১৯৭১: বিদেশি পত্রিকায় মার্চ থেকে ডিসেম্বর (পর্ব ২)

ইতিহাস, শিল্প-সাহিত্য

অনুবাদ ও গ্রন্থনা : আন্দালিব রাশদী | 2023-08-31 11:03:14

১৯৭১-এ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে তথা সত্যের পক্ষে যুদ্ধে নেমেছিলেন সংবাদকর্মী সিডনি শনবার্গ, মাইকেল লরেন্ট, অ্যান্থনি ম্যসকারেনহাস, লেয়ার লেভিন, ড্যান কোগিন, সাইমন ড্রিঙ, নিকোলাস টোমালিন, মার্ক টালি, ক্লেয়ার হোলিংওয়ার্থ, মার্টিন ওলাকট, জন পিলজার, ডেভিড লোশাক, পিটার হ্যাজেলহার্স্ট ও আরো অনেকে।

২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী যখন হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠল, তার সাক্ষী হয়ে রইলেন কজন বিদেশি সাংবাদিক। ৩৫ জন বিদেশি গণমাধ্যম প্রতিনিধিকে ৪৮ ঘণ্টারও বেশি সময়ের জন্য আটকে রাখা হয় ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। ২৭ মার্চ বলপ্রয়োগ করে পূর্ব পাকিস্তান থেকে তাঁদের বহিষ্কার করা হয়। উড়োজাহাজে তোলার আগে সাংবাদিকদের তল্লাশি করা হয়। তাঁদের নোটবই, ছবির ফিল্ম ও ফাইল বাজেয়াপ্ত করা হয়। বহিষ্কৃত সাংবাদিকেরা যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্স, জাপান ও রাশিয়ার সংবাদপত্রসহ অন্যান্য গণমাধ্যমে কর্মরত ছিলেন। বহিষ্কারের কারণ জানতে চাওয়া হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা বলেন, ব্যাখ্যা করার কিছু নেই, এটা আমাদের দেশ।

মার্চ থেকে ডিসেম্বর প্রতিমাসের একটি করে নমুনা অনূদিত ও সংকলিত হলো, কোনো পুরোপুরি, কোনোটা আংশিক, ডিসেম্বরে কেবল দুটো।


পর্ব ১ ● মার্চ থেকে আগস্ট পড়তে ক্লিক করুন এখানে

দ্যাগব্লাদেত
সেপ্টেম্বর: পূর্ববাংলার মানুষকে সাহায্য করুন [পর্যালোচনা]


পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর যে আঘাত করা হয়েছে, তার ব্যাপ্তি যে কত বিশাল, পৃথিবী এখনো তা বুঝে উঠতে পারেনি। বছরের শেষ নাগাদ এক কোটি মানুষ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবে। এতে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, যেখানে শরণার্থীরা আশ্রয় নিয়েছে, সেখানে ভয়ংকর পুষ্টিসংকটের সৃষ্টি হতে যাচ্ছে।

শরণার্থী শিবিরে যাঁরা কর্মরত, তাঁরা মনে করেন, স্বল্পতম সময়ের মধ্যে সাহায্য না পাওয়া গেলে এক লাখ শিশু ক্ষুধাজনিত মৃত্যুঝুঁকিতে পড়বে। পশ্চিমবঙ্গে ভারত সরকারের স্থাপিত শরণার্থী শিবিরে মাত্র ৩০ লাখ শরণার্থী ঠাঁই পেয়েছে। এই রাজ্যে শরণার্র্থী এসেছে ৫০ লাখ। তার মানে, ২০ লাখ শরণার্থী গ্রাম ও শহরাঞ্চলে রাস্তার ওপর অথবা যেখানে সামান্য ঠাঁই পাওয়া যায়, সেখানেই পড়ে আছে।

ক্ষুধা ছাড়াও এখন কলেরা চলছে। এই মহামারীর প্রকোপ কিছুটা কমিয়ে আনা সম্ভব হলেও অপুষ্টির শিকার ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম, এমন মানুষের মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না। প্রতিরোধ ক্ষমতা যাদের কম, তাদের প্রায় সবাই শিশু। ভয়ংকর হুমকির মুখে যে এক লাখ শিশু রয়েছে, তারা ছাড়াও তিন লাখ শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে।

এই সংখ্যার ভেতরেই লুকিয়ে আছে পূর্ব পাকিস্তান ট্র্যাজেডিস্বরূপ, যা বাইরের মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। এর আকার এতই বড় যে বায়াফ্রা ট্র্যাজেডির তুলনায় তা অনেক ছোট। অপর্যাপ্ত হলেও ত্রাণকর্ম যতটুকু হয়েছে, তা অবশ্যই বিবেচনাযোগ্য। ৫০০ মিলিয়ন নরওয়েজিয়ান ক্রোনার সাহায্য দেওয়া হয়েছে—এতেই ট্র্যাজেডির ব্যাপকতা বোঝা যায়। আর এ অঙ্কও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এ মাসের শেষ দিকে জাতিসংঘের শরণার্র্থী কমিশনের কাজ চালিয়ে যেতে হলে আরো ৭০০ মিলিয়ন ক্রোনার প্রয়োজন পড়বে।

দুর্দশার মোজাইক ● এডওয়ার্ড কেনেডি
অক্টোবরে প্রকাশিত উইটনেস অব সিক্সটিজ-এ বাংলাদেশের যুদ্ধদিনের বন্ধু এডওয়ার্ড কেনেডির লেখা


ক্যাম্পে ভিড় করা রাশি রাশি শরণার্থীর কথা আমি শুনেছি। খোলা মাঠে কিংবা সরকারি ভবনের পেছনে, দিনের পর দিন সপ্তাহের পর সপ্তাহ মরিয়া হয়ে পা টেনে টেনে হেঁটে আসা মানুষ, কলকাতার রাস্তার অস্থায়ী আশ্রয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তাদের চেহারা এবং তাদের কাহিনী লজ্জার দীর্ঘ চিত্র রচনা করে, যা পৃথিবীর সকল মানুষের নৈতিক সংবেদনশীলতাকে হতবাক করে রাখে। আমি দেখেছি, এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পের অবস্থার মধ্যে ব্যাপক তারতম্য রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশেরই বর্ণনা দেওয়া অসম্ভব। সরবরাহের অপর্যাপ্ততায় পয়ঃনিষ্কাশনের ভীতিকর অবস্থায় সেই শরণার্থীদের যারা কাশিতে ভুগছে, তারা শিশু—যাদের বয়স পাঁচ বছরের কম—এবং বয়োবৃদ্ধ। তারাই সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী। এদের আনুমানিক সংখ্যা মোট শরণার্থীর প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ। এই শিশু ও বৃদ্ধের অনেকেই এর মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছে। শরণার্থীদের মাঝখান দিয়ে হেঁটে গেলে, দেখে দেখে শনাক্ত করা সম্ভব, এক ঘণ্টার মধ্যে কারা মারা যাবে আর কাদের ভোগান্তি চিরতরে শেষ হওয়াটা কেবল কয়েক দিনের ব্যাপার মাত্র।

এই কঠিন ট্র্যাজেডি এখনো পৃথিবী বুঝে উঠতে পারেনি। আমি আপনাদের বলতে পারি, যতক্ষণ-না নিজ চোখে দেখছেন, এর বিশাল ব্যাপ্তি সম্পর্কে ধারণাও করতে পারবেন না। কেবল সেখানে গেলেই সেখানকার অনুভূতিটা আপনি আঁচ করতে পারবেন, মানুষের ভোগান্তি বুঝতে পারবেন, সহিংসতার যে শক্তি শরণার্থীর জন্ম দিচ্ছে এবং বেসামরিক মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়িয়ে যাচ্ছে, তা অনুধাবন করতে পারবেন। ভারতে থাকাকালে পূর্ববাংলার সীমান্তজুড়ে ছড়ানো শরণার্থী এলাকাগুলো আমি ঘুরে দেখেছি; কলকাতা ও পশ্চিম বাংলার পশ্চিমে জলপাইগুড়ি পর্যন্ত, উত্তরে দার্জিলিং জেলা এবং পূর্বে ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা ঘুরে এসেছি।

শিশুদের দিকে দেখুন, তাদের ছোট্ট হাড় থেকে আলগা হয়ে ভাঁজে ভাঁজে ঝুলে পড়া ত্বক, এমনকি তাদের মাথা তোলার শক্তিও নেই। শিশুদের পায়ের দিকে দেখুন, পা ও পায়ের পাতায় পানি নেমে ও অপুষ্টিতে ফুলে আছে। তাদের মায়ের হাতও নিস্তেজ। তাকিয়ে দেখুন, ভিটামিনের অভাবে শিশুরা অন্ধ হয়ে যাচ্ছে কিংবা তাদের এমন ঘা, যা কখনো সেরে যাওয়ার নয়। শিশুদের মা-বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখুন, তাঁদের সন্তান আর কখনো সুস্থ হয়ে উঠবে না, সেই হতাশা তাঁদের চোখে। আর সবচেয়ে বেশি কঠিন দৃশ্যটি দেখুন, গত রাতে যে শিশুটি মারা গেছে, তার মৃতদেহও এখানেই।

শরণার্থী ও এডওয়ার্ড কেনেডি 

ক্যাম্পের পর ক্যাম্পে গল্প একই। এমনিতেই ঠাঁই হয় না, এমন হাসপাতালে অবিরাম বাড়তে থাকা বেসামরিক মৃত্যু পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। এসব ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত মানুষকে তাদেরই সহশরণার্থীরা সীমান্তের ওপার থেকে বয়ে এনেছে। তারপরও সীমান্তবর্তী বহুসংখ্যক ভারতীয় বাড়িঘর পাকিস্তানি সেনাদের গোলার শিকার হয়েছে। এছাড়া অকথিতসংখ্যক আহত মানুষ, যাদের গোনা হয়নি, যাদের দেখাশোনার কেউ নেই, পূর্ববাংলার গ্রামীণ এলাকায় পড়ে আছে। আরো ট্র্যাজিক অভিজ্ঞতা হচ্ছে নিষ্পাপ ও অশিক্ষিত গ্রামবাসীর। কলকাতার উত্তরে বয়রা-বনগাঁও সড়কের ডজনখানেক নতুন শরণার্থীর সাক্ষাৎকার নিয়ে টুকরো টুকরো কাহিনীগুলো একত্র করে দুর্দশার মোজাইক তৈরি করা সম্ভব।

যেদিন আমরা এই ২০ মাইল সড়ক ঘুরি, সেদিন কমপক্ষে সাত হাজার শরণার্থী বয়রার কাছে নদী পেরিয়ে সীমান্তের পাড়ঘেঁষে স্রোতধারার মতো নেমে এসেছে। এদের প্রায় সবাই কৃষক, চাষী-মজুর। অধিকাংশই হিন্দু। ঢাকা জেলার দক্ষিণে খুলনা ও বরিশাল থেকে এসেছে। এসেছে গত শরতের সাইক্লোনে বিধ্বস্ত প্রান্তবর্তী জেলা থেকে।

সাধারণত পায়ে হেঁটে বহু দিন বহু রাতের এই দীর্ঘ পথচলায় শিশু ও বৃদ্ধরা ক্লান্ত। মানসিক আঘাতের সাক্ষ্য দিচ্ছে অনেকের চেহারা, রাস্তার পাশে লক্ষ্যহীনভাবে বসে আছে অথবা অজানা নিয়তির উদ্দেশে লক্ষ্যহীনভাবে হাঁটছে। তারা নৃশংসতার গল্প বলেছে, মানুষ জবাই করার গল্প বলেছে, লুট ও অগ্নিকাণ্ডের কথা বলেছে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে হয়রানি ও লাঞ্ছিত হওয়ার গল্প বলছে। বহু শিশু রাস্তায় মারা যাচ্ছে। তাদের মা-বাবা তাদের বাঁচাতে অনুনয় জানাচ্ছে, ভিক্ষা চাচ্ছে। বর্ষাকালের বৃষ্টি গ্রামের দিকের সবকিছু ভিজিয়ে দিয়েছে। তাদের চেহারায় যোগ হয়েছে আরো বিষণ্ণতা ও হতাশা। সেদিন আমরা যারা বাইরে বের হয়েছিলাম, আমাদের জন্য বৃষ্টি মানে বড়জোর কাপড় বদলের চেয়ে বেশি কিছু নয় কিন্তু এই মানুষগুলোর জন্য বৃষ্টির মানে আরো একটি রাত বিশ্রাম, খাদ্য ও আশ্রয়বিহীন কাটিয়ে দেওয়া। যে শিশুটির কোমর থেকে নিচ পর্যন্ত পক্ষাঘাতগ্রস্ত, আর কখনো হাঁটতে পারবে না, কিংবা যে শিশুটি তার চোখের সামনে মা, বাবা, ভাই ও বোনদের হত্যা করতে দেখেছে, ছোট তাঁবুতে মাদুরে বসে ভয়ে কাঁপছে; আমরা পৌঁছানোর কয়েক মুহূর্ত আগে তার সেই ভাইটির মৃত্যু হয়েছে—এই শিশুদের চেহারা মন থেকে মুছে ফেলা খুব কঠিন কাজ। আমি যখন একজন শরণার্থী শিবিরের পরিচালককে জিজ্ঞেস করলাম, তাঁর সবচেয়ে জরুরি প্রয়োজনটি কী? জবাব এলো, “একটি শব-চুল্লি।” পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ একটি ক্যাম্পের তিনি পরিচালক। নিম্ন ও মধ্য-আয়ের মানুষের আবাসনের জন্য এ জায়গা ঠিক করা হচ্ছিল, এটি এখন এক লাখ ৭০ হাজার শরণার্থীর বাড়ি।

পূর্ববাংলার ট্র্যাজেডি কেবল পাকিস্তানের জন্য ট্র্যাজেডি নয়, এটা কেবল ভারতের জন্য ট্র্যাজেডি নয়, এটা সমগ্র বিশ্বের জন্যই ট্র্যাজেডি।

লা ইউনিটা
নভেম্বর: পাকিস্তানি জনগণের ট্র্যাজেডির প্রতীক শেখ মুজিব [সম্পাদকীয়]


সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী সামরিক নেতৃত্বের হাতে কারাবন্দী শেখ মুজিবুর রহমানের নিয়তি যেন পাকিস্তানি জনগণের ট্র্যাজেডির প্রতীক। পূর্ব পাকিস্তানে জান্ত্যব নির্যাতনের সবচেয়ে বড় বলি তিনি। আতঙ্কিত মানুষের ভারতে পালিয়ে যাওয়া, অবিশ্বাস্য সংখ্যক মানুষের দেশত্যাগ—সবকিছুর পরও রাজনৈতিক সমাধানের প্রথম পদক্ষেপই হতে হবে আওয়ামী লীগের নেতার মুক্তি।

পশ্চিম পাকিস্তানের সামন্ত চরিত্র পূর্ব পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। এটুকু বলাই যথেষ্ট, পূর্ব পাকিস্তানের শ্রমিক ও কৃষকদের অবস্থা গোটা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে করুণ এবং তারা সবচেয়ে পশ্চাৎপদ। ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছে। আর এর জবাবে ইয়াহিয়া খানের কাছে সবচেয়ে সুবিধাজনক মনে হলো আওয়ামী লীগকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যা দিয়ে অভিযুক্ত করা, নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে দেওয়া, দেশের পূর্বাংশের সামরিক আঘাত হানা এবং শেখ মুজিসবহ আওয়ামী লীগের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের গ্রেপ্তার করা।

সত্য ঘটনা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ পাকিস্তান রাষ্ট্রের ঐক্য ও অখণ্ডতা রেখেই স্বায়ত্তশাসনের কর্মসূচির ভিত্তিতেই নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিশ্রুতি ছয় দফা কর্মসূচি হিসেবে পরিচিত।

এ অবস্থায় রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যেসব বড় ধরনের প্রশ্নের সুরাহা স্বায়ত্তশাসন ও ফেডারেল কাঠামোতে এখনো হয়নি, সেসব এড়িয়ে পাকিস্তানে শান্তি ও গণতন্ত্র রক্ষা এবং শক্তিশালী করার কাজটি কেমন করে হবে, তা কে বলবে।

ভারত-সোভিয়েত ২০ বছর মেয়াদি বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার চুক্তির যৌথ স্মারকে যে রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলা হয়েছে তা যথার্থ, প্রয়োজনীয় এবং জরুরি। আর যথাসময়ে তা করতে হলে যেসব রাষ্ট্র ও ব্যক্তি শান্তি ভালোবাসে এবং শান্তি চায়, তাদের অপরিহার্য করণীয় হচ্ছে, আওয়ামী লীগের নেতা ফ্যাসিবাদবিরোধী বীর শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য সোচ্চার হওয়া এবং মুক্তি আদায় করা।

বিবিসি
ডিসেম্বর: ১৬ ডিসেম্বর প্রচারিত সংবাদ


পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ শেষ হয়ে আসছে। রেডিও পাকিস্তান জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি হয়েছে এবং ভারতীয় বাহিনী রাজধানী ঢাকায় প্রবেশ করেছে। পাকিস্তান বলেছে, স্থানীয় ভারতীয় ও পাকিস্তানি কমান্ডারদের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি করা হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধী সংসদে বলেছেন, দু পক্ষের প্রতিনিধি ঢাকায় আত্মসমর্পণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন। পাকিস্তানের পক্ষে এই চুক্তি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ। তিনি বলেন, ভারত আশা করে, পূর্ব পাকিস্তানিদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি পাকিস্তানে আটক রয়েছেন, নিজ দেশের মানুষের মধ্যে তাঁর আসন গ্রহণ করবেন এবং বাংলাদেশকে শান্তির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। মিসেস গান্ধী বলেন, ভারতীয় বাহিনী প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় সেখানে অবস্থান করবে না। তিনি আরো যোগ করেন, লাখ লাখ শরণার্থী ইতিমধ্যেই দেশের পথে পা বাড়িয়েছে।

১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ প্রকাশিত লি লেসাজের প্রতিবেদনটির একাংশ
ঢাকা ১৬ ডিসেম্বর। আজ ভারতীয় বাহিনী যখন ঢাকায় প্রবেশ করল তখন হাজার হাজার বাঙালির কণ্ঠে সানন্দ জয়ধ্বনি: ‘জয় বাংলা’। মেজর জেনারেল গান্ধর্ভ সিং নাগরার কমান্ডের অধীন ভারতীয় সৈন্য ও পূর্ব পাকিস্তানের গেরিলা বাহিনী (অর্থাৎ বাংলাদেশের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা) যখন খুব ভোরে ঢাকার বাইরে একটি সেতু অকেজো করতে আক্রমণ চালাল, তখনই শুনতে পেল এখানকার পাকিস্তানি কমান্ড আত্মসমর্পণ করতে ভারতের দেওয়া শর্ত ও সময়সীমা মেনে নিয়েছে।

বেশ কয়েক ঘণ্টা ঢাকার রাস্তায় সশস্ত্র পাকিস্তানি সৈন্য সংখ্যা ভারতীয় সৈন্যের চেয়ে অনেক বেশি; কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্ত গোলাগুলি হয়েছে। বেশ কজন ভারতীয় ও পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। তাদের মধ্যে একজন ভারতীয় অফিসার নিহত হন ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে।

মুক্তিবাহিনীর সদস্য ও পূর্ব পাকিস্তান লিবারেশন আর্মির লোকজন জনতার সাথে মিশে উৎসবমুখর জনতার অংশ হয়ে গেছে, আকাশে রাইফেলের গুলি ছুঁড়েছে।
পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব জেনারেল নাগরা ৯৫ মাউন্টেইন ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার এইচ এস ক্লেরকে রেড ক্রসের ঘোষিত নিরপেক্ষ অঞ্চল ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে পাঠালেন সেখানে আশ্রয় নেওয়া বিদেশি ও পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক বেসামরিক সরকারের সদস্যদের রক্ষা করতে।

রাস্তা দিয়ে এগোবার সময় ব্রিগেডিয়ার ক্লের-এর গাড়ি বাঙালিরা বারবার ঘিরে ধরে। এক পর্যায়ে তারা গাড়ির ড্রাইভারকে টেনে বের করতে চেষ্টা করলে ক্লের নিজেই গাড়ি থেকে নেমে আসেন। বাঙালিরা তাকে ঘিরে ফেলে। একজন এক গোছা গাদাফুল তাঁর হাতে তুলে দেয়। বাঙালিরা চিৎকার করে তাকে ধন্যবাদ জানায়। নাগরা বললেন, “সারা পথ আনন্দ আর করতালির মধ্য দিয়ে আমাদের আসতে হয়েছে, ময়মনসিংহে উৎফুল্ল জনতা আমার পোষাক থেকে ব্যাজ ও প্যাচ খুলে নিয়ে যায়।”

জ্যাকব বললেন, “আমি আশা করি সবকিছু শান্তিপূর্ণ ও শান্ত। আমরা নিশ্চয়তা দিয়েছি সৈন্য ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের আমরা রক্ষা করব; আমরা মনে করি তা অবশ্যই পালন করব।”

প্রায় ৮ জন বাঙালি জ্যাকবকে অভিনন্দন জানাতে এয়ারপোর্ট গেট থেকে রানওয়ের দিকে ছুটে আসে। একের পর এক তার কাছে এগিয়ে এসে বলতে থাকে, “আমি কি আপনার সাথে করমর্দন করতে পারি?” পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দিকে ইঙ্গিত করে একজন বলল, “গত ৯ মাস এরা আমাদের ইঁদুরের মতো হত্যা করেছে।”

আত্মসমর্পণ ও ভারতীয় সৈন্যের উপস্থিতি হঠাৎ করেই ঘটল। কয়েকটি বিবর্ণ সকাল কেটে যাবার পর মনে হলো আত্মসমর্পণের পরিকল্পনাটি প্রণীত হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে কারণ প্রবল যুদ্ধ এবং নতুন করে বিমান আক্রমণ বোমা বর্ষণ ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ ডেকে আনবে এবং ঢাকায় বহুসংখ্যক মানুষের মৃত্যু ঘটবে।

আত্মসমর্পণের পূর্বমুহূর্তে: নিয়াজি ও অরোরা
পূর্ব পাকিস্তানি সামরিক সদর দফতরে তড়িঘড়ি করে ডাকা এক সভায় মেজর জেনারেল ফরমান আলী খান, যিনি জেনারেল নিয়াজির পক্ষে যুদ্ধবিরতি সমঝোতার চেষ্টা করছেন, তিনি জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের কথা জানান। জাতিসংঘের বেতার ব্যবস্থায় বার্তাটি সকাল ৯টা ২০ মিনিটে দিল্লি পাঠানো হয়। আর দশ মিনিটের মধ্যে পুনরায় বোমাবর্ষণ শুরু হয়ে যাবার কথা। আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের ঘটনা ঘটে বিকাল ৫টায় (ইস্টার্ন স্ট্যান্ডার্ড টাইম সকাল ৬টা) রেসকোর্স ময়দানে চারদিকে আনন্দিত গুলিবর্ষণ ও উল্লসিত চিৎকারের মধ্য দিয়ে।

বাসভর্তি ভারতীয় সৈন্যদের থামিয়ে বাঙালিরা ধন্যবাদ দিচ্ছে, আর ২৫ মার্চের পর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে নির্মম কর্মকাণ্ড চালিয়েছে—তখন থেকে লুকিয়ে রাখা বাংলাদেশের পতাকা বের করে আবার উড়িয়ে দিচ্ছে। [সমাপ্ত]

এ সম্পর্কিত আরও খবর