স্পর্শক্ষয় ও আমাদের দিনকাল

কবিতা, শিল্প-সাহিত্য

কাজী নাসির মামুন | 2023-08-31 09:42:30

১.
প্রেমের ভুলের দিকে যেতে যেতে
আমি যেন কষ্টার্জিত টাকা।
হঠাৎ খরচ হলে দুঃখ পাই, তবু
নিরুপায় থাকি।
কে আমাকে অপচয় করে, কে সে?
একটা ধারালো ছুরি শ্বাপদ সম্পর্কে
আমাদের পাশাপাশি গুম করে রাখা।
গুপ্ত জলে বিষ দেয়
আত্মার গহীনে বসা নিরূপিত হাত।
তবু স্মৃতিসমুদ্রে মানুষ ছাড়া
আর কোনো ঢেউ নেই জাগিয়ে তোলার।
জীবনের সব ঘূর্ণিব্যাপী
কেবল মানুষ গুঞ্জরিত মনে মনে।
ইচ্ছে করে ফকিরগঞ্জের
টুপটাপ মানুষের ভিড়ে
ঝিমঝিম বৃষ্টির কয়েক ফোঁটা হয়ে বসে থাকি।
আলির দোকানে বসে চা খাই; সরের
শ্যাওলা ওখানে ভাসে দুধের কারণে সাদা সাদা।
জীবনের সকল চুমুক
এইভাবে মধুময়, নিশ্চিন্ত সরল হতে পারে।
ঘরের বিরহে আমি তার
আরাধনা করি।
ভাবি, ওসমান, সেই নম্র মুখরতা
পাখির চঞ্চুতে যাকে খাবার ভাবতে ভালো লাগে
আসবে কি? বলবে, বেরোন।
আপনেরে মিস করি।
বকুলের গল্পগুলো দুমড়ানো
কাগজের ব্যথা নিয়ে সামনে দাঁড়ায়।
বলে, আলো দেন। আমি বলি, লগ্ন হোক।
এই নভো অন্ধকার আমাদের নিজস্ব খরিদ।
একদিন বিক্রি হবে। আজ হোক একাকীত্ব বরণ।
বকুল একটা অভিমানী জল। চুইয়ে পড়ছে।
যার স্পর্শ আমার কান্নার মর্মমধু, বলীয়ান।
কচুবনে টলটলে পানি
কত ক্ষোভে টুপ করে ঝরে;
আমি ধরি। ভাবি, ওটা কেউ না, রতন।
সে আমার স্নিগ্ধতার ভাই।
ওকে আজলায় নিয়ে
মুখ ধুই।
আশ্চর্য ক্ষরণ থেকে কত পাখি
এইভাবে উড়ে উড়ে পালক ঝরায়।
দহন মলিন ঘরে বসে, আমি
মরা পালকের জানাজা পড়াই।

২.
মর্মের স্বপক্ষে জীবনের রন্ধ্র ধরে
বসে থাকি আজ; রাত বাড়ে।
ঝড়ো বাতাসের গায়ে
আচমকা পাখির ঝাপট!
কে? কে? যেন হিম তর্ক এসে
হঠাৎ ভাঙছে এই নিঃসঙ্গ প্রহর।
বৃষ্টি পড়ে; বৃষ্টি আকাশের প্রেমপত্র;
রিমঝিম শব্দের অঝোর
বাক্যে তাকে সারারাত পাঠ করে
কয়েকটি প্রবল উৎফুল্ল ব্যাঙ:
ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর..
গ্যাঙ গ্যাঙ.. গ্যাগো গ্যাগো।
নশ্বরতা একটা হাসির
গোলাপ, সবার মধ্যে দোলে।
ঝরে পড়বার আগে ফুল
কখনো একান্ত হয় নিজে নিজে?
ব্যাকুল প্রশ্নের এই ধারাপাত
দূরন্ত ঈগল হয়ে ভিতরে তাকায়।
ভয় পাই! ভয়!

সময় খারাপ হলে হৃদয় একটা বিলবোর্ড।
বিষণ্ন অক্ষরে বিজ্ঞাপন জেগে ওঠে
নিজের ভিতর:
দূরত্ব সাধনা যার, সে-ই টেকে;
স্পর্শ মানে মৃত্যু।
মর্ম-পাতা
গোপন থাকে না তবু; সম্পর্কের
শিরাল সঞ্চয়ে মনে পড়ে
ব্যক্ত সবুজের দিকে সব মুখগুলো।
একবার মিহির হারুন
নরুন্দি যাওয়ার পথে
সূর্য-পোড়া বাতাসে হেলান দিয়ে
একান্ত আমার মধ্যে গলে পড়ছিল।
সে তখন রোদ। রোদ হলো
সূর্যের গলিত
শরীর, পৃথিবী বুকে ধরে রাখে।
ভালোবাসা হলো
অভিন্ন আত্মার দিকে নিজের অস্তিত্ব ভুলে যাওয়া।
সেদিন নিজের মধ্যে একটা পৃথিবী
অন্তরঙ্গ জানালায় কাত হলে
দেখলাম, কাঁশফুলে সাদা মন দুলে
উঠছে আমার; নদী আছড়ে পড়ছে
কিনারে কিনারে; জলস্রোত
ভাসিয়ে নিয়েছে সব ভুবন চিলের হাহাকার।
দহন ধর্মের দিকে আমরা সবাই এক হলে
পৃথিবীর সব রোদ নদীর আঁচলে মুখ ঢেকে
একদিন নরুন্দি স্টেশনে যায়। দুপাশে অনন্ত
সবুজ সংগ্রাম মৌন আকাঙ্ক্ষার পাশে
সুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে, আমরা আসছি।
মাঝে পথ, ঠিক পথ নয়
পিচঢালা একটা ঘোড়ার পিঠ সুদূর পশ্চিমে
গড়িয়ে দিয়েছে কেউ; অস্তগামী সূর্যের আগুন
লাল হতে হতে দেখে
পথ দৌড়ে আসছে, দিগন্ত-রঙে
ভেসে যাচ্ছে গ্রাম আর গ্রাম!
আমরা কয়েকজন
লৌহ-গলা হৃদয়ের কাজল রেখায়
দুঃখের সমান্তরাল রেল লাইন
মেয়েটির দুই ভ্রু’র মধ্যে এঁকে দিই।
নরুন্দি স্টেশন! আহা, মায়ার তরঙ্গ
থেকে উঠে আসা এক নিঃসঙ্গ বিকেল,
আমাদের সবার বান্ধবী
ছায়ার ঝালরে সেজে থাকে।

আজ রোদ আছে, ছায়া নিভৃত ঘরের
নিজস্ব বাসরে কাতরায়; শুধু নরুন্দি দেখি না।

৩.
মানুষ ক্ষুধাকে মানে; শস্য সবুজের চেয়ে
অধিক আপন; তাই পড়ন্ত খাদ্যের সূর্যালোকে
সবাই বেরিয়ে আসে; কত ট্রাক ত্রাণের দিগন্তে
আকাশ খুলেছে, তবু নীল দরজাটা
অনাগত শান্তির বিপক্ষে বন্ধ রাখে
ভোগের বিভোর মহাজন।
ইচ্ছে করে নিজের ভিতরে যে-নরুন্দি
স্টেশন বিপুল ছায়া-খাদ্যে
জমিয়ে রেখেছি, তাকে বিলিয়ে বেড়াই।
পিঁপড়ে যেভাবে পায় শস্যের শরীর
আমাকে সেভাবে নিক ক্ষুধার্ত মানুষ।
চল্লিশ চোরের দেশে
রাষ্ট্র এক বিলম্বিত বুদ্ধির রাখাল;
আলী বাবা খুন হয়, রক্তের আবর্তে
নড়ি হাতে কুপোকাত পুলিশ, শাসন।
পৃথিবী একটা খাদ্য; কেউ তাকে
সম্পূর্ণ গিলছে, কেউ উগরে দিতেই ভালোবাসে।
রাজনীতি
একটা চাবির গোছা; সবাই হাতিয়ে
নেয়, তবু জীবন নামের তালাটিকে
খুলতে পারে না কেউ; মণ্ডলসেনের
সুবোধ যুবক সেই ইদ্রিছ আলীর কথা ভাবি।
তার বুক হাসির বৃত্তান্তভরা উন্মুক্ত মাঠের
দিবালোক; কাছে গেলে
নিজের ছায়াকে দেখি পর্যুদস্ত
পৃথিবীর সামনেও খুশিতে টলছে।
মাসুদ নিজেই ছায়া, উদ্দিষ্ট স্বপ্নের
পিছে যারা ছোটে,
তারা মাসুদকে পেলে সুখী হবে।
অথচ এদের কোনো পরাবৃত্ত নেই রাজনীতিময়;
শোষণ তিতিক্ষা নেই
কোনো পুলকিত অহংকারে।
মৃত্যু
কাঁটাতার মানে না কোথাও।
মহামারি বিপুল সাম্যের কড়া নাড়ে।
কাউকে ছাড়ে না; শুধু মানুষ চেনায়।
অনাক্রান্ত মায়ের শরীর
জ্যান্ত ফেলে আসে যে-সন্তান
বিধুর জঙ্গলে একা একা,
তার ভয়
পাশবিক স্বার্থের একটা তালা, ভাবে
নিজের জীবন খুলে গেলে
অন্য কোনো আলোর সহগ
প্রয়োজন নেই; সেকি দেখে না জঠর
পরাক্রান্ত সত্যের সামনে এক নীরব শিক্ষার্থী।
সন্তান পরীক্ষাগার; সময়ের নিজস্ব খাতায়
শিখর উচ্চতা নিয়ে মায়ের নম্বর বেড়ে যায়।
মা, মাগো, ওই যে,
চাবি দেখো বহুমুখ। ওরাও সন্তান।
আল্লার সতর্ক সহযোগ। তীব্র এগিয়ে আসছে।

কোথাও কখনো নেই অনন্ত পঙ্কিল।

এ সম্পর্কিত আরও খবর