে। সে শুধু বলল- তাজ্জব দেশ! আমি বললাম তাছাড়া আমরা কাপড় না দিলেও তারা অন্য দেশ থেকে নিবে। তাদের সমস্যা হবে না।

মঈনুদ্দীনকে জিজ্ঞাসা করলাম তোমার কাছে কী মনে হয়- আমাদের দেশটা চলছে কেমন? আমাদের প্রধানমন্ত্রী দেশ কেমন চালাচ্ছে? জবাবে সে বলল প্রধানমন্ত্রীতো দেশটা ভালই চালাইতেছে। দেশের অনেক উন্নতি করছে। আমার এক বোনে তার দেওয়া ঘর পাইছে। কিন্তু হের লগে আর যারা সরকার চালাইতেছে তাদের মধ্যে দেশের প্রতি মহব্বত কম। দেশের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর মতো মায়া এদের মধ্যে নাই। মায়া থাকলে ত্যাল নিয়া সমস্যা হয়ত না। ত্যালের মতো আরো অনেক সমস্যা হইত না। এতো সমস্যা প্রধানমন্ত্রী একা কিভাবে সামলাইব। সবাই যদি প্রধানমন্ত্রীর মতো হইত- মঈনুদ্দীনের গলায় আক্ষেপ উথলে ওঠে। রিকশা চলতে থাকে।

মো. বজলুর রশিদ, সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

 

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর