সারা জীবন একটি কাব্যগ্রন্থ পরিমার্জন করে গেছেন হুইটম্যান

বিশ্বসাহিত্য, শিল্প-সাহিত্য

আহমেদ দীন রুমি, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-08-31 21:29:51

ঊনিশ শতকের দাপুটে আমেরিকান কবিদের পরিচয় করিয়ে দিতে বললে সবার আগে আসবে ওয়াল্ট হুইটম্যানের নাম। অনেক সমালোচকের অবস্থান অবশ্য আরো একধাপ উপরে। তাদের মতে, হুইটম্যান গোটা জাতির ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম কবি। এমন দাবির পেছনে যুক্তি যে নেই, তা না। তার কবিতার বই ‘Leaves of Grass’ পরিণত হয়েছে আমেরিকান সাহিত্যের অপ্রতিদ্বন্দ্বী মাস্টারপিস হিসাবে। কবিতা ছাড়াও সাংবাদিকতা এবং সামরিক হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে কাজ করেছেন হুইটম্যান। জীবনকে দেখেছেন কাছে থেকে। তাই সারা জীবন ধরেই কাব্যগ্রন্থটি পরিমার্জন এবং সংস্কার করেছেন নিজের পরিণত চিন্তার প্রলেপে।

সাময়িক শৈশব

১৮১৯ সালের মে মাসের ৩১ তারিখ জন্মগ্রহণ করেন ওয়াল্ট হুইটম্যান। নিউ ইয়র্কের ৫০ মাইল পূর্বে এক দ্বীপের গ্রামে। আট সন্তানের মধ্যে তার অবস্থান দ্বিতীয়। বাবা ইংরেজ বংশদ্ভূত হলেও মা ছিলেন ডাচ। পরবর্তী জীবনে তিনি নিজের পূর্বপুরুষদের এই দ্বীপের প্রথম দিকের অধিবাসী বলে পরিচয় দিতেন।

ব্রুকলিনের এই বাড়িতেই হুইটম্যানের জন্ম


১৮২২ সাল। হুইটম্যানের বয়স তখন মাত্র দুই বছর পার হচ্ছে। ঠিক সেই সময় পরিবার সরে আসলো ছোট্ট শহর ব্রুকলিনে। তিনি তার পরবর্তী জীবনের প্রায় চল্লিশ বছর এখানেই যাপন করেন। স্কুলজীবন শেষ করে মাত্র এগারো বছর বয়সেই তিনি নিযুক্ত হন কাজে। একটা আইন অফিসের বয় হিসাবে যাত্রা শুরু; তারপর যোগ দেন স্থানীয় সংবাদপত্রের শিক্ষানবীশ প্রিন্টার হিসাবে। পরবর্তী সময়ে স্কুলে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা অর্জন করতেও বাকি থাকেনি।

১৮৩৮ সালে হুইটম্যান সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেন। নিজে নিজেই করতেন বহু কাজ। রিপোর্ট ও ফিচার লেখা থেকে শুরু করে পত্রিকা প্রিন্ট এমনকি ঘোড়ার পিঠে করে তা বিলি করা পর্যন্ত। সেই শতকেরই চল্লিশের দশকে পেশাদার সংবাদিক হিসাবে তার আত্মপ্রকাশ ঘটে। নিউ ইউর্কের পত্রিকা এবং ম্যাগাজিনগুলোতে লিখতে থাকেন নিবন্ধ ও ফিচার।
প্রথম দিকের লেখাসমগ্র

প্রথম দিকে হুইটম্যান ছিলেন গতানুগতিক। প্রচলিত ধারায় শহুরে জীবন ফুটে উঠেছিল তার লেখায়। ১৮৪২ সালে তার ছোট উপন্যাস Franklin Evans লেখা হয় মদপানের ভয়াবহতা নিয়ে। পরবর্তী জীবনে হুইটম্যান উপন্যাসটাকে বাজে বলে পরিত্যাগ করলেও সেই সময়ে ছিল ব্যবসায়িক দিক থেকে সফল।

পরবর্তী জীবনে বইটিকে গুরুত্ব দেননি হুইটম্যান


চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি। হুইটম্যান ‘ব্রুকলিন ডেইলি ইগল’-এর সম্পাদক হিসাবে যোগ দিলেন। কিন্তু নিয়তি সেখানে স্থায়ী হতে দিল না। বরং রাজনৈতিক আদর্শের টানাপোড়েনে বরখাস্ত করা হয় তাকে। বাধ্য হয়ে নিউ অরলিন্সের এক পত্রিকায় কাজ নিলেন। এই সময়টাতে প্রকৃতিকে যেন নতুনভাবে আবিষ্কার করতে থাকেন। খুব সম্ভবত বাড়ি ও ব্রুকলিনের প্রতি টান থেকেই এর যাত্রা শুরু। এই চাকরিটাও ধরে রাখতে পারেননি। টিকে ছিল মাত্র কয়েক মাস। ১৮৫০ সালের গোড়ার দিক। সাংবাদিকের মন হঠাৎ ঘুরে গেল কবিতার দিকে। চারপাশের ব্যস্ত শহরের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নোট করতে শুরু করলেন। তা উঠে এলো কবিতায়।

‘Leaves of Grass’ এবং একটি বিপ্লব

১৮৫৫ সালে হুইটম্যান তার প্রথম সংকলন বের করেন ‘Leaves of Grass’ নামে। অন্যরকম এই বইটায় ১২টি কবিতা ছিল শিরোনামহীন অবস্থায়। বিষয়টা অস্বাভাবিক। তার ওপর সেগুলো এমনভাবে সাজানো; দেখে কবিতার চাইতে প্রবন্ধ বলেই অনুমিত হবে পাঠকের। সে যা-ই হোক, হুইটম্যান একটা লম্বা ভূমিকা লিখে নিজেকে আমেরিকার চারণকবি বলে পরিচয় করিয়ে দিলেন। প্রচ্ছদে নিজেকে উপস্থাপিত করলেন সাদামাটা শ্রমিকের বেশে। সবুজ মলাটে অলঙ্কৃত অবস্থায় লেখা শিরোনাম ‘Leave of Grass’। কোনো এক কারণে প্রচ্ছদে কবির নাম ব্যবহার করেননি।

নেহায়েত এক কবিতার বই না, একে পরিণত করেন শ্রেষ্ঠকর্ম হিসাবে


প্রকৃতপক্ষে হুইটম্যান কবিতাগুলো লেখার সময় কয়েকটি বিষয় দ্বারা তাড়িত ছিলেন। বিশেষ করে নাগরিক জীবন, নিউ ইয়র্ক শহরের ব্যস্ততা ও ভিড়, আধুনিক আবিষ্কারে মানবজীবনের পরিবর্তন এবং সেই সময়ের উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাকে অনুপ্রাণিত করে। হুইটম্যান প্রায়শ চেয়েছিলেন সাধারণের কবি হয়ে উঠতে, যা তার কবিতায় হামেশাই অনুপস্থিত।

কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের পরপরই ভক্তশ্রেণি গড়ে উঠে তার। সাড়া পড়ে যায় নতুন স্বর ও সুরের টের পেয়ে। একটা বই উপহার হিসাবে রালফ্ ওয়ালডো এমারসনকে পাঠানো হয়েছিল। তিনি পাঠ করে অভিভূত হয়ে হুইটম্যানকে পত্র পাঠিয়েছিলেন—“একটা বিশাল জীবনের প্রাক্কালেই তোমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।” খুব সম্ভবত হুইটম্যান ৮০০ কপি ছেপেছিলেন প্রথম সংস্করণে। ঠিক পরের বছরই দ্বিতীয় সংস্করণ বের করতে হলো। এবার তাতে যোগ করা হলো আরো ২০টি কবিতা।

হুইটম্যান তাঁর Leaves of Grass-কে কেবল একটা কবিতার বই হিসাবে দেখেনেনি; দেখেছেন জীবনকর্ম হিসাবে। আর তাই প্রায়ই বইটি পর্যবেক্ষণ, সংশোধন, পরের সংস্করণে নতুন কবিতার সংযুক্তিতে সময় কেটেছে। বইয়ের তৃতীয় সংস্করণ বের হয় বোস্টন পাবলিশিং হাউজ থেকে। হুইটম্যান নিজে বোস্টন গিয়ে তিন মাস থেকে বই প্রস্তুত করলেন ১৮৬০ সালে; যাতে কবিতার বিস্তার গিয়ে পৌঁছাল ৪০০ পৃষ্ঠায়।

গৃহযুদ্ধ এবং হুইটম্যান

১৮৬১ সালে আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ শুরু হলো। হুইটম্যানের ভাই জর্জ যোগ দিলেন নিউ ইয়র্কের পদাতিক বাহিনীতে। ১৮৬২ সালের ডিসেম্বরের দিকে ফ্রেডেরিখসবার্গের যুদ্ধে ভাইয়ের আহত হবার খবরে চলে গেলেন ভার্জিনিয়া। আহতদের অবস্থা, যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি এবং যোদ্ধাদের অবস্থা হুইটম্যানকে প্রভাবিত করে দারুণভাবে। ওয়াশিংটনের সামরিক হাসপাতালে আহতদের চিকিৎসায় স্বেচ্ছাসেবীর কাজ শুরু করে দিলেন। আহত যোদ্ধাদের সাথে তার মেলামেশা এবং ঘোরাঘুরি গৃহযুদ্ধের বহু কবিতার বিষয়বস্তু সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছে। পরবর্তীতে এগুলো সংগ্রহ করে প্রকাশ করা হয় বইয়ের আকারে; নাম Drum-Taps।

ওয়াশিংটন ভ্রমণের সময়েই হুইটম্যান প্রায়ই আব্রাহাম লিংকনকে দেখতে পেতেন। লিংকনের প্রতি তার ছিল অগাধ শ্রদ্ধা। উপস্থিত হয়েছিলেন ১৮৬৫ সালের ৪ মার্চ প্রেসিডেন্টের দ্বিতীয় দফায় অভিষেক অনুষ্ঠানেও। এই অভিষেক নিয়ে হুইটম্যান একটি প্রবন্ধও লেখেন; যা প্রকাশিত হয় নিউ ইয়র্ক টাইমস্-এ সে বছরই মার্চের ১২ তারিখ রবিবারে। ঘটনাটিকে তিনি জাতীয় দুর্যোগের মাঝখানে একটি শুভ সংকেত হিসাবে গণ্য করেছিলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে তার প্রত্যাশা পূরণের সুযোগ না দিয়ে আততায়ীর হাতে মৃত্যুবরণ করেন লিংকন। তাকে নিয়ে তার লেখা বিখ্যাত কবিতা—O Captain, my Captain।

যুদ্ধোত্তর দিনগুলো

কোনোকিছুই থেমে থাকে না। গৃহযুদ্ধেরও সমাপ্তি ঘটল। হুইটম্যানও একটা চাকুরি পেলেন ওয়াশিংটনের সরকারি অফিসে। কাজটা কঠিন ছিল না। কিন্তু তারও সমাপ্তি ঘটল, যখন নতুন সম্পাদক হারল্যান জানতে পারলেন তার অফিসেরই এক কর্মকর্তা ‘Leave of Grass’-এর সেই কবি।

অসুস্থতার সময় পত্রিকায় তাকে ‘গুড গ্রে পোয়েট’ হিসাবে আখ্যা দেওয়া হয়


বন্ধুদের মধ্যস্থতায় হুইটম্যান নতুন চাকুরি পেলেন। এই দফায় বিচার বিভাগের ক্লার্ক হিসাবে। ১৮৭৪ সাল পর্যন্ত সরকারি কাজেই থিতু থাকলেন শারীরিক অসুস্থতায় নিজেই পদত্যাগ করার আগ পর্যন্ত। হারল্যানের সাথে তার সেই টানাপোড়েন ভালোই হয়েছিল পরিণামে। কিছু সমব্যথী পেয়েছিলেন তার পক্ষে। পরবর্তী সংস্করণ যখন Leave of Grass প্রকাশিত হলো; তখন হুইটম্যান ‘America’s good gray poet’ হিসাবে সুপরিচিত।

মৃত্যু এবং তারপর

১৮৭০-এর মধ্যভাগে শারীরিক অসুস্থতার কারণে হুইটম্যান নিউ জার্সিতে চলে এলেন। সেখানেই ১৮৯২ সালের ২৬ মার্চ মৃত্যু হয় তার। বেশ ঘটা করে জাতীয় পত্রিকাগুলো সে খবর প্রকাশ করে। তার লেখা নিয়ে প্রশংসায় উপচে পড়ে বোদ্ধামহল।

হুইটম্যানের সমাধি


বিষয়বস্তু আর রচনার ধরনে হুইটম্যানের কবিতা সাহিত্যে বিপ্লবের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না। পরবর্তীতে অনেক কবিই তার দেখানো পথে হেঁটেছেন। কবিতাকে আবিষ্কার করেছে নতুন করে। এখন অব্দি হুইটম্যান ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসের অনন্য মাইলফলকের নাম। আর Leave of Grass থেকে পাঠ্য করা হয় বিশ্বব্যাপী কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর