রাজশালিক ও প্রহরী কুরুশের গল্প

, শিল্প-সাহিত্য

কাজী মাহবুব | 2023-08-22 12:15:55

জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়ায় থাকার সময়ে আমাদের পাশে যেই বস্তিটি ছিল, তারা ভীষণ গালাগাল দিত। আমাদের সময়টা ছিল অবসরে নিখাদ অপ্রয়োজনে ছাদে এসে দাঁড়াবার। আমরা প্রত্যেকেই সিনেমার অপ্রয়োজনীয় চরিত্রগুলির মতো হেঁটে এসে ধীরে ধীরে জড়ো হতাম। কেউ কেউ হুট করে এসেই প্রশ্ন করে বসত। আমরা তাদেরকে অপছন্দ করতাম এবং অপমানজনক উত্তর দিতাম।

পাশের বস্তির লোকগুলি ছিল গরীব। তারা কল চেপে বদনায় পানি ভরে পায়খানায় যেত। পুরুষরা এক হাতে বদনা নিয়ে অন্য হাত দিয়ে লুঙ্গি উঁচু করে ধরত। পায়খানায় যাওয়া নিয়ে তাদের ভেতর কখনো কোনো দ্বিধা দেখা যায়নি। কিন্তু মেয়েগুলি হয়তো কিছুটা লজ্জা পেত। তারা খুব চটপটে হলেও বদনা হাতে ধীরে অতি সলজ্জ পা ফেলে হেঁটে যেত। এসব দৃশ্য আমরা ছাদে দাঁড়িয়ে দেখতাম। দুপুরের দিকে বস্তির মেয়েগুলি কলতলায় গোসল করতে যেত। মেয়েগুলি সুন্দরী ছিল না মোটেও। তবু আমাদের আঠারো উনিশ বছর বয়সের লোভ হতো। আমরা আড়চোখে তাদের গোসল করার দৃশ্য দেখতে চাইতাম। তাদের কলতলা প্লাস্টিকের কাগজ মুড়ে ঢাকা ছিল। তবু ওপর থেকে দেখা যেত একটি মেয়ে এক হাত উঁচু করে মাথায় সরসর করে পানি ঢালছে। আমাদেরকে ছাদে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে বাড়ির সবচেয়ে বর্ষীয়সী বৃদ্ধাটি স্বরগ্রাম উঁচু করে আমাদের গালাগাল দিত। আমরা দেয়ালের ওপাশে লুকিয়ে যেতাম।

ঘর ছেড়ে ছাদে এসে দাঁড়ালে আমাদের এক বিচিত্র অনুভূতি হতো। তিনতলার ছাদের ওপর দাড়িয়ে ঝিলের ওপাশের ছ’তলা ভবনটিকে মনে হতো আমাদেরই সমান। পাশের চারতলা ভবনটিকে নিয়ে একটি ছেলে দুঃস্বপ্ন দেখেছিল। তখন আমাদের ছাদে খুব জ্বীনের উপদ্রব। আমাদের ক্লাসের একটি ছেলেকে প্রায়ই কেউ দূর থেকে ডাকত। সে হুস হুস করে না করত। আমরা শিউরে উঠতাম। ভয়, আনন্দ, রোমাঞ্চে আমাদের আঠারো উনিশ বছরের মন কোলাহল করে উঠত।

অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে বলা যায়, আমাদের ভেতর একজন কবি ছিলেন। আমরা তাকে কখনোই শ্রদ্ধা করিনি। তিনি মাঝে মাঝেই ডায়েরির পাতা ছিঁড়ে এনে আমাদেরকে তার সদ্য লেখা কবিতাটি শোনাতেন। আমরা তার অন্য কথার মাঝে “শালা বাঞ্চোত” বলে গালি দিলেও কবিতাটি চুপ করে শুনতাম। তারপর একটি লাইন ধরে বলতাম, এই লাইনটি একটি মহাকালিক ব্যঞ্জনার ইঙ্গিত দেয়। এইখানে জীবনানন্দের সঙ্গে আপনার দারুণ মিল, কবি!

আমাদের মাদ্রাসার পেছনে ছিল একটি ভীষণ ফ্যাকাসে কবরস্থান। তার বুকে অল্পই ঘাস জন্মেছিল। বেশি জন্মেছিল হাহাকার। ওদিকে তাকালেই বুক হা হা করত। শত শত মানুষ এক অসীম নিঃসঙ্গতা বুকে নিয়ে অনন্তকাল শুয়ে থাকবে এখানে। আমরা দেখতাম, প্রতিটি মৃতমানুষের শিয়রে একটি কুরুশ দাঁড়িয়ে আছে প্রহরীর মতো।

কবরস্থানের মাটি ছিল ভীষণ স্যাঁতস্যাঁতে। একটু বৃষ্টি হলেই অদ্ভুত নেশাধরা মৃতগন্ধ নাকে আসত। কবরস্থান থেকে একটি নারকেল গাছ এসে আমাদের তিনতলার বারান্দায় ছায়া দিত। নারিকেল গাছটির একটি ডাল আমাদের ব্যালকনিতে এসে থালার মতো মেলে থাকত। আমাদের কবি ভদ্রলোক সত্যি সত্যিই সেখানে এক মুঠ ভাত ছড়িয়ে দিয়ে পাখি ডাকতেন। আমরা কখনো কখনো হুল্লোড় করে বারান্দায় ঢুকে পড়তাম। কবি চোখ বড় করে তর্জনী ঠোঁটে চেপে হুস হুস করে বলতেন, শব্দ করবেন না বন্ধুগণ!
একদিন আমাকে বললেন, কাজী মাহবুব! আপনি তো একজন ভীষণ অথর্ব। দেখে যান, রাজশালিকের গলার রেখাটি কেমন ফুলের মালার মতো।
আমি বললাম, আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না কবি।
তিনি বললেন, আপনাকে এসব দেখতে হবে কেন? আপনি বরং অশ্লীল সাহিত্য পাঠ করুন। এবং শুনুন, জনসম্মুখে নয়। সোজা বাথরুমে চলে যান।
কবিটি ছিলেন ভীষণ খ্যাপাটে। তিনি একজন মৌলবাদী ছাত্রকে বোঝাচ্ছিলেন, সময় ভ্রমণ করে অতীতে ফেরা সম্ভব। ভদ্রলোকটি বারবার টুইন প্যারাডক্সের প্রসঙ্গ টেনে আনছিল। কবি ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, বোকাচোদা! আমার মনে হলো অতীতে ফেরা কিংবা না ফেরা নিয়ে নয়। গালিটি শোনার পরই তিনি প্রথমবার এবং সত্যিকার অর্থেই বোকাচোদা হয়ে গেলেন।

কবির সঙ্গে নারকেল গাছে বাসা বাঁধা একটি কাকের রহস্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। কাকটির ছিল তিনটি আহারপোষ্য ছানা। তারা দিনরাত নারকেল গাছের মাথায় বসে থাকত। কতদিন এভাবে বসে ছিল মনে নেই। কবি কোনো কোনো দুপুরে কাকের বাসায় ঢিল ছুঁড়তেন। কাকটি উড়ে এসে তাকে ঠোকর দিতে চাইত। তিনি মুখ ঢেকে জনসমাগমের দিকে পালিয়ে যেতেন।

মাদ্রাসার পেছনের কবরস্থানটির কথা বলছিলাম। বৃষ্টি হলেই অদ্ভুত নেশাধরা মৃতগন্ধ আসত। সারি সারি কুরুশের প্রহরা শেষ হলে একটি সংক্ষিপ্ত ছাদের নিচে দেখা যেত যীশুখ্রিস্টের মূর্তি। সেই ঘরটিকেই আমার গীর্জা ভেবে ভ্রম হতো। ভাবতাম এখুনি বুঝি ঢংঢং করে ঘণ্টাগুলি বেজে উঠবে। আমি বারান্দার রেলিং ধরে অপেক্ষা করতাম। ঘণ্টাগুলি কখনোই বেজে উঠত না। একদিন সন্ধ্যা হয়েছিল। আমরা সবাই দেখলাম, কবরস্থানের ভেতর একটি রহস্যময় সবুজ বাতির ঘর। ধরে নিলাম এই বুঝি ব্যাপটাইজের ঘর। আজ গীর্জার ফাদার একজন অপরাধীকে শিশু বানিয়ে দেবেন। আমাদের খুব উত্তেজনা এবং আনন্দ হলো।

সকালে যখন আমাদের ঘুম ভাঙল, তখন বুঝলাম, সবুজ বাতি নয়, এটি একটি সবুজ পলিথিনের ঘর। তাই বাতির আলো আমাদের চোখে সবুজ হয়ে ঠেকেছিল।

আমরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলাম, এক হাতে শীতল অঙ্গারের গুঁড়ো নিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে রাজমিস্ত্রিরা বেরিয়ে আসছে। আমি সবাইকে বললাম, বন্ধুগণ, সকলেই আপন বোকা বোকা চিন্তাগুলির জন্য লজ্জিত হতে থাকো।

লজ্জার পরিবর্তে তারা উচ্চস্বরে হেসে উঠল।

আমাদের মাদ্রাসার পাশেই যেই বস্তিটি ছিল, যারা উচ্চস্বরে গালাগাল দিত, বাড়ির পুরুষগুলি বদনা হাতে নির্দ্বিধায় পায়খানায় যেত, মেয়েগুলি কলতলায় একটু আড়াল করে গায়ের সপসপে ভেজা কাপড়গুলি বদলে ফেলত, বাড়ির বর্ষীয়সী মহিলাটি ছানিপড়া চোখে এমন একজন যুবককে তন্ন তন্ন করে খুঁজত যে তার নাতনীর উৎসাহী বুকের দিকে তাকিয়ে আছে। অনেকগুলি বছর আমরা আমাদের ছাদে এবং তারা তাদের বাড়িতে বাড়িতে কাছাকাছি বসবাস করেছি। তাদের ঘরের ওপর দিয়ে ঝিলের পানিতে কাগজের প্লেন ছুঁড়ে দিয়েছি। আমাদের অকৃতকার্য প্লেনগুলিতে তাদের টিনের চাল ছেয়ে গেছে। আমরা পরস্পর এতটাই কাছাকাছি বাস করেছি, দেয়ালে কান পাতলে তাদের সঙ্গমের শব্দ শোনা যেত। তবু আমাদের জীবনযাত্রায় তাদের কোনো প্রভাব পড়েনি। আমরা কখনোই তাদের স্মৃতিচারণ করিনি। এমনকি, আমরা যখন রাস্তায় একা একা হাঁটতাম, অগণিত মানুষের মুখের ছাপচিহ্ন আমাদের মাথায় এসে ভর করত, তখনও আমরা তাদের কথা ভাবিনি।

একদিন রাতের অন্ধকার গাঢ় হতে থাকলে, আমাদের ছাদে জড়ো হতে অল্প সময় বাকি আছে—সেই বস্তির ভেতর থেকে ভীষণ ঝগড়ার শব্দ শুনতে পেলাম। আমরা তখনও ইশার নামাজ পড়ি। প্রচণ্ড কৌতূহলে আমরা তিন রাকাত বিতরের নামাজ ফাঁকি দিলাম। অতি উৎসাহী কেউ কেউ দুই রাকাত সুন্নতও পড়ল না।

আমরা ছাদে জড়ো হয়ে একটি হলুদ বাতির আলোয় সেই লোকটিকেই উচ্চস্বরে কথা বলতে দেখলাম, যাকে আমরা দিনের বেলায় রাজমিস্ত্রির কাজ করতে দেখি।

লোকটির ছিল মধ্যবয়স। ঘন দাঁড়ির কয়েকগাছি সাদা হওয়া। ঝগড়া বেঁধেছে তার ছেলের সঙ্গে। ছেলেটি ঘরের ভেতর দস্যুর মতো অনেক কিছু ভেঙে ফেলেছে। তার দাদিকে দরজার চৌকাঠ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে। এবং আরো অনেক অপরাধ করেছে।

বাবা লোকটি একটি রান্না করার লাকড়ি নিয়ে বারবার ছেলেকে খুন করতে উদ্যত হচ্ছিল। আর তখনই প্রতিবেশীরা তাকে ধরে ফেলছিল এবং ছেলেটিকে একটি দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে ফেলছিল। একজন প্রতিবেশি তাকে বলল, ভাই সাহেব! ছেলেটি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছে। তথাপি আপনি তাকে ক্ষমা করুন। সে তো আপনারই ছেলে।

প্রতিবেশীর এই কথা শুনে বাবা ভদ্রলোকটি পুনরায় বলে উঠল “ছেলের মায়েরে আমি চুদি। চুতমারানির ছেলে আমার খাবারের ডুলিটি কেন ভেঙে ফেলল?”

প্রতিবেশিদের হস্তক্ষেপে পিতাপুত্রের সেই ঝগড়ার একটা বিহিত অবশেষে হলো। অপরদিকে তিনতলার ছাদের ওপর বাবা ভদ্রলোকটির ছেলেকে দেওয়া এই গালিটি সত্যিকার অর্থেই কোনো গালি হলো কিনা, নাকি কেবলই একটি নিখাদ সত্যি কথা সাহস করে বলে দেওয়া হলো, তা নিয়ে আমরা দারুণ বিতর্কে মেতে উঠলাম।

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

এ সম্পর্কিত আরও খবর