‘প্রশ্নফাঁসের কলঙ্ক’ মেটাতে একা লড়ছেন আখতার!

বিবিধ, ক্যাম্পাস

রেজা-উদ্-দৌলাহ প্রধান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-25 21:03:05

ঘড়ির কাটায় রাত ২ টা ৩০। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় মধ্যরাতে হেমন্তের ঈষৎ কুয়াশার খেলায় শরীরে শীতল অনুভূতি দেয়। গোটা এলাকা জুড়ে রাজ্যের নীরবতা। মাঝে মধ্যেই ঘেউ ঘেউ করে ডাকছে কয়েকটি কুকুর। অদূরেই হাকিম চত্বরের সামনে যাত্রী ছাউনিতে বসে পুলিশের কয়েকজন সদস্য ডিউটিরত। কয়েকজন নিশাচর ছাত্রের আনাগোনা। এমনি পরিবেশে সন্ত্রাস বিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে গায়ে মাথায় কাথামুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন আখতার হোসেন।

তার পাশেই ৯-১০ জন ছিন্নমূল শিশু-কিশোর মানুষ কাথামুড়ি দিয়ে গভীর ঘুমে অচেতন। এক কোণায় একটি কুকুরও শুয়ে আছে। শীতের কুয়াশা, গাড়ির চাকার শব্দ, ক্ষুধার যন্ত্রণা, মশার কামড়-সব মিলিয়ে ঘুম নেই আখতার হোসেনের চোখে।

আখতার হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী। ২০১৫-১৬ সেশনে‘খ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ১৪তম হয়েছিলেন তিনি। চোখে অনেক স্বপ্ন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছে সে। কিন্তু তাঁর স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান আজ প্রশ্নবিদ্ধ ভর্তিপরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের মত কলঙ্কজনক ঘটনার কারণে। আর এই কলঙ্ক তাকে বিদ্ধ করছে। তাই বিবেকের তাড়নায় সে আমরণ অনশনে বসেছে। আখতার চায় প্রশ্নফাঁস বন্ধ হোক। প্রশ্নফাঁস কারীদের আইনের আওতায় আনা হোক। কঠোর হোক প্রশাসন। বৃহস্পতিবার (১৮ অক্টোবর) তার অনশনের তৃতীয় দিন শুরু হয়।

আখতারের কাছে একাই অনশনে বসলেন কেন- জানতে চাইলে কাথা থেকে মাথাটা বের করে শুকনা কণ্ঠে জানাল, ‘বিবেকের তাড়নায়।’ সেখানে থাকা ঢাবির এক শিক্ষার্থী জানালো, আখতার নন-পলিটিক্যাল ছেলে। তার মধ্যে একটা শিক্ষক শিক্ষক ভাব আছে। প্রতিবছর সে কয়েকজনকে অ্যাডমিশন কোচিং করায়। এবার প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবরের পর তার ছাত্রদের একজনের প্রশ্ন ছিল, ‘স্যার, আমরা এত পড়াশোনা করলাম, কিন্তু প্রশ্ন ফাঁস হওয়ায় আমরা কি চান্স পাব? তাহলে কি আমরা দুর্নীতির কাছে হেরে গেলাম?’ ছাত্রের এই প্রশ্নের উত্তর সে দিতে পারে নি। তারপরই সে অনশনে বসার সিদ্ধান্ত নেয়।

চলতি শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘ-ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। ‘ডিজিটাল জালিয়াতি’ আখ্যা দিয়ে সেটাকে পরোক্ষভাবে স্বীকার করে পরীক্ষার ফল ঘোষণা করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এরপর প্রশ্নফাঁসের সে সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয়ে ওঠে। কেননা ঘ-ইউনিটের বাণিজ্য শাখার মেধা তালিকায় ১২০ নম্বরের মধ্যে ১১৪.৩০ নম্বর পেয়ে প্রথম হওয়া জাহিদ হাসান আকাশ গ-ইউনিটে মাত্র ৩৪ নম্বর পেয়ে ফেল করেছেন। এক ইউনিটে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে রেকর্ড নম্বর আরেক ইউনিটে একদম ফেল জহিদের মেধার সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। আরেক শিক্ষার্থী তাসনিম বিন আলম ঢাবি ঘ ইউনিটে (বিজ্ঞান শাখায়) ১২০ নম্বরের মধ্যে ১০৯.৫০ সম্মিলিত মেধা তালিকার বিজ্ঞান শাখায় প্রথম স্থান অধিকার করেছেন। অথচ বিজ্ঞান শাখার এই শিক্ষার্থী তার নিজের অনুষদ ক ইউনিটের পরীক্ষায় ১২০ নম্বরের মধ্যে ৪৩.৭৫ পেয়ে ফেল করেছিলেন। ফলাফলে ‘মেধার বিস্ফোরণে’ বেশ শোরগোল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

গত কয়েক বছর ধরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস ব্যাধির মত ছড়িয়ে পড়েছে। কোন না কোন ইউনিটে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। সেগুলোর প্রমাণ গণমাধ্যম তুলে ধরছে। কিন্তু প্রশাসন তারপরো নিজেদের ‘ইমেজ সংকট’ যেন না হয় সেজন্য অস্বীকার করে যাচ্ছে। নমকাওয়াস্তে তদন্ত কমিটি করলেও কোন প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয় না। প্রতিবেদন জমা দিলে সেগুলো কখনো আলো মুখ দেখে না। প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়ন হয় না।

আখতার বলেন, ‘প্রশ্নপত্রের নিরাপত্তা দেওয়া প্রশাসনের পবিত্র দায়িত্ব। পরীক্ষা শুরু হওয়ার ১ মিনিট আগেও প্রশ্নপত্র পাওয়া গেলে সেটাও প্রশ্ন ফাঁস। ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা নিয়ে ভর্তিপ্রক্রিয়া কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। আমি চাই ঘ-ইউনিটের পরীক্ষা আবার নেয়া হোক।’

কথায় কথায় জানতে পারলাম আখতারকে নৈতিক সমর্থন জানিয়ে গেছে ছাত্রলীগ। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের গোলাম রব্বানী, ঢাবি ছাত্রলীগ নেতা সাদ্দাম হোসাইন সংহতি প্রকাশ করেছে তার সাথে। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের একটি পক্ষও তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তারাও ঘ-ইউনিটের পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে রাজপথে নামতে চায়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে কোন সাড়া এখনো পায় নি সে।

সাধারণ শিক্ষার্থীরদের কয়েকজন বিচ্ছিন্নভাবে তার সঙ্গে সহমত জ্ঞাপন করে, সাহস দিয়ে চলে গেছে। আখতার বলে ‘আমার অনশন চলবে। আমি এখান থেকে উঠছি না।’

টানা ৪০ ঘণ্টা না খাওয়া আখতারের গলা শুকিয়ে আসে। কিন্তু মনের জোর ঠিকই ছিল শুকনো চোখে মুখে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর