বাতির নিচেই অন্ধকার!

বিবিধ, ক্যাম্পাস

সাইফ সাইফুল্লাহ, রাবি করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-25 07:03:02

শুক্রবার (১৬ নভেম্বর) সকাল ১০টা। ক্যাম্পাসের একটি চায়ের দোকানের এপাশ থেকে ওপাশে ছুটোছুটি করছে দশ বছর বয়সী শিশু শুভ। ‘এই পিচ্চি, এদিকে আয়’ বলে বিভিন্ন পাশ থেকে ডাক পড়ছে তার। ডাক পড়তেই সেখানে ছুটে যাচ্ছে সে। চাহিদা মতো সরবরাহ করছে চা-সিগারেট।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) তৃতীয় বিজ্ঞান ভবনের পাশে খালেকের চায়ের দোকানের সামনের দৃশ্য এটি। শুধু এই দোকানই নয়, ক্যাম্পাসের চাসহ অন্যান্য খাবারের দোকানের চিত্র একই। উত্তরবঙ্গের সেরা এই শিক্ষাঙ্গনে আইন অমান্য করে দোকানগুলোতে কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে শিশুদের। জ্ঞানার্জনের বিদ্যাপীঠে এ চিত্র যেন আলোর প্রদীপের নিচেই অন্ধকার।

শিশু শ্রমিক শুভ জানায়, তার বাবা একজন রং মিস্ত্রি। মা অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে সে বড়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দোকানে কাজ করে ৪০ টাকা পায় সে। সকালে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় তার মা তাকে খাইয়ে দিয়ে অন্যের বাড়িতে কাজ করতে চলে যান। পড়াশোনা করার ইচ্ছে থাকলেও পরিবারের অভাব অনটনের কারণে প্রতিদিন তাকে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চায়ের দোকানে কাজ করতে হয়।

এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ কলা ভবনের সামনে চায়ের দোকানে কাজ করে ১২ বছর বয়সী শিশু নাসরুল্লাহ। সে জানায়, সাত বছর বয়সে বাবাকে হারায়। মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে। মায়ের উপার্জনে সংসারের খরচ না মেটায় চায়ের দোকানে কাজ নেয় নাসরুল্লাহ। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চায়ের দোকানে কাজ করলে প্রায় দেড়শ টাকা পায় সে। সকালে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় তার মা একটি বাটিতে করে খাবার দিয়ে দেয়। সেই খাবার দুপুরে খায়। লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ থাকলেও অভাবের কারণে নাসরুল্লাহের আর বিদ্যালয়ে যাওয়া হয়ে ওঠেনি।

এছাড়া ক্যাম্পাসে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে বাদাম বিক্রি করে রাব্বী। সকাল হতেই চুলায় বাদাম ভেজে দেন মা। তারপর ক্যাম্পাসেই ঘুরে ঘুরে বাদাম বিক্রি করে সে। দুপুরে খাবার হাতে মা ছুটে আসে ক্যাম্পাসে। একসঙ্গে মা ও ছেলে খাবার ভাগ করে খায়। এভাবেই তাদের মা ছেলের দিন চলে।

রাব্বীর মা রাবেয়া খাতুন বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘এই ব্যাটাটা (ছেলে) বাপ মইরি যাওয়ার পর থেইকি সংসারের হাল ধইরিছে। এই বয়সীর ছাওয়ালেরা (ছেলেরা) সারাদিন কতো দৌড়ি বেড়ায়, আর আমার রাব্বীক বাদাম লিয়া ছুটতি হয়। ক্যাম্পাসের মামারা (শিক্ষার্থীরা) ওক অনেক আদর করে। আমি হতভাগা মা ওর জন্য কিছুই করতি পারি না। আমি দুয়া করি আমার রাব্বী জানি জীবনে মেলা বড় অয়।’

ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা গেছে, শুভ, রাব্বী ও নাসরুল্লার মতো আরও অনেক শিশু ক্যাম্পাসের বিভিন্ন দোকানে কাজ করে। যে বয়সে তাদের বই-খাতা নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা, অন্য শিশুদের মতো মাঠে খেলাধুলা করার কথা, সেই বয়সে তারা কাজে নিয়োজিত। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে দোকান থেকে তারা পায় পঞ্চাশ থেকে দেড়শ টাকা। দিন শেষে তা তুলে দেয় বাবা-মায়ের হাতে। তাদের এই সামান্য রোজগারের টাকায় ঘুরছে সংসারের চাকা।

দোকানিরা বলছেন, অল্প মজুরিতে শিশুদের বেশি কাজ করানো যায়। এছাড়া শিশুদের যা বলা হয়, তারা তাই শোনে। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তিকে যেখানে দিনে তিন থেকে চারশ টাকা দিতে হয়, সেখানে শিশুদের পঞ্চাশ থেকে দেড়শ টাকা দিলেই চলে। এজন্য সবাই শিশুদের কাজে লাগায়।

অথচ বাংলাদেশ শ্রম আইন (২০০৬) অনুসারে শ্রমিকের বয়স ১৪ বছরের নিচে হওয়া যাবে না। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। শ্রমে নিয়োজিত বহু শিশুর বয়স ১৪ বছরের নিচে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অনেকেই শিশু শ্রমে নিয়োজিত থাকলেও দেখার যেন কেউ নেই। অপরদিকে, ছোট বয়সে শ্রমে নিয়োজিত হওয়ায় মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. ওয়ারদাতুল আকমাম বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘শিশুদের দিয়ে কাজ করানোর বিষয়টা অমানবিক। শিশু কাজে নিয়োজিত থাকলে তার মানসিক বিকাশ সঠিকভাবে হয় না। দোকান মালিক নিজেদের লাভের আশায় শ্রমে শিশুদের ব্যবহার করছেন, এটা উচিত না। শিশু শ্রম বন্ধে সবার এগিয়ে আসার পাশাপাশি সামাজিক সচেতনা প্রয়োজন।

আইন অমান্য করে শিশুদের দিয়ে কাজ করানো প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. হাসিবুল আলম প্রধান বার্ত২৪.কমকে বলেন, ‘শিশুদের দিয়ে কোনো ভাবেই স্বাস্থ্যহানিকর বা ঝুঁকিপূর্ণ কোনো কাজ করানো যাবে না। এ বিষয়টি ২০০৬ এর শিশু শ্রম আইনে বলা থাকলেও বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে আইনি বিধান ও প্রয়োগের সীমাবদ্ধতার কারণে শিশুদেরকে শ্রমে নিয়োজিত করা হচ্ছে। যার ফলে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। দেশে শিশু শ্রম বন্ধের আইন ও নীতিমালা আছে, কিন্তু আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকার ফলে শিশু শ্রম বন্ধ হচ্ছে না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা অধ্যাপক লায়লা আঞ্জুমান বানু বার্তা২৪.কমকে জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব দোকান রয়েছে তা প্রশাসনের কাছ থেকে ইজারা নিয়েছেন এর মালিকরা। এ সকল দোকানগুলোতে শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে মালিক পক্ষের ভূমিকা থাকে। তারা কাকে দিয়ে দোকানের কাজ পরিচালনা করবেন এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করতে পারে না। তবে কেউ যদি এ বিষয়ে অভিযোগ করে তাহলে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর