করোনাকালে শীতল পাটি কারিগরদের সমস্যা ও করণীয়

, যুক্তিতর্ক

ড. মতিউর রহমান | 2023-08-29 21:40:42

“আসুক আসুক মেয়ের জামাই, কিছু চিন্তা নাইরে, আমার দরজায় বিছাই থুইছি, কামরাঙা পাটি নারে” পল্লীকবি জসিমউদদীন তাঁর ‘নকশীকাঁথার মাঠ’ কাব্যগ্রন্থে ‘কামরাঙা’ নামক শীতল পাটির বর্ণনা এভাবেই দিয়েছেন। আগের দিনে যখন বিদ্যুৎ ছিল না, তখন কাঁথা বা তোশকের ওপর মিহি বেতের নকশি করা এক ধরনের পাটি ব্যবহার হতো। তাতে গা এলিয়ে দিলে শরীর বা মনে শীতলপরশ অনুভূত হতো। সম্ভবত এজন্য এর নাম দেওয়া হয় শীতল পাটি।

শীতল পাটি বাংলার সুপ্রাচীন এক কুটির শিল্পের নাম। শীতল পাটি আমাদের সভ্যতা, কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের অংশ। এছাড়া বাংলাদেশের শীতল পাটি এখন বিশ্ব ঐতিহ্যেরও তালিকায় অর্ন্তভুক্ত। জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো আনুষ্ঠানিকভাবে এ স্বীকৃতি প্রদান করেছে।

এক সময় সারাবিশ্বে ছিল শীতল পাটির খ্যাতি। আমাদের গৃহস্থালির নানা দরকারি জিনিসের মধ্যে বিশেষ স্থান জুড়ে আছে এ পাটি। গরমের সময় এ শীতল পাটির ঠা-া পরশে শ্রান্তি ও ক্লান্তি দূর করে। মানুষের জীবনযাত্রার এক অনন্য অনুষঙ্গ হচ্ছে শীতল পাটি। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার এ যুগে এসেও পাটির চাহিদা এতটুকু কমেনি।

টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার সিংহরাগি ও হিংগানগর গ্রামের প্রায় একহাজার পরিবার শীতল পাটি বুনে জীবিকা নির্বাহ করছেন। বংশ পরস্পরায় প্রায় ২শ’ বছর ধরে তারা শীতল পাটি বুনার পেশায় নিয়োজিত আছেন। সরকারি কোনো সহযোগিতা না পাওয়া ও মধ্য সত্বভোগীদের দৌরাত্বের কারণে অনেকেই তাদের বাপ দাদার এ পেশা ছেড়ে দেয়ার চিন্তা ভাবনা করছেন।

টাঙ্গাইল শহর থেকে ১০-১২ কিলোমিটার দক্ষিণে সিলিমপুর পার হলেই হিংগানগর ও সিংহরাগি গ্রাম। গাছপালা ঘেরা ছায়া সুশীতল এই গ্রামের সবাই হিন্দু ধর্মালম্বী। দুই এক ঘর মুসলমানও আছে। শীতল পাটি বুনেই এরা সংসার চালান। পুরুষের পাশাপাশি গ্রামের সব মহিলারাও পাটি বুননের কাজ করে থাকেন। শীতল পাটির বেতি তৈরী ও বুনন অত্যন্ত কঠিন কাজ।

সম্প্রতি টাঙ্গাইলের সিংহরাগি ও হিংগানগরে এই শিল্পে জড়িত পাটিকর সম্প্রদায়ের লোকজনের সাথে আলাপকালে জানা যায় করোনাকালীন সংকটে পড়েছেন টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী শীতল পাটির কারিগররা। করোনার প্রথম ধাক্কার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ায় শীতল পাটির কারিগররা আজ দিশেহারা। পাইকার আসতে পারছেন না, তাই পাটিও বিক্রি করতে পারছেন না। এ অবস্থায় পরিবার-পরিজন নিয়ে কঠিন সময় পার করছেন তারা। সারা বছর কমবেশি পাটি বিক্রি হলেও গরমের শুরুতে বিক্রি হয় ভালো। কিন্তু করোনার কারণে গত বছর (২০২০) তাদের লোকসানে পড়তে হয়েছিল। এবারও একই চিত্র। এ কারণে তারা চিন্তিত। পরিবার পরিজন নিয়ে কীভাবে চলবেন-সেই ভাবনায় ভীষণ উদ্বিগ্ন শীতল পাটি সম্প্রদায়ের কারিগররা।

সাধারণ মানের একটি শীতল পাটি তৈরী করতে খরচ পড়ে প্রায় ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা যা বিক্রয় হয় মাত্র ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা। অর্থাৎ পার্টি প্রতি ২০০ টাকা তাদের লাভ হয়। একটি পাটি তৈরি করতে সময় লাগে দুই দিন। এজন্য এসব পরিবারের সকলেই পার্টি তৈরির কাজেই নিযুক্ত হন শুধু তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য। অন্য কোনো কাজে তারা মনোযোগ দিতে পারেন না। তাদের ছেলে-মেয়েরাও এই কাজে যুক্ত হয়ে যান। ফলে স্কুল থেকে ঝরে পড়ে। এজন্য এই সম্প্রদায় দারিদ্র্যের দুষ্ট চক্রের মধ্যেই আবদ্ধ থাকে সারা জীবন।

করোনাকালে এই শিল্পে নিয়োজিত শিল্পীরা বিভিন্ন সমস্যার সম্মূখীন হয়েছেন। যেমন, করোনা মহামারী শুরু হওয়ার পর থেকে তাদের আয় অনেক কমে গেছে ফলে পরিবার পরিজন নিয়ে অতি কষ্টে সংসার চালাতে হচ্ছে। করোনাকালে অনেকেই তাদের উৎপাদিত শীতল পাটি বিক্রয় করতে পারেনি। ফলে শ্রমিকদের মুজুরী ও মহাজনদের টাকা দিতে পারেননি। অনেকেই এনজিও থেকে গৃহীত ঋণের টাকা পরিশোধ করতে পারেননি। শীতল পাটি তৈরি ও বিপণনের জন্য সরকারি সাহায্য ও সহযোগিতাও তারা পাননি। এই শিল্পে পুঁজির সংকটও রয়েছে। তাদের অনেকেই উৎপাদিত শীতল পাটির উপযুক্ত মূল্য বা ন্যায্য মূল্য পান না। অন্য সমস্যার মধ্যে রয়েছে যথা: করোনাকালে লকডাউনে স্থানীয় বাজারে ক্রেতা না আসায় বিক্রয় কম;  পেটের দায়ে কম দামে পাটি বিক্রয়; সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও তদারকীর অভাব; অসৎ ব্যবসায়িরা পণ্য কিনে টাকা দেয় না, ইত্যাদি।

সংশ্লিষ্ট সরকারি বা বেসরকরি কর্তৃপক্ষ, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নিম্মোক্ত সুপারিশগুলো পর্যালোচনা করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে করোনাকালে এই শীতল পাটি শিল্পে নিয়োজিতদের বিদ্যমান সমস্যাসমূহ দূর হবে এবং তাদের জীবন-জীবিকা রক্ষা পাবে। যেমন:  ১. করোনাকালে শীতল পাটি শিল্পে নিয়োজিত পাটিকর সম্প্রদায়ের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ প্রদান করা; ২. শীতল পাটি শিল্পে নিয়োজিত পাটিকর সম্প্রদায়ের মজুরী বাড়ানো বা বাজার উপযোগি মজুরী নির্ধারণ করা;  ৩. যে সকল বেসরকারি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান শীতল পাটি শিল্পে নিয়োজিত পাটিকর সম্প্রদায়দের দিয়ে পণ্য উৎপাদন করিয়ে দেশে বা বিদেশে চড়া দামে বিক্রয় করে থাকে এই বিষয়ে যথাযথ তদারকীর মাধ্যমে তাদেরকে সুনির্দ্দিষ্ট নিয়ম নীতির আওয়াতায় নিয়ে আসা; ৪. সরকারিভাবে শীতল পাটি পণ্য বিক্রয়ের ব্যবস্থা করা। প্রয়োজনে সরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন দেশী ও বিদেশী ক্রেতার সাথে যোগাযোগ করে শীতল পাটি পণ্য বিক্রয়ের ব্যবস্থা করা; ৫. শীতল পাটি শিল্পে নিয়োজিত পাটিকর সম্প্রদায়ের সন্তানদের লেখাপড়ার উদ্যোগ সরকারিভাবে গ্রহণ করা। প্রয়োজনে তাদের যথাযথ মোটিভেশন ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা।  ৬. আইটি প্রক্রিয়ায় যুক্ত হওয়া অর্থাৎ শীতল পাটি সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য সম্বলিত ওয়েব সাইট তৈরি করা; ৭. এই শিল্পে বিরাজমান মধ্য সত্বভোগী ও একচেটিয়া ব্যবসায়িদের দৌরাত্ম্য কমানোর জন্য সরকারিভাবে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে; ৮. স্থানীয় প্রশাসনকে যতেœর সাথে তৎপর হওয়া, ইত্যাদি।

করোনাকালে সৃষ্ট এ শিল্পের সমস্যাগুলো দূর করা হলে শিল্পটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে এবং দেশের বেকার সমস্যা সমাধানেও সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারবে। এমতাবস্থায়, তাদের সাহায্যে সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর আরো কার্যকর ভূমিকা রাখা প্রয়োজন বলে প্রতীয়মাণ হয়। এলক্ষ্যে,  শিল্পটির উন্নয়নের জন্য সরকারিভাবে উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করা, ব্যাংক ও অন্যান্য অর্থ দাতাদের এগিয়ে আসা, তথ্য কেন্দ্র স্থাপন এবং আইটি প্রক্রিয়ায় যুক্ত হওয়া, অন্যান্য ব্যবসার মত নির্ভরযোগ্য লেনদেন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সরকারি সহযোগিতা নিশ্চিত করা, চাহিদা বিশ্লেষণ করে শতিল পাটি পণ্য উৎপাদন করা, উৎপাদনকারীদের মধ্যে সমন্বয় সাধন নিশ্চিত করা, এসোসিয়েশন বা ফোরাম গড়ে তোলা, সরকারি বিধিবদ্ধের আওতায় নিয়ে আসা, সরকারি সহায়তায় দেশের যে সকল জায়গায় বেশি বেশি শীতল পাটি পণ্য উৎপাদিত হয়  সে সকল এলাকায় শীতল পাটি পল্লী গড়ে তোলা। এসব কিছু প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হলে এ শিল্পের মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্যাদি বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হবে বলে মনে করি। সেইসাথে, এই শিল্পের সাথে যুগ যুগ ধরে জড়িত শীতল পাটি কারিগর সম্প্রদায়ের জীবনমানের উন্নয়ন হবে ও তারা দারিদ্রের দুষ্ট চক্র ভেঙে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হবেন।

ড. মতিউর রহমান, গবেষণা পরামর্শক, হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (এইচডিআরসি), ঢাকা

এ সম্পর্কিত আরও খবর