রবের্তো হুয়াররোসের একগুচ্ছ উল্লম্ব কবিতা

অনুবাদ কবিতা, শিল্প-সাহিত্য

ভূমিকা ও অনুবাদ: আলম খোরশেদ | 2023-09-01 22:41:25

রবের্তো হুয়াররোস [Roberto Juarroz] (১৯২৫-১৯৯৫) আর্হেন্তিনা তথা লাতিন আমেরিকার একজন গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু তুলনামূলকভাবে স্বল্পজ্ঞাত কবি। এর প্রধান কারণ, তিনি নিজে ছিলেন নিভৃতচারী, তদুপরি প্রচারবিমুখ। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রবের্তোর কবিতার আপাতদুর্বোধ্যতা, জটিল দার্শনিকতা এবং প্রাকরণিক স্বাতন্ত্র্য। তিনি তাঁর কবিতাকে বলেন, Poemas Verticales অর্থাৎ ‘উল্লম্ব কবিতা’। তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত মোট চোদ্দটি কাব্যগ্রন্থের নামকরণও করেন তিনি এই একটি সাধারণ নামেই; এমনকি গ্রন্থভুক্ত কবিতাসমূহেরও নেই আলাদা কোনো শিরোনাম।

তাঁর কবিতার এমন নামকরণের পেছনে নিশ্চিত ও সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা না থাকলেও, ধারণা করা যায়, হুয়াররোসের কবিতার দৃশ্যমান জ্যামিতিকতা ও প্রবল কাঠামোবদ্ধতা এর অন্যতম কারণ হতে পারে। বলা হয়ে থাকে, তাঁর কবিতাকে ওপর এবং নিচ, দুদিক থেকেই পাঠ করা যায়। এই বাক্যের সমর্থনে তাঁর নিজেরই একটি কবিতাকে এখানে উদ্ধৃত করা যেতে পারে।
“ওপরের দিকে যাওয়া
নিচে যাওয়ার থেকে
একটু হ্রস্ব কিংবা দীর্ঘ হওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়।”

এছাড়া, রবের্তো হুয়াররোসের কবিতাবিষয়ে  প্রখ্যাত মেহিকান কবি ওক্তাবিও পাসের এই মন্তব্যটিকেও এখানে প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করি।
“উল্লম্ব কবিতা: ঊর্ধ্বমুখী এবং নিম্নমুখী, ঝর্ণামুখ যেখানে উচ্ছৃত হয় আত্মার সুপেয় জল, এবং মিনারচূড়া, যেখানে নমিত হয় চিন্তার মুক্তবায়ু।”

এখানে অনূদিত কবিতাসমূহ উৎকলিত হয়েছে পুলিৎজার-পুরস্কৃত, প্রখ্যাত মার্কিন কবি ডব্লিউ এস মারউইনের (১৯২৭-২০১৯) ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত দ্বিভাষিক গ্রন্থ Vertical Poetry by Roberto Juarroz থেকে, যেখানে তিনি হুয়াররোসের তৎপর্যন্ত প্রকাশিত মোট নয়টি কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত কবিতানিচয়ের একটি সুনির্বাচিত, প্রতিনিধিত্বশীল গুচ্ছকে বেছে নিয়েছিলেন তাঁর এই গুরুত্বপূর্ণ অনুবাদপ্রকল্পের জন্য। এখানে উল্লেখ্য, ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত রবের্তো হুয়াররোসের কবিতার সর্বপ্রথম সংকলন এটিই।

দুই কবি : ওক্তাবিও পাস ও রবের্তো হুয়াররোস

এক.
অর্ধেক জীবন কিংবা হয়তো পুরোটারই পর
কিছু কিছু জিনিস টিকে যায়:
সমান্তরালেরা যেখানে কাঁপে সেই স্থান
মৃত প্রণয় বেঁচে ওঠে এরকম রাত
আলো নয়, ছায়া নয়, নয় মধ্যবর্তী কিছু
এমন কোনো মুহূর্ত,
অপরকে বাদ দিয়ে অসম্পূর্ণ, এমন জায়গা,
কিছু লোকদেখানো পরিচয়পর্ব।

আমাদের উপেক্ষা করা যে-আনুগত্যের আদল,
কেবল তার মধ্যেই সম্ভব
কিছুক্ষণের জন্য হলেও, সমস্তের অসম্ভাব্যতাকে স্থগিত রাখা।             

দুই.
প্রতিটি হাত তার মেঘেদের সাজায়
নিজস্ব আকাশে।

কিন্তু একদিন সে দেখে তার মেঘেরা ছড়িয়ে গেছে
সবার আকাশে।

তখনই কেবল সে পুনরায় হয়ে উঠতে পারে
সেই প্রতিশ্রুত ভূমি, যেমনটি ছিল
সে তার হাত-জন্মের আগে।

তখনই কেবল তার মেঘেরা
বৃষ্টি হয়ে ঝরবে তার ওপর।    

তিন.
(লাওরাকে)
একটি ঝরনা যেখানে অপর ঝরনার জননী
যেখানে অতীত কখনো অতীত হবার নয়
আমরা শুধু সেই বিন্দুটিকে রেখে বাকিদের মুছে দিতে পারি
অথবা অন্তত একটি নিরাপদ জায়গায় রাখতে পারি তাকে।      

চার.
ওপরের দিকে যাওয়া
নিচে যাওয়ার থেকে
একটু হ্রস্ব কিংবা দীর্ঘ হওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়।  

পাঁচ.
একজন মানুষ।
রাতের পুতুল।
শূন্যতাকে ছুরি মারে।

তবে একদিন
সেই শূন্যতা উন্মত্তের মতো তাকে প্রত্যাঘাত করে।

এবং তখন শূন্যতাজুড়ে
একটি ছুরি ব্যতীত আর কিছুই থাকে না।  

ছয়.
বস্তুরা আমাদের অনুকরণ করে।
বাতাসের কবলে পড়া টুকরো কাগজ
উড়ে চলে হোঁচট খাওয়া মানুষের মতো।
কোলাহলও আমাদের মতো কথা বলতে শিখে যায়
পোশাকেরা পায় তার পোষকের রূপ।

বস্তুরা আমাদের অনুকরণ করে
তবে শেষমেশ
বস্তুর নকল করি আসলে আমরাই।    

সাত.
হয়তোবা আরো এক স্থান আছে
যেখানে বাকি সবকিছুই ওজনদার,   
বস্তু ও দেবতা সবাই।
কেবল মানুষেরা
হবে সব ওজনবিহীন:  
কেননা কোনো মানুষই থাকবে না সেখানে।

আট.
নির্জনতা আমার নিজের নাম ছাড়া
আর সব নামে ডাকে আমাকে।

নির্জনতা মাঝেমধ্যে এমনকি
আমাকে তোমার নাম ধরেও ডাকে।

অন্যান্য সময় আবার
সে আমাকে তার নিজের নামেই ডাকে।

হয়তো কোনো একদিন
আমার নিজের নামেই আমি তাকে ডাকতে পারব
আর তখন নিশ্চিতভাবেই জানি
আমার ডাকে সাড়া দিতে হবে তাকে।

নয়.
আমার মনে হয় এই মুহূর্তে
সম্ভবত জগতের কেউই আমার কথা ভাবছে না,
আমিই একমাত্র আমাকে ভাবছি,
আর আমাকে এখন মরে যেতে হলে
কেউই আর, এমনকি আমিও, আমার কথা ভাববে না।

এখানেই সূত্রপাত হয় তলিয়ে যাবার,
অনেকটা যেভাবে ঘুমাতে যাই আমি।
আমিই আমার ভরসা, আমি যাকে ছিন্ন করি।
আমি সবকিছুকেই অনুপস্থিতি দিয়ে
সাজিয়ে তুলতে সাহায্য করি।

সম্ভবত একারণেই
আপনি যখন কারো কথা ভাবেন
তখন আসলে তাদেরকে বাঁচিয়েই দিচ্ছেন।     

দশ.
একটি দেয়াল, একটি গান
আর অদৃশ্যের ঝিলিক-লাগা বাতাস,
গানটা যেন দেয়ালের ওপর বসতে পারে।
অপর পাশে, একজন মানুষ।
সে এই দেয়াল তোলেনি,
গানটিও গায়নি,
সে এমনকি তা শুনছেও না।
কিন্তু বাতাসের ঝলকানি তার ছায়ার ভেতরে একটি বৃত্ত এঁকে দেয়
আর ঠিক মাঝখানে রাখে সেই গানখানি।

মানুষটি খানিক নত হয়ে আসে
(হয়তো বা সে বরাবরই তা-ই ছিল)।
যেন দেয়ালটিও নিচে নেমে এসে
তার চোখের ভেতর ঢুকে যেতে পারে।

একটি গান
(কে গাইছে সেটা নিয়ে নাইবা ভাবলেন)।
একটি দেয়াল
(সেটা কে বানিয়েছে তা নিয়ে নাইবা ভাবলেন)।
মসৃণ, প্রাণবন্ত বাতাস এক
(সেটা কোথায় যাচ্ছে তা নিয়ে নাইবা ভাবলেন)।
মানুষটির যদি অস্তিত্ব না-ও থাকত
তারা তাকে ঠিক বানিয়ে নিত।

এ সম্পর্কিত আরও খবর