একদিন, আংটির মতন

, শিল্প-সাহিত্য

অতনু সিংহ | 2023-08-25 10:22:33

জমে থাকা চিঠি পড়া হয় না কর্নেলের। কারণ সারাদিন তিনি অকাতরে ঘুমান। ডেকের অন্ধকার ঘর ভ’রে ওঠে কোমার মতো অসাড় তাঁর নিদ্রায়।
আগুন ইশারা রেখে একটি পাখি উড়ে চলে যায়। কর্নেল ঘুমায়ে থাকেন। ঝড়-জল, জাহাজের তীব্র ভোঁ তাঁর ঘুমের কাছে দাঁড়ায়, ছোটাছুটি করে। কর্নেল ঘুমায়ে থাকেন। কর্নেলকে আজকাল কে এক চিঠি লেখেন! কী নাম তাঁর? আনন্দী? আলভী? কোমাগুলির পাশে শব্দগুলি জড়ো হয়। মাস্তুল বয়ে চলে এক ভূগোল থেকে অন্য ভূগোলে ... সমুদ্রের রঙ বদলে যায়, হাওয়াতে একেক সময় একেকটা রঙ! কোমায় রঙ লাগে! আর চিঠিগুলি পেড্রো আলমোদোভারের সেই আধা-বাণিজ্যিক অথচ সুচারু স্প্যানিশ সিনেমার মতন।

‘টক টু হার’! যে ছবিতে নিষ্পাপ পাহাড়ি ফুলের মতন মেয়েটি অচেতন শুয়ে থাকে। আর একটি ছেলে তাকে বলে যায় নানাবিধ স্বপ্নের কথা, না হতে হয়ে ওঠা মুহূর্তগুলির কথা। ছেলেটির নাম আলফ্রেড।
ন্যারেটিভের পর্দা ভেদ করে ন্যারেশান ভিন্নে ভিন্নে ধায়। আর এভাবেই একটি বাঁকের মুখে ঘুমন্ত প্রেয়সীকে ঘাঁই পাহাড়ের মতন বিশালাকার মনে হয় আলফ্রেডের। আলফ্রেড তার প্রেম ও প্রেয়সীর কাছে নিজের আকারকে অতি ক্ষুদ্র ভাবতে শুরু করে। নিজের জাগ্রত সত্তা আর জাগরণকে সে তার প্রেয়সীর ঘুমের মধ্যে বইয়ে দিতে চায় ।
একটি পতঙ্গকে, একটি সরীসৃপকে মালভূমির পড়ন্ত রোদে যেমন খুব কাছ থেকেও আর খুঁজে পাওয়া যায় না, আণুবীক্ষণিক সেই অস্তিত্বের মতোই ক্ষুদ্র আকার নিয়ে কোমায় ঘুমন্ত প্রেয়সীর শরীরের আনাচ-কানাচ ঘুরতে থাকে আলফ্রেড!

জঠরযাপনের পর যেভাবে মানুষ একদিন পেয়ে যায় জন্মদ্বার। আবার, জন্মের পর বাঁকাচোরা জীবনের সড়ক, অলিগলি, নদী, পাহাড়, প্রপাত, ইস্কুল, মদের দোকান, দিনলিপি, ভাঙাচোরা ক্যানভাস, সমুন্দর ইত্যাদি পার হয়ে পাওয়া যায় মৃত্যুর আরো এক দ্বার, যা জন্মের মতোই রহস্য আর আঁশটে গন্ধভরা, সেভাবেই অচেতন নিদ্রায় মগ্ন নারীর শরীরের সময় প্রবেশদ্বার পেয়ে যায় আলফ্রেড।
আসলে একটি স্বপ্নের বাঁকে আলফ্রেড হঠাৎই ক্ষুদ্র হয়ে গিয়ে তার ঘুমন্ত প্রেয়সীর শরীরের প্রবেশদ্বার দিয়ে শরীরের ভিতরে চলে গিয়েছিল। শরীরের মায়া-বাগানে ঘুরেফিরে হৃদপিণ্ডের মাঝে স্থিত হয়েছিল। সিনেমার দৃশ্যটা ছিল এমনই।
কিন্তু কর্নেল তো পুরুষ। তার জন্মদ্বার নেই। তাঁর ঘুমের পাশে যিনি চিঠি লিখছেন, তিনি কিভাবে কর্নেলের ঘুমের মধ্যভাগে আসবেন! হ্যাঁ এই জাগতিক, বাস্তবিক আলেখ্যে কর্নেল পুরুষ। কিন্তু যদি লজিকের পরাজাগতিক বিনির্মাণ হয়, তাহলে চিঠির শব্দগুলি আসলেই এক জাদুরূপান্তরের আলেক...

বিশ্বাসীদের বিশ্বাস অনুযায়ী মেরাজের সময় মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহ’র নিকটে গিয়েছিলেন। ফেরেশতা জিব্রাইল(আ.)-এর সাহায্যে নিরাকার আল্লাহ’র সম্মুখীন হয়েছিলেন তিনি। আর আল্লাহ কি-বা আকার, কি-বা বস্তু, কী তাঁর জেন্ডার, নাকি তিনি লৈঙ্গিক অস্তিত্বের উর্ধ্বে—ইত্যাদি বিষয়ে আলাপের থেকে মেরাজ ব্যাপারটাই গুরুত্বপূর্ণ। মেরাজ অর্থাৎ বস্তুভিত্তিক দৃশ্যমান অস্তিত্ব ও বস্তু নিরপেক্ষ ভাব বা এসেন্সের ব্যাপকতার মধ্যে সম্পৃক্তকরণ। আর শব্দ এক্ষেত্রে মাধ্যম, যেমন জিব্রাইল। যেভাবে ঘুমন্ত ও জাগ্রত দুই অবস্থার মধ্যে শব্দ এক মাধ্যম কর্নেল কিংবা আলমোদোভারের আলফ্রেডের গল্পে। তাই ‘মেরাজ হয় ভাবের ভুবন, গুপ্ত-ব্যক্ত আলাপ হয় রে দু’জন/ আবার কে পুরুষ আর কে প্রকৃতি তার শাস্ত্রে প্রমাণ কে রেখেছে’...

তাই কর্নেলকে লেখা চিঠিগুলিতে শব্দ তার জেন্ডার আইডেন্টিটি গুলিয়ে ফ্যালে! ঘুমের ভিতরেই পরজন্মে রাধা হয়ে যান কর্নেল। যেভাবে তিনি চুরুটে টান দিতে দিতে দিতে, স্কচের পেয়ালায় চুমুকে তাঁর গায়েবি মানুষীর জন্যে অনেকটা পদাবলি ঢঙে নিজের পুরুষ প্রকরণের মধ্যেই অজান্তে সিন্ডারেলা হয়ে গিয়েছিলেন একদিন। আর তাঁর প্রেমিকা কাউবয় হয়ে গিয়ে শব্দে শব্দে তাঁকে ঘুরিয়েছিলেন কথা বলা গবাদী পশুর খামারে। কিংবা তাঁকে কথা বলা গাছেদের দেশে ঘুরিয়ে এনেছিলেন। দিকনির্দেশনায় অনেকটা নির্ভরশীল হয়ে কর্নেল অনেকটা সময় যাপন করেছিলেন হ্যালেলুইয়াময় এক দেশে। সেভাবেই কর্নেলের ঘুমের ভিতর কে যেন শব্দের অদৃশ্য শরীর নিয়ে হাজির হতে চায়!
যেভাবে একদিন জানালার পাশে ডাকঘরের সুধা... যেভাবে ফকির...
যেভাবে জ্বরের বরফ দেশে আগুনের পতাকা নিয়ে কৃষিইস্তেহার শুনিয়ে গিয়েছিল যেন কারা...
কিন্তু কর্নেল ঘুমের ভিতরেই অজানা ভয়ে থাকেন। ফের ঘুম ভেঙে যাওয়ার ভয়। এবং পুনঃজাগরণ ও পুনর্নিদ্রার ভয়। কাউবয়ের আঙটির কথা তাঁকে তাড়া করে। যে কাউবয় এক জাগতিক মেরাজকালে লিখেছিল,
‘সবকিছু হারায়ে যায়
সবকিছুই হারায়ে যায়
একদিন, আংটির মতন’
এই ঘুমও কি হারায়ে যাবে কাউবয়? তোমাকে ডাকার শব্দগুলি যেভাবে একদিন ঘুমায়ে গিয়াছে! কর্নেল এই কথা ভাবতে থাকে ঘুমের গভীরে। তারই মাঝে চিঠি আসে।

জলের শব্দের মতন হুহু ক’রে চিঠি আসে। স্নানের ইচ্ছে জাগে। একই সাথে ভয়। কাউবয়ের দেওয়া হ্যালেলুইয়া পৃথিবীকে হারায়ে ফেলার ভয় ঘিরে ধরে ঘুমন্ত কর্নেলকে। চিঠি খোলা হয় না কর্নেলের অথবা ঘুমের ভিতরেই ঘুমচিঠি খোলেন কর্নেল, চিঠির মাঝখানে কর্নেল দ্যাখেন যাতে জাহাজ থামিয়ে একদিন ভোরে তিনি তৃণভূমে, যে সবুজ ঘাসের দেশ মিশে গেছে অরণ্যে... তিনি অরণ্যের দিকে হেঁটে যান... অথবা তাঁর দৃশ্যে একদিন খুব ভোরে পত্রলেখকের হাত ধরে এসেছেন কাউবয়, তাঁর ঘাড় স্পর্শ করে মাথা তুলছে সিঁদুরে আলোর ছটা, কাউবয়ের শরীর আর শরীরের বিভঙ্গ ক্রমে দৃশ্যমান লাজুক নারী... তাঁর নাম আনন্দী অথবা আলভি বোধহয়... অথবা তিনি এসব কিছুই দেখেন না কেবল ভাবেন অথবা ভাবা আর দেখা মিশিয়ে কিছু হতে পারে...

অরণ্যে চিঠিটার ভাঁজ খোলেন কর্নেল। চিঠি, অক্ষর, শব্দ আর প্রথম আলোর প্যাস্টেল আর ছায়ারঙ আর গাছে গাছে ঝোলানো আয়না... ইউকেলেলে বেজে ওঠে কোথাও... আর অনেক অনেক কথা বলা বাঘ, ভাল্লুক, হরিণ, শেয়াল, খরগোস, পাখি... আর কথা বলা গাছেরা, আর যেকটি মানুষ আজও বেঁচে আছে, তারা সবাই আজ অরণ্যযাপনে... 

গান হচ্ছে পরপর, কখনো সংকীর্তন, কখনো ফকিরি কখনো জ্যাজের ঝিলিক... কাউবয়ের স্তনের ওপর বসেছে প্রজাপতি এক... এ কবিতায় কখনো আলোকবাহী আকালযানের উপস্থিতি ছিল না, ছিল জন্মের দ্বার ছিল মৃত্যুর উপকথা, ছিল রোদের ওপর ভাবের ষোলোকলা প্রেম... সেই ভাব ঘিরে একদিন যদি আমরা সবুজ হতাম, যদি আমরা লাল হতাম...  সবুজ আর লাল হতো আমাদের বাস্তব, আমাদের অর্থাৎ কর্নেলের স্বপ্নবাস্তবের সাতটি সমুদ্র আর নদীঘেরা দেশের প্রান্তে একফালি বাসাবাড়ি আর আনন্দী আর কবিতার খাতা... 

রামপ্রসাদের গান হতো গুনগুন, ‘চাই না মা গো রাজা হতে...’ কর্নেল রাজা হতে চাননি, ভাসতে চেয়েছিলেন, তৃণভূমে বাস করতে চেয়েছিলেন কিছুদিন, আর চিঠি পড়তে পড়তে লিখতে চেয়েছিলেন নিজেও কিছু। আজ আর কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কর্নেল ভাবেন জাহাজে অনেক অনেক চিঠি জমা হয়েছে। আসলে জাহাজে কোনো ডাকঘর নেই। আজ আর কোনো পিছু ডাক নেই কর্নেলের। অকারণ ঘুম আছে, ঘুমের ভিতরে দৃশ্যও অকারণ...

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

এ সম্পর্কিত আরও খবর