নোয়াগাঁও-তাণ্ডব, ঝুমন দাস ও পুলিশের ভূমিকা

, যুক্তিতর্ক

কবির য়াহমদ | 2023-08-31 11:57:39

দিরাইয়ের হিন্দু পল্লিতে হামলার চারদিন পর সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন সুনামগঞ্জের তৎকালীন পুলিশ সুপার (এসপি) মো. মিজানুর রহমান। ওই সংবাদ সম্মেলনে তিনি ঝুমন দাস আপনের রাজনৈতিক পরিচয় টেনে এনে বলেছিলেন সে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এসপির দাবি, ঝুমন দাস শাল্লা উপজেলা ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। যদিও উপজেলা ছাত্রদলের আহবায়ক দাবি করেন ঝুমন ছাত্রদলের কোনো অনুমোদিত কমিটির পদে ছিলেন না, এবং দুই বছর আগে ফেসবুকে এক স্ট্যাটাস দিয়ে ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে নিজের সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন।

ঝুমন দাসের রাজনৈতিক পরিচয় প্রসঙ্গ ফের আলোচনায় নিয়ে আসার কারণ এসপির বক্তব্য। হিন্দু ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত একটা গ্রামে সাম্প্রদায়িক হামলার পর প্রশাসনের দৃষ্টি কোনদিকে ছিল সে ইঙ্গিত দেওয়া। সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে পুলিশ প্রশাসন ঝুমন দাসকে সরকারবিরোধী একটা রাজনৈতিক দলের নেতা বানিয়ে দেওয়ার একটা চেষ্টা চালিয়েছিল। এখানে তাকে একতরফা দোষী সাব্যস্ত এবং ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত যে ছিল সে বলাই বাহুল্য। হয়েছেও তাই। ঝুমনের পুরো গ্রাম আক্রান্ত হলেও পুলিশের দৃষ্টিতে সেও অপরাধী। তাকে আটক করে প্রথমে চুয়ান্ন ধারায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়, এরপর তার বিরুদ্ধে দেওয়া হয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা। সেই মামলায় আজ প্রায় ছয় মাস ধরে কারাগারে ঝুমন দাস আপন।

ঝুমনের কী অপরাধ? একটা ফেসবুক স্ট্যাটাসই ত! এই ফেসবুক স্ট্যাটাসে কি কারও ওপর হামলার উসকানি ছিল? ছিল না। এই ফেসবুক স্ট্যাটাসে কি সামাজিক শৃঙ্খলা বিনষ্টের কোন রসদের উপস্থিতি ছিল? ছিল না। এই স্ট্যাটাস উসকানিমূলক ছিল না, তবে পুলিশের ধারণা, পুলিশের প্রবল বিশ্বাস, পুলিশের দৃষ্টিতে এটা উসকানিমূলক। সংবাদ সম্মেলনে এসপি তাই বলে ওঠেন- ‘ঝুমন দাসের ফেসুবক পোস্টের জেরেই দিরাই ও শাল্লার কয়েকটি গ্রামের কয়েকশ মুসলিম মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে জড়ো হন। তারা মিছিল করে, স্লোগান দিয়ে প্রতিবাদ জানান। এই খবর পেয়ে শাল্লা থানার পুলিশ সেখানে যায় এবং ঝুমন দাসকে আটক করে। দোষী ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার আশ্বাস দিলে উত্তেজিত জনতা শান্ত হয়ে ফিরে যায়।’ এসপি বলেছেন ‘উত্তেজিত জনতা শান্ত হয়ে ফিরে যায়’, আসলে কি তাই? বাস্তবতা হলো পরেরদিন তারা হামলা করে, হিন্দু অধ্যুষিত নোয়াগাঁওয়ে ভাঙচুর, লুটপাট চালায়। পুলিশ কর্মকর্তার ওই অসত্য কথনে ঝুমন দাসকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার অধ্যায়ই প্রণীত হয়েছে। তাই অপরাধ না করেও প্রায় ছয় মাস ধরে কারাগারে এই যুবক। জামিনের আবেদন নিয়ে আদালতে-আদালতে ঘুরছেন স্বজনেরা। জামিন মিলছে না।

যে ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে ঝুমন দাস অপরাধ না করেও এতদিন ধরে বিনাবিচারে কারান্তরীণ সেই ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি হেফাজত নেতা মুহাম্মদ মামুনুল হকের সমালোচনা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে-গুঁড়িয়ে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়ার হুমকিদাতা মামুনুলসহ হেফাজত নেতাদের সমালোচনার পাশাপাশি তার স্ট্যাটাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে স্বাগত জানানোর প্রসঙ্গও ছিল। তার এই স্ট্যাটাসে ধর্মের অবমাননা হয়েছে এমন প্রচার চালানোর প্রেক্ষাপটে গ্রামবাসীরা নিজেদের বাঁচাতে ঝুমন দাসকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। তবে শেষ রক্ষা হয়নি তাদের। মামুনুল ও হেফাজত অনুসারীরা নোয়াগাঁওয়ে তাণ্ডব চালায়।

১৫ মার্চ দিরাইয়ে শানে রিসালাত সম্মেলনে মামুনুল হক ও জুনায়েদ বাবুনগরীর (প্রয়াত) হিংসাত্মক বক্তব্যের পরেরদিন ঝুমন দাসের ফেসবুক স্ট্যাটাস, ওইদিনই তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া সত্ত্বেও ১৭ মার্চ আক্রান্ত হয় নোয়াগাঁও। গ্রামবাসীরা আক্রান্ত হওয়ার দিনই পুলিশ নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে ঝুমন দাসকে চুয়ান্ন ধারায় গ্রেপ্তার দেখায়। ২২ মার্চ তার বিরুদ্ধে দেওয়া হয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা। এখানে কেবল ঝুমন দাসের বিরুদ্ধে মামলাই নয়, শাল্লায় হিন্দু বাড়িঘরে হামলা ঠেকাতেও পুলিশের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। হামলার ঘটনা ঘটতে পারে জেনেও পুলিশ আগে থেকে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ভিডিয়োতেও হামলাকারীদের সঙ্গে পুলিশকে দেখা গেছে যারা এই হামলা ঠেকাতে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এনিয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটিও হয়েছে। ঘটনা তদন্তে সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি মফিজ উদ্দিনকে প্রধান করে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি ২৬ এপ্রিল পুলিশ সদর দপ্তরে প্রতিবেদন জমা দেয়।

পুলিশের গাফিলতির প্রমাণ পাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয় তদন্ত প্রতিবেদনে। এতে পুলিশ সুপারসহ ১১ জনকে বদলি এবং ৬ জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়। সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান, সুনামগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জয়নাল আবেদীন, দিরাই সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবু সুফিয়ান, সুনামগঞ্জ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) আলী পাঠান, শাল্লা থানার ওসি নাজমুল হক ও দিরাই থানার ওসি আশরাফুল ইসলামসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।

শুরুতে উল্লেখ করেছিলাম ঝুমন দাস আপনকে নিয়ে পুলিশের দৃষ্টিভঙ্গি। আটক থেকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ফাঁসিয়ে দেওয়া সবটাই হয়েছে পুলিশ সদস্যদের অতি-উৎসাহী ভূমিকার কারণে। সাদামাটা একটা ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক হামলার শঙ্কা থাকা সত্ত্বেও পুলিশ গ্রামবাসীকে রক্ষা করতে উদ্যোগী হয়নি। হামলার পর ঝুমন দাসের অপ্রমাণিত রাজনৈতিক পরিচয়কে সামনে এনে নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করতে চেয়েছিল তারা। পুলিশ কর্মকর্তাদের ওই ভূমিকার কারণে ঝুমন দাস এখনও কারাগারে। তার পরিবার এখনও ন্যায়বিচারের আশায় ঘুরছে আদালতে-আদালতে।

ঝুমন দাস ন্যায়বিচার পাননি, ন্যায়বিচার পাচ্ছেন না। প্রায় ছয় মাসের এই কারাবাস অপরাধ প্রমাণের আগে তার প্রতি অন্যায়-সম। ন্যায়বিচার প্রাপ্তির অধিকার তার জন্মগত। তাকে জামিন দিন। জামিন করুণা নয়, অধিকার। 

লেখক: কবির য়াহমদ: লেখক, সাংবাদিক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর