সনদী বেকারদের সুখী নতুন বছর কেমন?

, যুক্তিতর্ক

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম | 2023-08-30 05:47:42

ডিগ্রিধারী বেকারদের জন্য নতুন বছর সুখী না অসুখী বার্তা বয়ে আনে তা নিয়ে কেউ কি কিছু ভাববার অবকাশ মনে করে? একেকটি চাকরিতে আবেদন করার ফি বা টাকা যোগাড় করার জন্য তাদেরকে কত কষ্ট স্বীকার করতে হয় তা তো শুধু ভুক্তভোগীরাই অনুধাবন করতে পারে, অন্য কেউ নয়। তাও যদি ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয় তাহলে কারো জন্য চাকরি নামক সোনার হরিণ ধরা দেয়- সবার কপালে তা নয়। নতুন বছরের আগমন তাদের জন্য হতাশার। কারণ, এত তাদের চাকরির সরকারি বয়সসীমা ও সামাজিক সমাযোজনের সময় পার হয়ে যাবার আতঙ্ক তৈরি  হয় শুধু।

দেশে এখন উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা শতকরা চল্লিশ ভাগ। এই সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। শিক্ষিত সনদধারী বেকারদের এই সংখ্যা লাগামহীনভাবে বেড়ে যেতে থাকায় ওনাদের পরিবারগুলো যেমন হতাশ সাথে সরকারী কর্তৃপক্ষও কিভাবে এই সমস্যা সমাধান করবেন তা ভেবে পাচ্ছেন না। কারণ, ক্রমবর্ধমান সনদধারী বেকারদের এই সংখ্যার সাথে তাল মিলিয়ে চাকরির বাজার সম্প্রসারণ করা কঠিন ব্যাপার।

আমাদের দেশের ছোট্ট পরিসরে তৈরি অবকাঠামোর মধ্যে এ পর্যন্ত যে চাকরি সেবাদান প্রক্রিয়া চালু রয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় বড় অপ্রতুল। বিসিএস, ব্যাংক, প্রতিরক্ষাবাহিনী, ছোট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তৈরি পোশাক, বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও এনজিও ইত্যাদি মিলে যেসব কর্মক্ষেত্র ও পরিষেবা খাত রয়েছে সেগুলো ছাড়া ভাল কিছু লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এসব ছোট তৈরি কাঠামোতে জনবল নিয়োগ খুব বেশী লাগে না, চাওয়াও হয় না। অথচ প্রতিটি পদের জন্য প্রতিযোগিতা করেন লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত বেকার নর-নারী। সবার লক্ষ্য তৈরি কাঠামোতে প্রবেশ করা। এর জন্য বাঁধভাঙা প্রতিযোগিতায় হিমশিম খাওয়ার অবস্থা।

একটি চাকরির পদ লাভের জন্য লড়াই হাজার জনের। কখনো বা লক্ষ জনের। এজন্য বাঁধভাঙা প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা প্রমাণ করতে না পেরে শুরু হয় অবৈধ পথের অনুসন্ধান। এ থেকে জন্ম নেয় তদবির বা লবিং। আর এই তদবির বা লবিং থেকে জন্ম নেয় দুর্নীতি। এছাড়া এক তথ্যে জানা গেছে সনদী বেকার দের সাথে চাকরি দেবার নামে নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে নানা প্রতারণার কথা। একদিনে (অক্টোবর ০৮) ১৪টি চাকরির লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার তারিখ ঘোষিত হয়েছিল। কেউ কেউ কোনরকমে দুটিতে অংশ নিতে পেরেছে। এসব চাকরিতে আবেদন করতে গড়ে প্রতি প্রার্থীর আড়াই হাজার টাকা করে খরচ হয়েছে। গেল বছর নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের শুক্র ও শনিবার দু’দিনে মোট ২৯টি চাকরির পরীক্ষার তারিখ ঘোষিত হয়েছিল এসব অপরিকল্পিত ও সমন্বয়হীন নিয়োগ পরীক্ষা সনদী বেকারদের জন্য ভোগান্তি বৈ কিছু নয়।

ডিগ্রীধারী বেকারদের নিয়ে কেউ কি এসব কথা ভাবার অবকাশ মনে করে? নতুন বছরের আগমন তাদের জন্য চরম হতাশার। কারণ, এতে একদিকে তাদের চাকরির সরকারী বয়সসীমা পার হয়ে যাবার আতঙ্ক অন্যদিকে বিয়ের বয়স, মা-বাবা-ভাইবোন আত্মীয়দের সাথে দূরত্ব তৈরি হয় শুধু। আর জীবনের প্রতি জন্মে একধরণের ঘৃণা। এটা কোন সভ্য জাতির উচ্চশিক্ষিত মানুষদের মনের মধ্যে গেঁথে গেলে তা সত্যিই খুব লজ্জা ও আতঙ্কের বিষয়।

কৃষিপ্রধান দেশ হলেও আমাদের কৃষকের সন্তানরা আর কৃষিকাজে আগ্রহী নন। কারণ জমি চাষ করে প্রতিবছর সেখানে বিরাট ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছেন তারা। সংবাদমাধ্যমে জানা গেছে- বাংলাদেশে শতকরা আশিভাগ রাজনীতিবিদ ও সাংসদ ব্যবসায়ী। তাঁরা জনগণের ধরা মাছ নিজেদের বলে চালিয়ে দিয়ে জনগণকে দেন। সাধারণ জনগণ সচরাচর সেটার নাগাল পান না। শুধু নিকটস্থ চাটুকার জনগণ সেই সেবার সিংহভাগের ভোক্তা। এভাবে সমাজে একটি বঞ্চিত শ্রেণি নিয়মিত হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েছে। ফলে দেশে ভাতের আবাদ হলেও তার সঠিক সংরক্ষণ ও সুষম বন্টন নেই। আবাদীরা ক্ষতিগ্রস্ত ও হতাশ। একজন প্রান্তিক ধানচাষির বার্ষিক উৎপাদন ও আয় আর একজন ছোট চাকরিজীবীর বার্ষিক আয়ের মূল্য ও ব্যবধান অতি চরম। এই ধরনের আর্থিক ব্যবধান ও বৈষম্যের মুখে কল্যাণ অর্থনীতির সূত্র গোলমেলে হয়ে পড়েছে। এছাড়া গত দশ বছর ধরে চেষ্টার পর এখনও অনেক ক্ষেত্রে আছে লাগামহীন দুর্নীতি করার সুযোগ। একদিকে শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কাজ নেই অপরদিকে কোন কোন ক্ষেত্রে মনের মত ভাল কাজ ও ব্যক্তিমর্যাদা নেই। ফলে উপযুক্ত কাজের অভাবে মেধা পাচার হয়ে যায়-আর ফিরে আসে না।

দেশে প্রান্তিক কৃষক বা চাষীর মাসিক আয় ও চাকরিজীবিদের মাসিক আয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক তৈরি হওয়ায় কৃষকরা হতাশ হয়ে শেষ সম্বল ভিটেমাটি বা কৃষি জমিটুকু বন্দক রেখে বা বিক্রি করে তাদের কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সস্তানকে ঘুষ দিয়ে হলেও সরকারী চাকরির পাবার জন্য উৎসাহিত করছে। অধিকাংশ সময় তারা দেশে চাকরি পাবার প্রতিযোগিতায় ব্যর্থ হয়ে কোন কোন সময় বিভিন্ন দুয়ারে ধর্ণা দিয়ে ঘুষের টাকাটাও উদ্ধার করতে না পেরে আদরের সন্তানকে জীবন বাজি রেখে অবৈধ পথে বিদেশে পাঠাতে কুণ্ঠিত হচ্ছে না। সেখানেও বিপত্তি। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রচ্যে পুরুষ শ্রমিক তো বটে, শিক্ষিতা, সনদী মহিলা শ্রমিকদের নির্যাতিতা হয়ে মান-সম্ভ্রম খুইয়ে দেশে পালিয়ে আসার মত অপমানজনক ঘটনাগুলো আমাদের মাথা হেঁট করে দিয়েছে। দেশে চাকরি নেই, বিদেশে গেলেও বিপদ। তাহলে আমাদের সনদপ্রাপ্ত শিক্ষিত বেকার ছেলেমেয়েরা কোথায় ঠাঁই নেবে?

অনেকে বলেন- আমাদের দেশে সস্তায় হাইব্রিড চাল, মাছ মুরগি সবই পাওয়া যায়। বাজার ভর্তি খাদ্য সাজানো রয়েছে বিক্রির জন্য। বাসা ভাড়া পাওয়া যায়। হাসপাতাল হয়েছে অনেক দামি দামি। মানুষের গতি বেড়েছে। চাকরিতে অনেক পদখালি রয়েছে। একথাগুলোর সংগে আমি অমত নই। তবে অসংগতিগুলো লক্ষ্য করলে আমি বেশ হতাশ হয়ে যাই।

কারণ, আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যা কত? আয় বেড়েছে কতজনের? হয়তো কিছু মানুষের আয় বেড়েছে। গতি বেড়েছে কোন মানুষগুলোর? নিশ্চয়ই দালাল ও তদবিরকারী লোকগুলোর গতিই বেড়ে চলেছে! এই দালাল ও তদবিরকারী লোকগুলো দেশের অর্থনীতিকে মৌসুমী ইঁদুরের মত শোষণ করে আর্থিক প্রতিষ্ঠনগুলোর কাঠামো ধ্বংস ও মূলধন নিঃশেষ করে দিচ্ছে। গেল সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সেমিনারে বক্তারা আশংকা প্রকাশ করে বলেছেন- এনবিআর বিলিয়নস টাকা আর্থিক ডেফিসিটে ভুগছে। এছাড়া তাদের ধার-দেনা করার জায়গা সংকুচিত হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায় বিশেষ সাহায্য পাবার ব্যবস্থা করতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে দেশের মেগা উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

আমাদের বাজার ভর্তি খাদ্য ও অন্যান্য সামগ্রী সাজানো। কিন্তু আমার ক্রয় ক্ষমতা নেই। থাকলেও সেটা খুবই সীমিত। সস্তায় যেসব হাইব্রীড চাল, মাছ, মুরগি, তেল পাওয়া যায সেগুলো ভেজালে পরিপূর্ণ। দেশীটাও পাওয়া যায়। যার দাম আকাশচুম্বী। ধনীর জন্য দামি হাসপাতাল, বিদেশি ডাক্তার, বিদেশি দামি ওষুধ। এমনকি দেশী ভাল ডাক্তারদের ফি বেশি। গ্রামে-গঞ্জে এমনকি জেলা শহরের স্থানীয় হাসপাতালে তারা থাকেন না। লক্ষ লক্ষ ফ্লাট বাড়ি তৈরী হলেও সেগুলো নিম্ন আয়ের মানুষেরা পান না। হাজার হাজার চাকরির পদখালি শোনা যায়। নিয়োগ হয়ে গেলে দেখা যায় সামর্থ্যবানরাই কোন না কোন উপায়ে চাকরিগুলো লাভ করেছেন অথবা ক্ষমতাবলে কিনে ফেলেছেন! গরিবদের এখানেও ক্রয়ক্ষমতা হরিত! ঘুষ-দুর্নীতি ছাড়া এক শ্রেণির মানুষের নিকট চাকরি যেন সোনার হরিণ। এভাবে অর্থ ও ক্ষমতাশালীরা সমাজের সব সুবিধার ভোক্তা হয়ে উঠছেন এবং সনদধারী মেধাবী বিত্তহীনরা শত শত ভাইভা দেয়ার পরও নানাভাবে বঞ্চিত হয়ে আরো বেশি দুর্বল ও হতাশ হয়ে পড়ছেন।

একদিকে কর্মের সংগে সম্পর্কহীন ও সামঞ্জস্যহীন শিক্ষা ও সার্টিফিকেট, অন্যদিকে বৈষম্যপূর্ণ আর্থ-প্রশাসনিক কাঠামো, রাজনৈতিক ভাঁওতাবাজি দেশের অনৈতিক কাজের গতি বাড়িয়ে দিলেও মানুষের নৈতিক মেরুদণ্ড বাঁকা করে দিয়েছে।

উচ্চশিক্ষার সংগে গবেষণা ও উন্নয়ন নীতি ও পরিকল্পনার সংযোগ ঘটাতে হলে আমাদের পাবলিক, অ-পাবলিক সকল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণাগারকে শক্তিশালী করার সময় এসেছে। শুধু শুধু শিক্ষার পরিবেশ ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দরজায় সূর্য ডোবার পূর্বে তালা ঝুলিয়ে বাসা –বাড়িতে ঘুমাতে গেলে সময়ের অপচয় হবে। বরং দিন-রাত গবেষণা করে বের করতে হবে যেন লক্ষ লক্ষ সনদধারী বেকার তৈরি না হয়ে সনদধারী মানবসম্পদ তৈরি হয়। শিক্ষিত, জ্ঞানী ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে তৎপর হতে হবে। এজন্য নতুন বছরে সময় এসেছে জরুরি ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নতুন করে  ভাববার।

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

এ সম্পর্কিত আরও খবর