রমজানে উৎসবমুখর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বিবিধ, ক্যাম্পাস

আরিফ জাওয়াদ, ঢাবি করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-08-30 21:47:12

করোনা অতিমারির দোলাচলে গেল দু’বছরের রমজান মাস ক্যাম্পাসে কাটাতে পারেনি শিক্ষার্থীরা। মহামারি করোনার ধাক্কা কিছুটা সামলে উঠলে গেল বছরের ১০ অক্টোবর খোলে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; শিক্ষার্থীর পদচারণায় প্রাণ ফিরে পায় বিশ্ববিদ্যালয়টি। রমজান মাস আসলেই প্রিয় ক্যাম্পাস ও হলগুলো এক উৎসবের আমেজে মেতে থাকে।

ক্যাম্পাস আর হলেই সীমাবদ্ধ না! এছাড়া এ সময়ে টিএসসি, ডাকসু ক্যাফেটরিয়া, কার্জন হল ক্যাফেটরিয়া কিংবা ক্যাম্পাসের অন্যান্য স্থানে ইফতারের এক উৎসব বিরাজ করে। সেহরিতে চলে শিক্ষার্থীদের দৌঁড়-ঝাপ ; মেয়েদের হলগুলোতে সেটা না থাকলেও, ছেলেদের হলগুলোতে রয়েছে একধরনের প্রতিযোগিতা। এক হল থেকে অন্য হলে স্বল্প মূল্যে পছন্দের খাবার খেতে যাওয়াতে রয়েছে এক ধরনের অবাধ প্রতিযোগিতা।

এমন উৎসব মুখরতার মাঝেও বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীদের রয়েছে নানা তিক্ত অভিজ্ঞতা ও অভিযোগ। কারো বা এবারই পরিবার ছাড়া প্রথম ইফতার ও সেহরি খেতে বসা। কারো আবার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম পরীক্ষাতে বসা। রমজানে ক্লাশ-পরীক্ষাতে কেউবা হয়ে উঠেছে ভীষণ বিরক্ত। বার্তা২৪.কমের আজকের আয়োজন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠে কেমন কাটে শিক্ষার্থীদের রমজান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো দিনের বেলায় আলোতে যেমন, রাতেও ঠিক তেমনই। এমন আলোর মধ্যে থেকেও, নিজেদের আলোয় আলোকিত করতে মরিয়া এখানকার প্রত্যেকটা শিক্ষার্থী। প্রতিটা রাত, প্রতিটা দিন এখানে ‘স্বপ্ন পূরণের গল্প’ লিখা হয়। রাত-দিনের হিসেব, এখানে কেউ করে না। হিসেবে করে স্বপ্ন পূরণের দিন-ক্ষণ, হিসেবে করে কত দিন, কত রাত বাকি স্বপ্নের কাছে যেতে। রমজান এসে ‘স্বপ্ন’ আর সেই স্বপ্ন পূরণে মহান আল্লাহ তা’লার সন্তুষ্টি লাভের আশায় মশগুল থাকে এ বিদ্যাপিঠের শিক্ষার্থীরা।

তারাবির সালাত দিয়ে একটি রোযার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। হলের মসজিদগুলোতে ভরে উঠে শিক্ষার্থী দিয়ে। জায়গা না মেলায়, কার্পেট বিছিয়ে হল মাঠে সালাত আদায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন শিক্ষার্থীরা। তারাবির নামায মাত্র শেষ হয়েছে। নামায শেষে কেউবা ক্লান্ত শরীরে হিম-শীতল বাতাস লাগাতে লাগাতে আপন মনে কার্পেটে শুয়ে রাতের আকাশ দেখেন আর বুকে স্বপ্ন লালন করেন।

তেমনই আকাশের পানে তাকিয়ে থাকা এক স্বপ্নবাজ তরুণ আজিজুল হক, সবে স্নাতক শেষ করেছেন। ফলাফল এখনও প্রকাশ হয় নি। তারাবির সালাত শেষ করে শুয়ে আকাশ দেখছেন আজিজুল। চোখে মুখে স্বপ্ন আর বুক ভরা কষ্ট চেপে নিয়ে শুয়ে আছে এ তরুণ। কাছে গিয়ে বসতেই, কিছুটা ভড়কে উঠে বসে পড়লেন আজিজুল। কেমন কাটছে ক্যাম্পাসে রমজান, জানতে চাইলে কিছুটা বিরক্তির কণ্ঠে আল-হামদুলিল্লাহ, ভাল। তাঁর এক পর্যায়ে গল্পের রেশ ধরতে গিয়েই আজিজুল তাঁর জগতে প্রবেশ করায় প্রতিবেদকে। বলেন, ‘দিন যত যাচ্ছে তত যেন হতাশা বাড়ছে কাঁধে ঝেঁকে বসছে হতাশা। কি করব? না করব, আদৌতে লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব কি না? আবার পারলেও সেটি কবে?’ এমন হতাশার গল্প শুরু করলেন। আজিজুল মনে করেন, এখানকার হাজারো শিক্ষার্থীর চোখে মুখে এমন হতাশা রয়েছে। তারপরেও তাঁরা ভাল থাকার অভিনয় করেন ; চেষ্টা করেন সুখী থাকার। কম দামের নিম্নমানের খাবার খেয়েও বাসাতে বলেন ইফতারি আর সেহরিতে অনেক সুস্বাদু খাবার খেয়েছেন। নিজের হতাশার জীবন লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করে, আলহামদুলিল্লাহ ভাল আছিই যেন জীবন হয়ে গেছে। আজিজুলের কাছে ক্যাম্পাসের রমজান অনেকটা বোঝার মত। কারণ সেহরি-ইফতার সব মিলিয়ে খেতে গেলে দৈনিক ২০০ টাকার মত পড়ে যায়। যেখানে রমজান ব্যতীত অন্য সময়ে তাঁর লাগত ৭০-৯০ টাকা। “অনেকটা বোঝার উপর সবজি আঁটির মত লাগে আমাদের মত বেকার তরুণদের কাছে”, বলে মন্তব্য করেন তিনি। এখানে কেউ টিউশনি করে, কেউবা বাসা থেকে টাকা নিয়ে চলে।

কথার এক পর্যায়ে আজিজুল বলেন, প্রশাসনের সদিচ্ছার প্রয়োজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর শতবর্ষে কতটুকু শিক্ষার্থী বান্ধব হতে পারল সেটাই দেখার বিষয়। তবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে শিক্ষার্থীরা মানায় নিতে শেখে, নতুন পরিবেশের সাথে খাপ-খাওয়াতে শেখে। মেনে নেওয়ায় যেন এখন জীবন হয়ে গেছে।

তারাবির নামায শেষ করে, কেউ পড়তে চলে যায় রিডিং রুমে, কেউ বা বসে আড্ডায়। আড্ডায় বসাদের স্নাতক শেষ করা নেই বললেই চলে। আজিজুলের জায়গা থেকে কয়েক কদম এগোতে স্নাতক (সম্মান) দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের জটলা। শাকিল, আশরাফ, রবিউল, রব্বানী সহ বেশ কয়েকজন গোল হয়ে বসে অট্ট-হাসিতে খোঁস গল্পে মেতে উঠেছেন। ক্যাম্পাসে রমজান কেমন কাটছে, বলে জানতে চাইলে তিক্ত অভিজ্ঞতার ঝুলি নিয়ে বসেন তাঁরা।

প্রথমে খাবার দামের চড়া মূল্যেও অভিযোগ দিয়ে শুরু করেন। তাঁরা বলেন, রাতারাতি এভাবে খাবার দাম বৃদ্ধি কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। অহেতুক প্যাকেজ করে খাবারের দাম বৃদ্ধি করেছে, দাম আকাশচুম্বী হলেও মান একেবারেই বাড়ে নি, বলে তাঁদের অভিযোগ। হল প্রশাসনের উচিত বিষয়গুলো নজরদারি’র মধ্যে রাখা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভাল খাবার খাওয়া মানে, একটি জাতিকে ভাল খাবার খাওয়ানো। ঢাবি শিক্ষার্থীরা সুস্থ্য থাকলে একটি জাতি সুস্থ্য থাকবে, বলে মনে করেন ওই শিক্ষার্থীরা।

সেশনজট কাটিয়ে উঠতে রমজানেও বিশ্ববিদ্যালয়টি চালু রেখেছে ক্লাশ ও পরীক্ষা। তাঁদের মধ্যে একজন বলেন, সেহরী শেষ করে ঘুম থেকে সকাল ৯ টায় ক্লাশে যাওয়াটা বেশ বিরক্তির। অনেক কষ্ট হয়ে যায়! তাঁদের সাথে কথা বলতে বলতে দূর থেকে একজন বলে উঠেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্রুত সিলেবাস শেষ করে দিয়ে পরীক্ষা নেয়ার যে প্রতিযোগিতায় নেমেছে, উচ্চ শিক্ষার সঙ্গে বিষয়টি বেশ সাংঘর্ষিক।

রাত তখন ১২ টা ৫, সেখান থেকে উঠে রিডিং রুমের সামনের ফিল্টার থেকে পানি নিচ্ছে এক চশমা পরিহত যুবক। নাম সালেহীন ; স্নাতক শেষ করেছে, স্নাতকোত্তর পরীক্ষার ফলাফল এখনও বের হয় নি। বোতলে পানি ভরানো শেষ হলে, একটু কথা বলতে চাইলে আগ্রহ দেখান সালেহীন।

রমজান মাস কেমন কাটছে বলে, জানতে চাইলে সালেহীন বার্তা২৪.কম’কে বলেন হতাশার মধ্যে নির্ঘুম রাত কাটছে। পরিবার থেকে চাপ আসছে, কবে চাকরি পাব। রহমতের মাসে আল্লাহর কাছে রহমত চাইছি যেন দ্রুত একটা চাকরি পেয়ে যাই। সেহরি করে ঘুমান কি’না জানতে চাইলে তিনি জানান, হ্যাঁ সেহরি করেই ঘুমানো হয়। এভাবে তাঁর শৈশব-কৈশোরের অনেক গল্পেই মেতে ওঠে বার্তা২৪.কমের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে।

সালেহীন বলেন, জীবনে কখনও ভাবি নি পৃথিবীটাকে এমন বোঝা মনে হবে। শৈশব-কৈশোর কেটেছে কত না দুরন্তপনায়। সব কিছুই যেন এখন বিস্মৃতি। এখন যুদ্ধতে নামতে হবে, চাকরি নামক এ যুদ্ধে সফলতা নিয়ে ফিরতেই হবে! এক পর্যায়ে তখন ঘড়ির কাটা ৩ টা ছুঁই ছুঁই করছে। কথা শেষের এক পর্যায়ে অভিবাদন জানিয়ে সালেহীন সেহরি খেতে চলে যায়।

এদিকে সালেহীনের পিছু নিলে, মিলে হলের ক্যান্টিন। হলের দোকানগুলোতে দেখা যায় উপচে পড়া ভীড়। ক্যান্টিন থেকে বের হওয়া, এক বন্ধু আরেক বন্ধু’কে বলছে। ওদিকে যাস না! “কামরুল আগুন লাগায় দিছে!” কয়েক কদম এগিয়ে ক্যান্টিনে গিয়ে দেখা যায় আগুন না, দাম বেড়েছে দ্বিগুণ হারে পূর্বের তুলনায়। খাবারের দামই যেন আগুন হয়ে গেছে!

এদিকে স্বল্প মূল্যে খাবার খেতে এক হল থেকে আরেক হলে ছুটছেন অনেক শিক্ষার্থীরা। একজন আরেকজন’কে বলেছে “চল অমুক হলে যাই, ওখানে দাম কম। খাবারও তুলনামূলক মান ভাল।” শিক্ষার্থীদের সেহরী খেতে এক হল থেকে অন্য হলে ছোটার দৃশ্য, প্রত্যেকটি হলে গিয়ে এমন চিত্রই চোখে মেলে। সেহরী খাওয়া শেষ হলে কেউ ছোটে রিডিং রুমের দিকে স্বপ্ন পূরণের জন্য, কেউ ছোটে ঘুমোনোর জন্য। কারণ, সকালে হয়তো কারো পরীক্ষা আবার কারো বা রয়েছে ক্লাশ।

কেউ ক্লাশ না করেই দীর্ঘ ঘুম থেকে উঠে ; যোহরের নামায আদায়ের মধ্য দিয়ে দিন শুরু করে। এমন একজন সিফাত আলম, পড়ছেন স্নাতক ২য় বর্ষে। বার্তা২৪.কমের এ প্রতিবেদক’কে সিফাত জানান, রোযা রেখে ঘুম থেকে উঠতে অনেক কষ্ট হয়। মাঝে মাঝে ক্লাশে বন্ধুরা প্রক্সি দেয়। তবে গুরুত্বপূর্ণ ক্লাশ-পরীক্ষা থাকলে, কষ্ট হলেও যাওয়া হয়।

ইফতারিতে ঢাবি যেন এক টুকরো উৎসবের কেন্দ্রে পরিণত হয়: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসে ইফতারের আমেজ লাগে সেই দুপুর ৩ টা থেকে। ক্যাম্পাসের সাবেক, বর্তমান কিংবা বহিরাগতরা মেতে ওঠে ইফতারির আমেজে। টিএসসি, মধুর ক্যান্টিন, সেন্ট্রাল লাইব্রেরি সামনে, হলগুলোর সম্মুখ কিংবা হল পড়াতে পুরোনো আমেজে মুখর এবারের ইফতার। মহামারী করোনার দু’বছর পর, এবারের ইফতারের আমেজ যেন ভাল ভাবেই লেগেছে।

ঠান্ডা শরবত, ফল, ছোলা-বুট, বুন্দিয়া, বেগুনি, পিঁয়াজু, চপ হাজারো রকমের খাবারের পসরা সাজিয়ে বসে দোকানিরা। বন্ধু-বান্ধব কিংবা প্রিয় মানুষটির সঙ্গে বসে ইফতারি খাবার ভাগাভাগি করে খাওয়া রমজান মাসে যেন এখানকার নিত্য-নৈমেত্তিক ব্যাপার। টিএসসি, বটতলা, শিক্ষা গবেষণা ইন্সটিটিউট ও ব্যবসা শিক্ষা অনুষদ সম্মুখে ইফতারির আয়োজনে মেতে ওঠার দৃশ্য যেন চোখে পড়ার মত।

গোল হয়ে পত্রিকা কিংবা বড় গামলা বিছিয়ে ইফতারির আয়োজনে মেতে ওঠেন বর্তমান, সাবেক কিংবা বহিরাগতদের কোন গ্রুপ। পারস্পরিক ফেলে আসা হৃদ্যতার সম্পর্কের স্মৃতিচারণ করা হয়ে যায় ইফতারির এ আয়োজনের মধ্য দিয়ে। হলগুলোর মাঠেও চলে নানান আয়োজনে ইফতার।

পরিবার ছাড়া ইফতার করতে বসেছেন, এমন দু’জনের সাথে কথা হয় বার্তা২৪.কমের। তাঁরা জানায়, ইফতার ও সেহরী পরিবার ছাড়া এবারই প্রথম। তবে ইফতার ও সেহরি খেতে বসলে পরিবারের জন্যও একটু কষ্ট হয়। তবে শতবর্ষী এ প্রাণের বিদ্যাপিঠে কষ্ট-সুখ কোন কিছুই দীর্ঘস্থায়ী নয়। বন্ধু-বান্ধবের ব্যাঙ্গাত্মক বাক্য বিনিময়ে সকল কষ্ট যেন ম্লান হয়ে যায় এখানে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর