টিটু মৃত্যুর ৪ বছর, যেমন আছে তার পরিবার

বিবিধ, ক্যাম্পাস

ইবি করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 19:33:07

২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) ইতিহাসে একটি শোকবহ দিন। এই দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী তৌহিদুর রহমান টিটু গাড়ি চাপায় মারা যান।

এ ঘটনায় বিক্ষোভে ফুঁসে ওঠে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ক্যাম্পাসের প্রায় ৪০টি বাসে আগুন দেয় তারা। প্রশাসন ভবনসহ বিভিন্ন ভবনে ভাঙচুর চালায় তারা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে শিক্ষার্থীদের। এতে ৫০জনের অধিক শিক্ষার্থী আহত হন। ফলে বিশ্ববিদ্যিালয়ের পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় ক্যাম্পাস অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ।

চলতি বছরের ৩০ নভেম্বর টিটু মৃত্যুর চার বছর পূর্ণ হয়েছে। এ চার বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হলেও পরিবর্তন হয়নি টিটুর পরিবারের অবস্থা। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে (টিটুর অবর্তমানে) তিন জনের লেখাপড়াসহ পরিবাবের খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে টিটুর বাবা মো.আব্দুল আজিজকে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার বেলেঘাট গ্রামের বাসিন্দা মো.আব্দুল আজিজ। তিনি পেশায় একজন কৃষক। পাঁচ ছেলে-মেয়ের মধ্যে তিনজনই পড়াশোনা করছেন। এদের মধ্যে একজন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে, আরেকজন যশোর মহিলা কলেজে অধ্যায়নরত এবং ছোট ছেলে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেছে। মো. আব্দুল আজিজ বর্তমানে রূদরোগে আক্রান্ত। ছেলে মেয়ের পড়াশোনার খরচ, নিজের চিকিৎসা এবং পরিবারের খরচ বহন করতে দিনাতিপাত করছেন আব্দুল আজিজ।

এদিকে টিটুর মৃত্যুর পর তার পরিবারের সদস্যদের কোনো একজনকে যোগ্যতা অনুসারে চাকরি দেয়ার এবং টিটু নামে যেকোন একটি ভবনের নামকরণের আশ্বাস দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রশাসন। পরে এ ব্যাপারে একটি অঙ্গীকারনামা করা হয়। কিন্তু আজ অবদি তার কোনটিই বাস্তবায়িত হয়নি।

আফরোজা আক্তার লাকি নামের টিটুর এক বোন বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিসে থোক বরাদ্দে (চুক্তি ভিত্তিক অস্থায়ী চাকরি) কর্মরত আছেন। গত তিন বছর ধরে তিনি এ থোক বরাদ্দে কাজ করলেও তাকে আজ পর্যন্ত স্থায়ীকরণ করা হয়নি। এদিকে ঘাতক ড্রাইভার জাহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধেও এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে জানা গেছে।

টিটুর পরিবারের সদস্যদের দাবি টিটুর নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ভবনের নামকরণ করা হোক বা না হোক তার বোন আফরোজা আক্তার লাকির চাকরিটি যেন স্থায়ী করে নেয়া হয়। যাতে করে তাদের পরিবার কিছুটা হলেও ভালভাবে চলতে পারে।

এ বিষয়ে আফরোজা আক্তার লাকি বার্তা২৪কে বলেন, ‘আমাদের স্বপ্ন ছিল টিটু একদিন শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাবে। কিন্তু তা আর পূরণ হলো না। আমার বাবা এখন হার্টের রোগী। পরিবারের প্রধান চালিকা শক্তি সতিনি। বর্তমান প্রশাসনের কাছে আমার দাবি, যেন আমার চাকরিটি স্থায়ী করে নেয়া হয়।’

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম শাহিনুর রহমান বার্তা২৪কে বলেন, ‘টিটুর মৃত্যুতে সত্যি আমরা মর্মাহত। এই মৃত্যুর মাধ্যমে আমরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের একজন সদস্যকে হারিয়েছি।’

টিটুর পরিবারের দাবির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সম্মিলিতভাবে এ ব্যাপারে যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে সেখানে আমার একাত্মতা থাকবে।’

ক্যাম্পাস সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর দুপুর ১২টার দিকে টিটু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীবাহী ভাড়ায় চালিত ঝিনাইদহগামী বাসে উঠার চেষ্টা করে। এসময় বাস চালক হঠাৎ দ্রুত চালালে সে বাসে উঠতে ব্যর্থ হয়ে রোডে পরে যান। এ সময় পেছন থেকে ভাড়ায় চালিত অপর একটি বাস (সাগর পরিবহন) দ্রুতবেগে তার গলার উপর দিয়ে চলে যায়। এতে গলা ছিঁড়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হন টিটু।

এ ঘটনার পরপরই বিক্ষোভে ফেটে পড়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা প্রধান ফটকের সামনে থাকা ক্যাম্পাসের ভাড়া করা বাস ও মেডিক্যাল ভবনের পাশে বাসস্ট্যান্ডে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব বাসসহ প্রায় ৪০টি বাস পুড়ে যায়। ক্যাম্পাসের প্রশাসন ভবনসহ বিভিন্ন ভবনে ভাঙচুর চালানো হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করলে পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ব্যাপক সংঘর্ষ বাধে। পুলিশ সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর গুলী, রাবার বুলেট, লাঠি চার্জ করে। এতে ৩০ জনের অধিক শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হন। এ ঘটনায় ক্যাম্পাস অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

গাড়ি পোড়ানোর ওই ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ১৫০০ জনকে আসামি করে একটি মামলা করে। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে পৃথক দুটি মামলায় অজ্ঞাতনামা আরও ১৫০০ জনকে আসামি করা হয়। তবে ঘাতক ড্রাইভার জাহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলে জানা গেছে।

এরপর ২০১৫ সালের পহেলা মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় মুঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সভায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস-পরীক্ষাসহ একাডেমিক কার্যক্রম চালুর ব্যাপারে সুপারিশ করা হয়। তবে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস-পরীক্ষা চালু হলেও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় খোলার কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

পরে দ্রুত ক্যাম্পাস চালুর দাবিতে শিক্ষার্থীরা ১৮ মার্চ প্রশাসন ভবনের সামনে তাদের শরীরের রক্ত ছিটিয়ে অবস্থান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেইট অবরোধ করে সেখানে প্রতীকী ফাঁসি ও বিষপানে আত্মহত্যার কর্মসূচি পালন করে। এরপর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ওই বছরের ২ এপ্রিল ক্যাম্পাস খুলে দেয়া হয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর