করোনার জন্য গহনা বিক্রি-ঋণে খাবি খাচ্ছে চারদিক

, যুক্তিতর্ক

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম | 2023-08-30 06:03:36

বহুদিন পর গত পরশু বিমানে চড়ে মা ঢাকা থেকে একাই রাজশাহীতে এলেন। কি যে খুশি লাগছে। গেল মার্চে নাতির বিয়েতে গিয়ে করোনাক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর মহান আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন তাঁর মনের সৎসাহস বাড়িয়ে দিয়েছেন। মা ছেলের নিকট ফিরে আসবেন তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার যত নিষেধাজ্ঞা থাকুক না কেন নিজেই এয়ারপোর্ট থেকে না আনলে কি চলে? মা অনেক কষ্ট স্বীকার করে নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে এখন অনেকটা ভাল আছেন বলে জানালেন।কিন্তু বাসায় ফিরে তার সংগে অনেক রাত অবধি কথা বলে আমার মনটা ভীষণ ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। তিনি অনেক দু:খের কথাও জানালেন। সেগুলো পরে বলছি।

কথা বলতে বলতে টিভি দেখছিলাম।সংবাদ উপস্থাপিকা নানা খবর উপস্থাপন করলেন। অনেক উন্নতির কথা, মেগা প্রজেক্টের কথা-শুনতে বেশ ভাল লাগছিল। তাই মায়ের কথা থেকে আমার মনযোগ একটু ভিন্ন দিকে সরে যাচ্ছিল। উপস্থাপিকা দেশের জিডিপি বেড়ে যাবার সুখবর দিলেন। করোনার মধ্যেও দেশের জিডিপি বেড়ে যাবে। এমনকি প্রতিবেশী দেশের তুলনায় আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়ে যাবে শুনে খুশী হতে লাগলো মনটা। খবরে হঠাৎ ট্রেনের প্রসঙ্গ এলো। ডেমু ট্রেনগুলো চায়না থেকে কেনা হয়েছিল শহরের মানুষের চাকুরীস্থলে সহজে যাতায়তের জন্য। ডেইলী প্যাসেঞ্জারী করে চলাফেরা করার নিরিখে। সেগুলোর অনেকটাই এখন নষ্ট। সামান্য যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে সেগুলো দিন দিন অকেজো হয়ে পড়ছে। আমাদের দেশে সেগুলো মেরামতের উপায় নেই। আমরা জানি চায়না জিনিষের ওয়ার টাইম জীবন। রিপেয়ার করলেও ওদের যন্ত্রাংশ এডজাষ্ট করে কোনকিছুতে আগের গতি ফেরানো যায় না।

আর জাপানীজ জিনিষ তো ওয়ান টাইম ব্যবহারের পর ওরা ফেলেই দেয়। কারণ মেরামতের জন্য ওদের লোকবল নেই। মেরামতের জন্য যে খরচ তার চেয়ে নতুন কেনা ওদের অভ্যাস। আমি পড়াশুনার জন্য বেশ কয়েক বছর জাপানে থেকে দেখেছি ওদের দেশে নিজেদের ব্যবহারের জন্য যেসব ইলেকট্রনিক সামগ্রী তৈরি হয় তা সহজে নষ্ট হয় না। আর কোন কারণে নষ্ট হলে সেগুলো গমিতে (গারবেজ) ফেলে দেয়। গাড়ির ক্ষেত্রেও তাই। গাড়িকে প্রতিবছর মেশিনের মধ্যে ঢুকিয়ে ফিটনেস টেষ্ট করানো হয়। মেশিন ফেল বললেই সেই গাড়ির আয়ু শেষ-চলে যায় গাড়ি ফেলে দেয়ার নির্দিষ্ট ভাগাড়ে। সেখানে গাড়ি ফেলে দিতে হলে তখন পাঁচ হাজার ইয়েন সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হতো। এখন কত লাগে জানি না।

ওরা বিদেশে রপ্তানী করার জন্য কমদামী জিনিষ তৈরি করে। যে দেশে পাঠাবে সেই দেশের ক্রয়ক্ষমতা মাথায় রেখে ওরা গাড়ি বানায়, বাজার ধরে রাখার জন্য। তাইতো জাপান থেকে সরাসারি দেশে আনা পুরনো গাড়িগুলো আমদানী করা নতুন গাড়ির চেয়ে মানে অনেক ভালো।

ডেমুর মেয়াদ ছির ২৫ বছর। কিন্তু ছয়-সাত বছরের মাথায় বিকল হবার খবর শুনে বেশ খারাপ লাগলো। এর মূল কারণ, আমাদের মেইটেন্যান্স মানসম্মত নয় এবং রেল লাইনের অবস্থা তথৈবচ। ভাবতে ভাবতে মেট্রো রেলের কথা মনে হলো। কোবের ভূমিকম্পে গোটা শহরের আকাশরেলের কংক্রীটের রাস্তা উল্টে যাবার দৃশ্য মনে পড়লো। সে এক বিভীষিকাময় অসহনীয় অবস্থা্। শত শত ক্রেণ দিয়েও সেসব কংক্রীটের টুকরা সরানো বেশ কঠিন কাজ ছিল।তাদের অর্থনীতি ও প্রযুক্তি অত্যন্ত উন্নত হওয়ায় তারা কোবের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্থ আকাশ রেলের গারবেজ সরাতে পেরেছিল। তবুও পুনরায় নতুন আকাশরেল চালু করতে বেশ কয়েক বছর লেগে যায়।

আমরা ওদের প্রযুক্তি কিনে মেট্রো রেল চালু করতে যাচ্ছি। এটা বড় সুখবর যে আমাদের কেনার সক্ষমতা তেরী হয়েছে। কিন্তু পাশপাশি আমাদের মেইটেন্যান্স মানসম্মত করার জন্য যথাযথ সুব্যবস্থা তৈরি হচ্ছে না। সেটা দ্রুত করতে হবে। সেজন্য দেশীয় প্রকৌশলীদের এক্ষুনি ভাবতে হবে।কারণ ভাড়া করা প্রকৌশলীর মজুরি, বেতন আকাশচুম্বি। তা করতে গেলে ডেমুর মত দুরাবস্থা হবে।

যাহোক্, আবার মায়ের কথায় মনযোগ দিলাম। মা করোনায় এতটাই কাতর হয়েছিলেন যে টয়লেটে যেতে পারতেন না।পায়ে পানি জমে হাঁটতে পারতেন না। খেতে পারতেন না। তার আগে যে বিয়েতে গিয়েছিলেন সেই বিহাই সাহেব মেয়ের বিয়ে দেবার সাতদিন পর করোনায় মৃত্যুবরণ করেন। এরপর তার চোখের সামনে আরেক প্রিয় বিহাইন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। যে বাসায় তিনি ছিলেন সেখানকার সব সদস্যের মধ্যে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়েছিল। মায়ের এক মেয়ে (উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা) করোনাক্রান্ত হয়ে ১৬ দিন হাসপাতালে থেকে মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামীনের অশেষ রহমতে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন। ঢাকায় তখন করেনার পিক সময়। আমরা কারো সংগে দেখা করতে যাব সে উপায় ছিল না। এত কষ্টের মধ্যে থেকে মা নিজের মনকে শক্ত করে বাঁচার চেষ্টা করেছেন।

এর পরের ঘটনা আরো খারাপ। জেলা শহর নাটোর থেকে কিডনী রোগের চিকিৎসা করতে গিয়েছিলেন মায়ের এক ভাতিজি এবং জামাই। তাদের চিকিৎসা ভালই চলছিল। কিন্তু হঠাৎ জানা গেল তারা উভয়ই করোনাক্রান্ত। দু’জনকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হলেও তাঁরা আর আমাদের মাঝে ফিরে আসেননি। এই করুণ মৃত্যু তাদের ও আমাদের পুরো পরিবারকে গভীর শোকে আচ্ছাদিত করে ফেলেছে।

আমাদের অনেক বন্ধু, কাছের ও দূরের আত্মীয়, পরিচিতজন, করোনাক্রান্ত হয়ে অর্থাভাবে চিকিৎসা করতে না পেরে মৃত্যুবরণ করেছেন। অনেকে বিয়ের সোনার গহনা বিক্রি করে স্বামীর চিকিৎসার টাকা যোগাড় করেও আইসিইউ-এর সম্পূর্ণ বিল পরিশোধ করতে না পেরে মৃত্যুপথযাত্রী রোগীকে বাড়িতে নিয়ে গেছেন। এক আত্মীয় করোনায় চাকুরী হারিয়ে ধার দেনা করে স্বর্বস্বান্ত হয়ে শেষে নিজের বাড়িভাড়ার বকেয়া টাকা দিতে না পেরে কাউকে না বলে নিজেকে ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে আত্মহত্যা করেছেন।নিজের অভাবের কথা কাউকে জানানোর লজ্জা থেকে মুক্তি পেতে আত্মাহুতির ঘটনা কি জানান দেয় আমাদের সমাজকে? আরো কত ঘটনা যে আমাদের অলক্ষ্যে ঘটে গেছে-এই করোনাকালে তা কি আমরা সব জানি? যারা কোনভাবে হাসপাতালে গেছে, তাদের কথা জানি। গ্রাম-গঞ্জের অনেক তথ্যই আমাদের অজানা।

এখন দেশে সবার চিকিৎসার জন্য ইন্স্যুরেন্স নেই।করোনা তো পিছু ছাড়ছেই না-তার ওপর ডেঙ্গু এস ভর করেছে। চিকিৎসা খরচ এত বেশী যে দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষ টাকার অভাবে হাসপাতালে যেতে ভয় পান। যারা সাহস করে হাসপাতালে যান তাদের পরিবারগুলো জমি-জমা, সহায় সম্বল বিক্রি করে নিকটজনকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন।

বলা হচ্ছে, জীবন আগে, জীবিকা পরে। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করছি- সামান্য মশার কামড়ে জীবনপাত হচ্ছে, সরকারি স্বাস্থ্য সেবায় সবার জন্য স্বাস্থ্যবীমা না থাকায় মানুষ সেবা নিতে অপারগ হচ্ছে। টাকার অভাবে চিকিৎসা না পেয়ে হাজার হাজার মানুষ প্রতিনিয়ত কাৎরাচ্ছে। চারদিকে ঋণে খাবি খাচ্ছে মানুষ, খাবি খাচ্ছে দেশ। খবরে জানা গেল, সারা বিশ্বে ঋণগ্রস্থ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ২য়। আমাদের দেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমান ৪৯ হাজার ৪৫৮ মিলিয়ন ডলার (ডেইলি স্টার, সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২১)। দেশে জন প্রতি মাথাপিছু ঋণ ২৯২.১১ ডলার বা ২৪,৮৯০ টাকা।জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বাড়িয়ে সুষম খাদ্য, সুশিক্ষা, সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা আগে না ওয়ান টাইম ডেমু ট্রেন বা মেট্রো ট্রেনের বগী কিনে প্রতিদিন প্রচার করা আগে? ডেমু বা মেট্রো অকেজো হয়ে গারবেজে পড়ে থাকলে রুগ্ন, অদক্ষ মানুষ কি সেগুলোর যন্ত্রাংশ বানাতে পারবে বা মেরামত করা যোগ্যতা রাখবে? এসব ভাবতে ভাবতে রাত অনেক হয়ে গেল। বহুদিন পর মাকে কাছে পেয়ে মনটা খুশী হলেও দেশে যেসব মা-বাবারা চিকিৎসা করতে না পেরে সম্বল হারিয়ে হতাশায় জবিন কাটাচ্ছেন তাদের কথা ভেবে মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল।

লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর সাবেক চেয়ারম্যান। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

এ সম্পর্কিত আরও খবর