রেলসেবা: অসদাচরণ ও কথিত আত্মীয়তা

, যুক্তিতর্ক

কবির য়াহমদ | 2023-08-30 05:07:23

যাত্রীদের সঙ্গে ‘খারাপ আচরণের’ কারণে মো. শফিকুল ইসলাম নামের রেলের এক ভ্রাম্যমাণ টিকেট পরিদর্শককে (টিটিই) ‘সাময়িক বরখাস্ত’ করা হয়েছে। ‘আশা জাগানিয়া’ সংবাদ নিঃসন্দেহে। রেলসেবায় রেলের দায়িত্বশীলরা মানুষের সঙ্গে খারাপ আচরণের শাস্তি এভাবে পেতে থাকলে কেবল রেলই নয়, সরকারের সুনাম উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে।

মো. শফিকুল ইসলাম নামের রেলের ওই টিটিইকে সাময়িক বরখাস্তের যে ঘটনা সেটা গত বুধবার রাতে খুলনা থেকে ঢাকাগামী আন্তঃনগর সুন্দরবন এক্সপ্রেসের একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সূত্র ধরেই। বিনাটিকেটে রেলভ্রমণের কারণে তিন যাত্রীকে জরিমানা করেছিলেন টিটিই শফিকুল। গণমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে, ওই যাত্রীরা নিজেদের পরিচয় দিয়েছিলেন রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের স্ত্রীর ভাগনে পরিচয়। মন্ত্রীর স্ত্রীর ভাগনে পরিচয়, তবু টিটিই তাদেরকে জরিমানা করে সুলভ কামরায় পাঠিয়ে দেন। রাত পেরুলে শফিকুল ইসলাম নিজের বরখাস্তের আদেশ শুনেন। ঈশ্বরদীর পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (ডিসিও) নাসির উদ্দিনের নির্দেশে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় বলে জানা যায়।

শুরুতে যে বরখাস্তের আদেশকে ‘আশা জাগানিয়া’ সংবাদ বলছিলাম তা আর বলা যাচ্ছে না পূর্বাপর জানার পরে। খারাপ আচরণে কারণে বরখাস্ত বলে যে দাবি করা হচ্ছে তা সবৈব মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয় যখন বিনাটিকেটে রেলযাত্রীরা নিজেদেরকে মন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় দিয়েও পার পাননি। জানি না ওখানে খারাপ আচরণ আদৌ হয়েছিল কিনা। তবে এসি কামরা থেকে সুলভ কামরায় পাঠানোর পথ পরিক্রমায় আত্মীয়তার পরিচয় দিয়ে প্রভাব খাটানোর যে চেষ্টা সেখানে স্বাভাবিক অনেক কিছুই নাও ঘটতে পারে। তদন্তের আগে বিস্তারিত জানা সম্ভব হবে না এর।

বিনাটিকেটে রেলভ্রমণ অপরাধ। আবার ওই অপরাধীরা মন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় দিয়ে প্রভাব ও ক্ষমতা দেখিয়ে আরেক অপরাধ করেছে। একের পর এক অপরাধে তারা স্বাভাবিকভাবেই বেপরোয়া থাকতেও পারে। তাদের অভিযোগের সূত্রে রেলের ওই টিটিইকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এই বরখাস্তের প্রক্রিয়ায় তার কাছ থেকে কোন বক্তব্য তাৎক্ষণিক নেওয়া হয়নি। এখানে যে অন্যায়ভাবে প্রভাব খাটানো হয়নি তা কে বলবে? মন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় এখানে কি মুখ্য হয়ে ওঠেনি? কেন এত তাড়াহুড়া এই বরখাস্তের আদেশে? ঘটনার পর গত দুইদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এনিয়ে তোলপাড় শুরু হলে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন ওই যাত্রীদের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা অস্বীকার করে বলছেন, ওরা কেউ তার ‘আত্মীয় নন’। মন্ত্রীর এই বক্তব্য স্বাভাবিক হিসেবেই ধরে নিচ্ছি, কারণ সত্যি-সত্যি সম্পর্ক থাকলেও এইধরনের কিছু কেউ কখনও স্বীকার করে না, সে সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি এখনও আমাদের!

রেলমন্ত্রীর ওই যাত্রীদের সঙ্গে তার আত্মীয়তার সম্পর্ক অস্বীকার করলেও রেলে যাত্রীদের সঙ্গে রেল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্ব্যবহারের বিষয়টি মেনে নিয়েছেন। তার ভাষ্য, ‘মাঝেমধ্যেই টিটিইরা বিভিন্নভাবে যাত্রীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন, বিভিন্নভাবে হেনস্তা করেন। এমন অভিযোগ আমরা প্রায়ই পাচ্ছি। তবে লোকবল সঙ্কটের কারণে আমরা এসবের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারি না। তবে একেবারেই ছাড় দিলে রেলের দুর্নাম হয়ে যায়। তাই টিটিইদের (শফিকুল ইসলামের সাময়িক বরখাস্ত) বিরুদ্ধে এমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’

মন্ত্রী আরও বলছেন, ‘আমরা রেলসেবা বাড়াতে কাজ করছি। বিনা টিকিটের যাত্রী যদি মন্ত্রীর আত্মীয়ও হয়, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।’

রেলসেবা বাড়াতে মন্ত্রীর যে অঙ্গীকার এটা আমাদেরকে আশাবাদী করছে। ‘মন্ত্রীর আত্মীয় হলেও ছাড় দেওয়া হবে না’ বলে যে কথা বলছেন এটাতেও আস্থা রাখতে চাই। তবে যে দ্রুততার সঙ্গে ‘লোকবলের সঙ্কট’ থাকা সত্ত্বেও ওই টিটিইর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা একপ্রকার নজিরবিহীনও, অন্তত এমন সংবাদ সচরাচর চোখে পড়ে না। অভিযোগের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুততার সঙ্গে এই ব্যবস্থাও সন্দেহের জন্ম দিচ্ছে। ‘মন্ত্রীর আত্মীয়’ পরিচয় সামনে না এলে কি ‘খারাপ আচরণের’ জন্যে এত দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হতো—প্রশ্নটা তাই রেখে যেতে হচ্ছে!

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মো. ইমরুল কায়েস প্রান্ত নামের একজনের হস্তাক্ষরে একটা অভিযোগ প্রচার হয়েছে। পত্রের সত্য-মিথ্যা যাচাই করা সম্ভব না হলেও সেখানে দেখা যাচ্ছে, তিনি জানাচ্ছেন কাউন্টারে টিকেট নাই শুনে স্টেশনে থামা একটা রেলে তারা ওঠে পড়েন। টিটিই তাদের কাছে অতিরিক্ত টাকা দাবি করলে তারা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন এবং রেলের ওই কর্মচারী তাদের সঙ্গে অসদাচরণ করেন। কেবল তাই নয়, ওই টিটিই নাকি ‘মাদকাসক্ত’—এমনও অভিযোগ করেছেন তিনি। টিটিই মাদকাসক্ত হওয়ায় তারা ‘লজ্জিত’ হয়েছেন বলেও অভিযোগপত্রে লিখেছেন। টিটিই যদি সত্যি-সত্যি মাদকাসক্ত হয়ে থাকেন এটা রেলবিভাগের জন্যে লজ্জার। বিনাটিকেটে রেলভ্রমণকারী ওই যাত্রীরা লজ্জা পেয়েছেন, যদিও বিনাটিকেটে রেলভ্রমণ নিয়ে তাদের কোন অনুশোচনা অন্তত লিখিত পত্রে পরিস্কার হয়নি।

রেলের কর্মকর্তারা টিটিই শফিকুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করেছেন যাত্রীদের সঙ্গে অসদাচারণের জন্যে, মন্ত্রীও বলছেন খারাপ আচরণের কথাটাও। রেলসেবা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতিও মন্ত্রীর কণ্ঠ দিয়ে। কিন্তু অভিযোগের ওই মাদকাসক্ত থাকার বিষয়টি কেন উপেক্ষা করা হচ্ছে? তারা কি অভিযোগের একটা অংশকে গ্রাহ্য করে অন্য অংশগুলোকে অগ্রাহ্য করে যাচ্ছেন? এ থেকে কি প্রমাণ হয় না অযাচিত প্রভাব ও পরিচয়ের বিষয়টি? ‘মন্ত্রীর আত্মীয়’ পরিচয় ও প্রভাবে কি অসদাচরণের বিষয়টি ঢাল হিসেবে উপস্থাপিত হচ্ছে না এখানে?

আমরা বলছি না রেলসেবা আশানুরূপ আমাদের, এখানে সেবা যেমন পাচ্ছে না মানুষ তেমনি বিনাটিকেটে রেলভ্রমণকারীও আছে। বিনাটিকেটে রেলভ্রমণ যেখানে অপরাধ সেখানে অপরাধীর সকল অভিযোগকে একবাক্যে মেনে নিতেও কিছুটা অপেক্ষার কথা বলি; বলি তদন্তের কথাও। টিটিই অসদাচরণ করলে, মাদকাসক্ত হয়ে থাকলে তার শাস্তি দাবি করি; পাশাপাশি ‘মন্ত্রীর আত্মীয়’ পরিচয়ে প্রভাব ও ক্ষমতা দেখিয়ে রেলভ্রমণকারীদের শাস্তিও দাবি করি। মন্ত্রীর পক্ষ থেকে আত্মীয়তার সম্পর্ক অস্বীকার ‘রুটিনওয়ার্ক’ এখানে, কারণ মন্ত্রী নিজেও সেটা তদন্তের সূত্রে বলেননি, বলেছেন কেবলই সমালোচনা থেকে বাঁচতে!

এ সম্পর্কিত আরও খবর