রাবির ‘ক্রাশ-কনফেশন’ পেজে 'কুরুচিপূর্ণ' পোস্ট

বিবিধ, ক্যাম্পাস

সাইফ সাইফুল্লাহ, রাবি করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 09:56:43

সামাজিক যোগযোগ মাধ্যম ফেসবুকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) এক ছাত্রীকে নিয়ে অশ্লীল, কুরুচিপূর্ণ ও যৌন হয়রানিমূলক তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের 'আরইউ ক্রাশ অ্যান্ড হেটস কনফেশন' নামক একটি ফেসবুক পেজ থেকে এ হয়রানিমূলক তথ্য প্রকাশিত হয়েছে বলে জানা যায়। 

বুধবার (৩ এপ্রিল) মধ্যরাতে এ পেজে ভুক্তভোগী ছাত্রীর ছবিসহ একটি পোস্ট আপডেট করা হয়। ওই পোস্টের সূত্রধরে রাতভর ফেসুবকে ওই ছাত্রীকে নিয়ে চলে নেতিবাচক আলোচনা, সমালোচনা ও 'হয়রানিমূলক মন্তব্য'। এরপর বৃহস্পতিবার (৪ এপ্রিল) সকালে আপত্তির মুখে পোস্টটি সরিয়ে ফেলতে বাধ্য হন পেজের অ্যাডমিন।

জানা যায়, পেজে পোস্টটি আপডেট হওয়ার পর পোস্টের মন্তব্যস্থলে অনেকে ওই ছাত্রীকে নিয়ে বিদ্বেষমূলক মন্তব্য শুরু করেন। এসব মন্তব্যের স্ক্রিনশট নিয়ে আবার অনেকে শেয়ার করতে থাকেন ফেসবুকে। যার ফলে ভুক্তভোগী ছাত্রীর বন্ধু-বান্ধব, বিভাগের সিনিয়র-জুনিয়র, শিক্ষক, হলমেটসহ অনেকের চোখে পড়ে পোস্টটি।

বিষয়টি সম্পর্কে ভুক্তভোগী ছাত্রী বলেন, 'কিছুদিন ধরে একটি ছেলে আমার সঙ্গে সম্পর্ক করার জন্য চেষ্টা করছিল। সম্পর্কে আমার বন্ধু হয়। তবে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব থাকলেও রিলেশনে জড়ানোর মতো ইচ্ছে ছিল না। বিভিন্নভাবে সে আমাকে বিরক্ত করতো। তার কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হয়ে একপর্যায়ে খারাপ ব্যবহার করি। তখন সে আমাকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেয়। এর কিছুদিন পরই এমন পোস্ট করে আমার সম্মান নষ্টের চেষ্টা করা হয়।'

ভুক্তভোগী ছাত্রী আরও বলেন, 'রাতে পোস্টটি দেখার পরপরই আমি পেজের ম্যাসেজ অপশনে গিয়ে পোস্টটির সরানোর জন্য রিকোয়েস্ট করি। তবে তারা এটা নিয়ে হাস্যরসাত্মক রিপ্লাই দিতে থাকে। পরে আমি আইনের আশ্রয় নেওয়ার কথা বললে, তারা উত্তর দেয়, যা করতে চান করেন। আপনার সঙ্গে এতো কথা বলার সময় আমাদের নেই।'

ওই ছাত্রী আরও বলেন, 'আমি মানসিকভাবে ভয়ংকর অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আমার বাবা-মা বা এলাকার কোনো মানুষ যদি পোস্টটি দেখে থাকে তবে তাদেরকে বিশ্বাস করানো কঠিন হবে যে, এমন কোনো কাজে আমি যুক্ত নই।'

তবে এটাই ‘আরইউ ক্রাশ অ্যান্ড কনফেশন’ নামের কথিত বিনোদনমূলক পেজ থেকে দেওয়া প্রথম যৌন হয়রানি ও বিদ্বেষমূলক পোস্ট নয়। এর আগে ২০১৭ সালের জুলাইয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের এক বিবাহিত ছাত্রীর সম্পর্কে পেজে পোস্ট দেওয়া হয়। ওই ছাত্রীর স্বামীর কাছে পৌঁছে যায় পোস্টটি। সেখান থেকে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে শুরু হয় পারিবারিক কলহ। যা তিন মাস পর বিবাহবিচ্ছেদে রূপ নেয়। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের এক শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রেও ঘটেছে এমন ঘটনা।

এ ধরনের যত পেজ রয়েছে সেগুলো বন্ধ করতে ২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও ছাত্র উপদেষ্টার কাছে লিখিত অভিযোগ করেছে রাজশাহী ইউনিভার্সিটি ল ফাইন্ডার্স অ্যাসোসিয়েশন (রুয়ালফ) সহ বিভিন্ন সংগঠন। এরপরও পেজগুলো বন্ধে কোন পদক্ষেপ নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

জানা গেছে, ‘আরইউ ক্রাশ অ্যান্ড কনফেশন’, ‘ক্রাশ অ্যান্ড কনফেশনস আরইউ’, ‘আরইউ ক্রাশ এন্ড হেটস কনফেশনস’সহ অন্তত ৮/১০টি পেজ রয়েছে। যেগুলোর মধ্যে দুটি পেজে ২০ হাজারেরও বেশি ফলোয়ার। যাদের অধিকাংশ রাবির সাবেক-বর্তমান শিক্ষার্থীরা রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের অনেক ব্যক্তিও সামাজিক মাধ্যমে এই পেজে যুক্ত। সবমিলিয়ে এসব পেজে অর্ধ লাখের বেশি সক্রিয় ফলোয়ার রয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পেজগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকেনো ছাত্র-ছাত্রীর ছবিসহ তার সম্পর্কে তথ্য বা তাকে ভালো লাগার কারণ বা প্রেম করতে চাওয়ার অভিপ্রায় প্রকাশ করা হয়। যে কেউ ফেক আইডি ব্যবহার করে ছবিসহ তথ্য সরবরাহ করলেই মুহূর্তেই তা প্রকাশ করা হয়। যা পৌঁছে যায় ফলোয়ারদের নিউজফিডে। তবে কে এই তথ্য দিলো তার কোনো পরিচয় সেখানে উল্লেখ করা হয় না। এমনকি পোস্ট দেওয়ার পর ভুক্তভোগী (যার নামে পোস্ট করা হয়) যদি পেজের অ্যাডমিনদের কাছে ম্যাসেজ করে তথ্য চান, তবুও তাকে কোনো তথ্যই দেওয়া হয় না। অনেক ছাত্রী এ ব্যাপারে আপত্তি তুললেই বেশিরভাগই লোক-লজ্জার ভয়ে এড়িয়ে যান। ফলে ক্রমেই বাড়ছে এ অপরাধ প্রবণতা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ সেলের সাবেক আহ্বায়ক মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবা কানিজ কেয়া বিষয়টি সম্পর্কে বার্তা২৪.কম-কে বলেন, 'একজন ছাত্রীর সম্পর্কে যখন নেতিবাচক তথ্য প্রকাশ হয়, সে যত স্ট্রং মানসিকতারই হোক না কেন স্থির থাকতে পারবে না। আমাদের সমাজে তো আরও নয়ই। এখানে মেয়েদের সম্পর্কে মিথ্যা বানিয়ে বললেও তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং সবচেয়ে কাছের মানুষ বা অভিভাবকরাও তা বিনাবাক্যে সত্য মনে করে। ফলে ভুক্তভোগীর পক্ষে এ ধরনের ধাক্কা কাটিয়ে উঠে পড়াশোনায় মনোযোগী হওয়াটা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য।'

এ বিষয়ে রাবি ছাত্র উপদেষ্টা অধ্যাপক লায়লা আরজুমান বানু বলেন, 'এমন পেজ সম্পর্কে আমার জানা-শোনায় নেই। কেউ কোনো অভিযোগও করেনি। তবে যেহেতু জানলাম, খতিয়ে দেখা হবে।'

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. লুৎফর রহমান বার্তা২৪.কম-কে বলেন, 'শুনেছি ফেসবুক পেজে ছাত্রীদের নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করা হয়েছে। যারা এমন কাজ করেছে এবং যারা তা প্রকাশ করেছে, কোনোভাবেই তাদেরকে ছাড় দেওয়া হবে না। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও সম্মানের স্বার্থে এবং নিরাপদ তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

জানতে চাইলে রাজশাহী মহানগর পুলিশের মুখপাত্র সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার ইফতেখায়ের আলম বার্তা২৪.কম-কে বলেন, 'সাইবার অপরাধ বিষয়ে একটি টিম কাজ করছে। যদি তাদের দৃষ্টিগোচরের বাইরে কোনো ঘটনা সংঘটিত হয়, সেটা যে কেউ অবগত করলেই ওই টিম খতিয়ে দেখেন। এ বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হবে।'

এ সম্পর্কিত আরও খবর