নিজার কাব্বানির কবিতা

অনুবাদ কবিতা, শিল্প-সাহিত্য

ভূমিকা ও ভাষান্তর : সৈয়দ তারিক | 2023-09-01 22:53:44

নিজার তওফিক কাব্বানি ১৯২৩ সালে সিরিয়ার রাজধানী দামাস্কাসে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন কবি, কূটনীতিক, লেখক ও প্রকাশক। তার কবিতা একইসাথে সরল ও শৈলীসম্পন্ন। প্রেম, যৌনতা, নারীবাদ, আরব জাতীয়তাবাদ ও ধর্ম তার কবিতার বিষয়বস্তুর মধ্যে পাওয়া যায়। আরবি ভাষার সমকালীন কবিদের মধ্যে তার স্থান প্রথম সারিতেই। তিনি সিরিয়ার জাতীয় কবি।

দামাস্কাসেই বড় হন তিনি, প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা করেন। আইনশাস্ত্রে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। কলেজে পড়বার সময়েই তার প্রথম কাব্য প্রকাশিত হয়। প্রেমের কবিতা, তাতে নারীদেহ সম্পর্কে এমন চমকপ্রদ বর্ণনা ছিল যে তাতে দামাস্কাসের রক্ষণশীল সমাজে নাড়া লাগে।

স্নাতক হবার পর কাব্বানি সিরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন। কনসাল বা সাংস্কৃতিক এটাচে হিসাবে বিভিন্ন দেশের রাজধানীতে কাজ করেন তিনি। ১৯৬৬ সালে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবার আগে পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করেন। এই সময় তার লেখালেখিও অব্যাহত থাকে। পদত্যাগের পর বৈরুতে একটি প্রকাশনা সংস্থা স্থাপন করেন তিনি।

কাব্বানির বয়স যখন পনের তখন তার পঁচিশ বছর বয়সী বোন আত্মহনন করেন। তার পছন্দের নয় এমন এক লোকের সাথে বিয়ে হওয়া ঠেকাতেই তিনি এই পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। বোনের অন্তেষ্টিক্রিয়ার সময় কাব্বানি সিদ্ধান্ত নেন যে সামাজিক এইসব অসঙ্গতির বিরুদ্ধে তিনি লড়বেন।

তিনি বিপ্লবী কিনা এই প্রশ্নের জবাবে একবার তিনি বলেন, ‘আরব জগতে প্রেম বন্দীদশায় আছে, আমি একে মুক্ত করতে চাই। আমার কবিতা দিয়ে আমি আরবের আত্মা, অনুভব ও শরীরকে স্বাধীন করতে চাই। আমাদের সমাজে নারী-পুরুষের সম্পর্ক স্বাস্থ্যকর নয়।’ তিনি তার সময়ের সবচাইতে প্রগতিশীল ও নারীবাদী বুদ্ধিজীবী হিসেবে বিবেচিত।

তার কবিতায় তার শহর দামাস্কাস বারংবার চিত্রিত হয়েছে। ১৯৬৭ সালে ছয়দিনব্যাপী যে যুদ্ধ হয়েছিল তা তাকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে। আরবভূমির কান্না তার কবিতায় করুণভাবে চিত্রিত। যৌনতাপ্রবণ কবিতা থেকে তার কাব্যচর্চা ক্রমে রাজনৈতিক ও প্রতিরোধমূলক হয়ে ওঠে।

কাব্বানি শেষ জীবনটা লন্ডনে কাটান পনের বছর ধরে। সেখানেই ১৯৯৮ সালে পঁচাত্তর বছর বয়সে লোকান্তরিত হন। তার ইচ্ছানুসারে তাকে দামাস্কাসে সমাহিত করা হয়।


গ্রীষ্মে

গ্রীষ্মে
সৈকতে হাত-পা ছড়ালাম
আর তোমার কথা ভাবলাম।
সাগরকে যদি বলে দিতাম
তোমাকে নিয়ে আমি কী অনুভব করছি
তবে সে ছেড়ে আসত তার কূল
তার ঝিনুক-শামুক
তার মাছ,
আর আমার পিছে পিছে চলে আসত।

সাগরে প্রবেশ

অবশেষে প্রেম হলো,
আর আমরা বেহেশতে ঢুকলাম,
পিছলিয়ে
পানির চামড়ার নিচে
মাছের মতন।
আমরা দেখলাম সাগরের দুর্লভ মুক্তাগুলো
আর চমৎকৃত হলাম।
অবশেষে প্রেম হলো
কোনো ভয়-ভীতি ছাড়াই
মাছের সমাধিতে।
সুতরাং আমি দিলাম...তুমিও দিলে
আর আমরা ঠিকঠাক ছিলাম।
অবাক-করা সহজভাবে হলো এটা
জুইঁগন্ধী পানি দিয়ে লেখার মতন
মৃত্তিকায় বসন্তের প্রবাহের মতো।

যখন কেউ প্রেমে পড়ে

যখন কেউ প্রেমে পড়ে
প্রাচীন শব্দ সে কি ব্যবহার করতে পারে?
কোনো মেয়ে কি
চাইবে যে তার প্রেমিক
শুয়ে থাকুক
ব্যাকরণবিদ আর ভাষাতাত্ত্বিকের সাথে?
আমি কিছুই বলি নাই
ওই মেয়েটিকে, যাকে ভালোবেসেছি,
বরং একটি স্যুটকেসের ভিতরে
জড়ো করেছি
প্রেমের যত বিশেষণ আছে সব,
আর সমস্ত ভাষা থেকে পালিয়ে গেছি।

আমার প্রেমিকা জিজ্ঞেস করল

আমার প্রেমিকা আমাকে জিজ্ঞেস করল
‘আমার আর আকাশের মধ্যে
কী পার্থক্য আছে?’
পার্থক্যটা হলো এই :
যখন তুমি হাসো
তখন আমি আকাশের কথা ভুলে যাই।
যখন আমি ভালোবাসি
যখন আমি ভালোবাসি
তখন অনুভব করি, আমি সময়ের রাজা,
পৃথিবী আর এতে যা কিছু রয়েছে সবই আমার,
আর আমি ঘোড়ায় চেপে সূর্যে যাচ্ছি।

যখন আমি ভালোবাসি

তখন আমি তরল আলোয় পরিণত হই
চোখে দেখা যায় না যা
আর আমার খাতায় লেখা কবিতাগুলো
লজ্জাবতী ও পপি ফুলের ক্ষেত হয়ে ওঠে।
যখন আমি ভালোবাসি
আমার আঙুলগুলো হতে প্রবলভাবে পানি নির্গত হয়
আমার জিহ্বায় গজায় ঘাস
যখন আমি ভালোবাসি
তখন আমি সকল সময়সীমার বাইরের সময় হয়ে উঠি।
যখন আমি কোনো নারীকে ভালোবাসি
সবগুলো বৃক্ষ-তরু-গাছ
খালি পায়ে আমার দিকে ছুটে আসে...

প্রেমের তুলনা

আমি তোমার অন্য প্রেমিকদের মতো না,
ও আমার প্রিয়া;
অন্যে যদি তোমাকে মেঘ দেয়
আমি দেই বৃষ্টি,
অন্যে যদি লণ্ঠন দেয়
আমি দেব চাঁদ,
অন্যে যদি তরুশাখা দেয়
আমি দেব বৃক্ষসকল,
আর অন্যে যদি তোমাকে জাহাজ দেয়
আমি তোমাকে ভ্রমণ দেব।

গনক

দুচোখে ভয় নিয়ে বসে ছিল সে
উল্টানো কাপটিতে মনোনিবেশ ছিল তার,
বলল সে, দুঃখ পেয়ো না, বাবা,
ভাগ্যে আছে, প্রেমে পড়বে তুমি।
বাবা রে, যে তার প্রিয়র জন্য
নিজেকে উৎসর্গ করে, সে শহিদ হয়।
বহুকাল ধরে আমি ভাগ্য গুনে আসছি,
কিন্তু তোমার মতো পাঠ করি নাই আগে;
বহুকাল ধরে আমি ভাগ্য গুনে আসছি
তোমার মতো দুঃখ আমি দেখি নাই আগে।
প্রেমের সাগরে চিরকাল পালবিহীন নৌযানে ঘুরে বেড়ানোই পূর্বনির্ধারিত আছে,
তোমার জীবন একটি কান্নার বই হবার জন্য পূর্বনির্ধারিত আছে,
আর পানি ও আগুনের মাঝে বন্দী হয়ে থাকা।
কিন্তু সমস্ত যন্ত্রণা সত্ত্বেও
সকল দুঃখময়তা সত্ত্বেও
ওইটিই আমাদের সাথে আছে দিবানিশি
বাতাস সত্ত্বেও
বৃষ্টিপাত সত্ত্বেও
সামুদ্রিক ঝড় সত্ত্বেও
ভালোবাসাই, বাপ আমার,
ওইটিই চিরকাল সবচেয়ে ভালো ভাগ্য।
তোমার জীবনে একটি মেয়ে আছে, বাবা,
তার চোখগুলো এত সুন্দর যে তা আল্লাহ তায়ালার রহমত,
তার মুখ আর হাসি গোলাপ ও গানে ভরপুর,
আর তার যাযাবর ও পাগলা জীবনের প্রেম সারা দুনিয়া ঘুরে বেড়ায়।
যে মেয়েটিকে তুমি ভালোবাসো সে-ই তোমার সমস্ত জগৎ হতে পারে,
কিন্তু তোমার আকাশ বৃষ্টিময় থাকবে,
তোমার পথে থাকবে বাধাবিঘ্ন,
বাধায় আকীর্ণ থাকবে পথ, বাপ আমার।
তোমার প্রেমিকা একটা পাহারায় ঘেরা প্রাসাদে ঘুমিয়ে আছে,
যে তার বাগানের কাছে যাবে
যে তার ঘরে ঢুকবে
এবং যে তাকে প্রস্তাব দেবে
অথবা তার সাথে মিলিত হতে যাবে
তার হারিয়ে যাবার কারণ ঘটাবে সে,
বাপ আমার, হারিয়ে যাওয়া...
তুমি খুঁজবে তাকে সব জায়গায়, বাবা,
তুমি সাগরের ঢেউরাশিকে জিজ্ঞেস করবে তার কথা,
তুমি সাগরের কূলকে জিজ্ঞেস করবে,
তুমি সমুদ্রসমূহে ঘুরে বেড়াবে,
তোমার অশ্রুরাশি বয়ে যাবে নদীর মতো।
আর জীবনের শেষপ্রান্তে এসে
তুমি বুঝতে পারবে যে যেহেতু তোমার প্রিয়তমার
দেশ নাই, বাসা নাই, ঠিকানা নাই,
তুমি কেবল একটা ধোঁয়ার চিহ্নের পিছে ছুটেছিলে।
এটা কত কঠিন ব্যাপার, বাপ আমার,
এমন একটা মেয়েকে ভালোবাসা
যার কোনো দেশ নাই,
যার কোনো বাসা নাই।

জেরুজালেম

চোখের পানি না শুকানো পর্যন্ত আমি কাঁদলাম
মোমবাতি নিভে যাওয়া পর্যন্ত কাঁদলাম আমি
মেঝেতে ফাটল ধরা পর্যন্ত আমি হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে থাকলাম
মোহাম্মদ ও যিশু সম্পর্কে জানতে চাইলাম আমি
ওগো জেরুজালেম, নবীদের সৌরভ,
পৃথিবী ও আকাশের মধ্যকার সংক্ষিপ্ত পথ
ওগো জেরুজালেম,
আইনের সভাঘর
অপরূপ এক শিশু যার আঙুলগুলো
পুড়ে কালো হয়ে গেছে আর চোখদুটো আনত
ছায়াময় মরুভূমি তুমি নবীগণ যার মধ্য দিয়ে গেছেন
তোমার সড়কগুলো বিষণ্ণ
তোমার মিনারগুলো শোকগ্রস্ত
তুমি এক কলো পোশাক পরা তরুণী,
কে বাজায় ঘণ্টা যিশুর জন্মের স্মরণে
শনিবার সকালে?
শিশুদের জন্য কে আনে খেলনা
বড়দিনের প্রাক্কালে?
ওগো জেরুজালেম,
চোখে বহমান বিশাল অশ্রু
কে থামাবে আগ্রাসন
তোমার ওপরে, ওগো ধর্মসমূহের মুক্তা?
কে তোমার রক্তমাখা দেয়ালগুলো ধুয়ে দেবে?
কে রক্ষা করবে বাইবেল?
কে উদ্ধার করবে কোরান?
কে বাঁচাবে খ্রিস্টকে?
কে বাঁচাবে মানুষ?
ওগো জেরুজালেম, আমার শহর
ওগো জেরুজালেম, আমার প্রেম
লেবু গাছগুলোয় কাল ফুল ফুটবে
জলপাই গাছগুলো আনন্দ করবে
তোমার চোখ নেচে উঠবে
দেশান্তরী পায়রাগুলো ফিরে আসবে
তোমার ভীতসন্ত্রস্ত ছাদে
আর তোমার শিশুরা খেলবে আবার
পিতাপুত্রের মিলন হবে
তোমার গোলাপশোভিত পাহাড়ে
আমার শহর
আমার শান্তি ও জলপাইয়ের শহর।

সুলতান

আমাকে যদি নিরাপত্তার ভরসা দেওয়া হতো
আমি দেখা করতাম সুলতানের সাথে
বলতাম তাকে: মহামান্য হে সুলতান,
আপনার ক্ষুধার্ত কুকুরগুলো আমার পোশাক ছিঁড়ে ফেলেছে
আপনার গোয়েন্দারা সারাক্ষণ অনুসরণ করছে;
তাদের চোখ
তাদের নাক
তাদের পা আমাকে তাড়া করে ফিরছে
ভাগ্যের মতো, নিয়তির মতো;
তারা জিজ্ঞাসাবাদ করে আমার স্ত্রীকে
আর আমার সকল বন্ধুদের নামের তালিকা বানায়।
হে সুলতান!
এর কারণ আমি আপনার বধির দেয়ালের দিকে এগোতে সাহস করি,
আমি প্রকাশ করেছি আমার ব্যথা ও বেদনা,
আমাকে জুতাপেটা করা হয়েছে।
হে আমার প্রভু, হে সুলতান!
যুদ্ধে আপনি দুইবার হেরেছেন,
কারণ আপনার জনগণের অর্ধেকেরই
জিহ্বা নাই।

যখন আমি তোমাকে ভালোবাসি

যখন আমি তোমাকে ভালোবাসি
একটি নতুন ভাষা জেগে ওঠে
নতুন নতুন শহর, নতুন নতুন দেশ
আবিষ্কৃত হয়।
ঘণ্টাগুলো কুকুরছানার মতো শ্বাস নেয়,
বইয়ের পৃষ্ঠার ফাঁকে ফলে ওঠে গম,
তোমার চোখ থেকে পাখি উড়ে যায় মধুর খবর নিয়ে,
তোমার বুক থেকে কাফেলা রওনা হয়
ভারতীয় বনৌষধি নিয়ে,
চারপাশে আম ঝরে পড়ে,
বনে শুরু হয় দাবদাহ,
আর দামামা বাজতে থাকে।
যখন আমি তোমাকে ভালোবাসি
তোমার বক্ষ সব লজ্জা ঝরিয়ে ফেলে,
পরিণত হয় বিজলি ও বজ্রপাতে,
তরবারি ও ধূলিঝড়ে।
যখন আমি তোমাকে ভালোবাসি, আরবের শহরগুলো
জেগে ওঠে, প্রতিবাদ জানায়
নিগ্রহের কালের বিরুদ্ধে,
উপজাতীয় আইনের বিরোধিতায় প্রতিশোধের কালের বিরুদ্ধে।
এবং আমি, যখন তোমাকে ভালোবাসি, তখন
এগিয়ে যাই কুৎসিতের বিরুদ্ধে,
লবণের রাজাদের বিরুদ্ধে,
মরুভূমিকে প্রতিষ্ঠানীকরণের বিরুদ্ধে।
আর আমি তোমাকে ভালোবেসে যাব
যতক্ষণ না বিশ্ববন্যা আসে,
আমি তোমাকে ভালোবেসে যাব
যতক্ষণ না বিশ্ববন্যা আসে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর