ব্যক্তিগত

, শিল্প-সাহিত্য

তুষার আবদুল্লাহ | 2023-08-31 21:37:51

প্রতিবেশিনীর চোখ রাঙানি দেখতে হলো সকালে। রাঙা চোখে তাকিয়ে প্রথমে কী যেন বিড়বিড় করে বললেন। নিজেকেই নিজে কিছু একটা বলেন, তারপর ধমক দেন গলা ছেড়ে। শুধু যে নন্দন চমকে উঠে তা নয়। পুরো মহল্লাই ভড়কে যায়। এ বাড়ি ও বাড়ির জানালা, বারান্দা থেকে বউঝিরা উঁকি দেন। পুরুষরা সামনে এসে দাঁড়ালেও কোনো আওয়াজ করার বল পান না। ভেতরে ঢুকে পড়েন। দুই বাড়ির ঝগড়ায় নাক গলাতে চান না কেউ। তবে পর্দার আড়াল থেকে মজা দেখতে চান সবাই। নন্দন বিছানায় শুয়েই দেখতে পান প্রতিবেশিনী তার দরজার কাছে এসে রৌদ্র মূর্তি নিয়েছেন। আঁচল কোমরে গুঁজে তৈরি রণে ঝাঁপিয়ে পড়তে। নন্দন উঠে বসে। বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে প্রতিবেশিনীর দিকে। কী এমন কাণ্ড হলো যে- সূর্য জাগতে না জাগতেই তিনি তেড়ে আসলেন। নন্দন জানতে চায়, আজ কি ফ্যান জোরে ঘুরছিল? আপনার ঘরে আওয়াজ একটু বেশি গেছে? প্রতিবেশিনী ওর দাঁত মুখ খিঁচিয়ে আরো কটমট করে ওঠেন। নন্দন বলে, জোরে নাক ডাকছিলাম? মনে তো হয় না। যদি ডেকে থাকি তবে মাফ চাইছি। আজ থেকে হালকা ঘুম দেবো। যেন নাক ডাকলে নিজেই টের পাই। প্রতিবেশিনী চিৎকার দিয়ে ওঠেন। নন্দন উঠে দাঁড়ায়, সকাল সকাল এভাবে পাড়া মাতিয়ে কী লাভ বলেন? যদি কিছু বলার থাকে ভেতরে আসেন। ধীরস্থিরভাবে বলেন। ভুল আমার হতেই পারে। তাই বলে এভাবে মহল্লার মানুষের সামনে অপদস্ত করবেন, এটা কি ঠিক হচ্ছে? প্রতিবেশিনী জিভ বের করে নিজের ঠোঁট চেটে নিলেন।  নিচু স্বরে কিছু বলে নিলেন। নন্দন কোনো কথাই বুঝতে পারছে না। প্রতিবেশিনী ঘাড় ঘুরিয়ে বাইরে তাকালেন। নন্দন দেখতে পেল প্রতিবেশিনীর কর্তাও পেছনে এসে হাজির। তাকে দেখে অতটা রাগান্বিত দেখাচ্ছে না। স্থির তিনি। প্রতিবেশিনী কর্তাকে ইশারায় নন্দনকে দেখাচ্ছে। কর্তার নম্র-ভদ্র রূপ দেখে নন্দন বলতে থাকে, দেখুন, আপনাদের হয়তো রাতে ঘুমুতে সমস্যা হয়েছে। আমার ফ্যান ঘড়ঘড় করে ঘুরে অনেক আগে থেকেই। হয়তো আজ একটু বেশি শব্দ করেছে। আমি দুঃখিত। কর্তার চেহারা থেকে মুহূর্ত আগের নম্ররূপ উধাও, আপনাকে কে বলেছে ফ্যানের ঘড়ঘড় আওয়াজে বিরক্ত আমরা? নন্দন নিজেকে সামলে বলে, না, রাতে এটা ছাড়া আর কোন কারণে আপনাদের আমি বিরক্ত করেছি বুঝতে পারছি না। পাশের বাড়ির কুকুর সারারাত ঘেউ ঘেউ করে। আমার তো কুকুরও নেই। আমিও নিজে নিশ্চয়ই ঘেউ ঘেউ করিনি?

প্রতিবেশিনী এবং তার কর্তা নন্দনের ঘরে উঁকিঝুঁকি দিতে থাকেন। তাদের নজর নন্দনকে ডিঙিয়ে অন্দরে চলে যায়। নন্দন  বুঝতে পারে না এই দুইজন ওর ঘরে কী খুঁজছে। এমন কিছু তো হবার কথা নয় যে ঐ বাড়ির কিছু এই বাড়িতে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। ভুলে দেয়ালে শুকোতে দেয়া কাপড়ও উঠিয়ে নিয়ে আসা হয়নি। তাহলে তাদের এমন চোখ তল্লাশির কারণ কী? নন্দন জানতে চায়, আপনাদের বাড়ি থেকে কোনো কিছু কি আমার ঘরে উড়ে এসেছে? দেখুন আমি দেয়াল থেকে কাপড়ও তুলে আনি দেখেশুনে। আপনাদের কোনো কাপড় আসেনি। তবে চাইলে আপনারা দেখতে পারেন। নন্দনের এই কথায় দু্ইজন আরো রেগে যান। হুল্লোড় করে চিৎকার করতে থাকেন। আশপাশের বাড়ির মানুষকেও যেন এনে জড়ো করবেন তারা। কর্তা দুই-একজনকে ডাকলেনও। কিন্তু দেখে মনে হলো সাড়া পেলেন না। প্রতিবেশিনী পাশের বাড়ির বান্ধবীদের ডাকলেন, বান্ধবীরা শুকনো হাসি দিয়ে যার যার ঘরে ঢুকে গেলেন। নন্দন একটু আশ্বস্ত হলো। যাক মহল্লার অন্যরাও এসে বাড়ি মাতিয়ে তুলবে না। নন্দনের বাইরে যাবার তাড়া আছে। তাই দুইজনের আরেকটু কাছে গিয়ে নিচুস্বরে বলল, আমার অপরাধটুকু কি আমি জানতে পারি? মিছে আমাকে চোখ রাঙাচ্ছেন না তো?

নন্দনের কথা শুনে ওকে ঠেলেই কর্তা ঢুকে পড়লেন ওর ঘরে। প্রতিবেশিনী কর্তার পিছু নিলেন। নন্দন অবাক, এ কেমন কাণ্ড! কোনো অভিযোগ বলতে পারছে না। কিন্তু ঘরে এভাবে ঠেলে ঢুকে পড়বেন। পা মাড়িয়ে সকাল সকাল ঝগড়া করার উদ্দেশ্য-বিধেয় আঁচ করা যাচ্ছে না এতক্ষণেও। কর্তা নন্দনের বালিশ উল্টে দেখলেন। তোশক উল্টালেন। প্রতিবেশিনী নন্দনের বুক সেলফেও তল্লাশি চালালেন। বই উল্টে পাল্টে দিলেন। খাবার টেবিলে অভিযান চলল। উকিঁ দিতে বাকি নেই বাথরুম ও রান্নাঘরে। কিছুই খুঁজে না পেয়ে দুইজনই যেন আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। নন্দনের দুইজনকে পুলিশ পুলিশ লাগছে। পুলিশই এমন নির্দয় তল্লাশি চালাতে পারে। প্রতিবেশিনীর তাকানোর ঢঙ তো দারোগার মতোই।

নিজের ঘরকে দেখতে নন্দনের যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া মনে হচ্ছে। মহল্লার রাস্তা যেমন এলোমেলাভাবে খুঁড়াখুঁড়ি করে রাখা হয়, তেমনটাও বলা চলে। অহেতুক এমন করা হলো। নন্দন তার অপরাধ যেমন বুঝে উঠতে পারছে না, যেমন বুঝে উঠতে পারেনি তারা ওর ঘরে কী খুঁজছে? প্রতিবেশিনী এবং তার কর্তা এত সাহসই বা পেলেন কোথা থেকে। এই মহল্লায় তো কারো সঙ্গে নন্দনের তেমন ওঠাবসা নেই। আসা-যাওয়ার পথে শুধু ইশারায় কথা হয়। কেউ ওর ব্যবহারে রুষ্ট হবেন, এমন কিছু নিকট সময়ে ঘটেনি। তারপরও কে যে কোন কারনে দুঃখ পায়! কার মনে কিভাবে তাকালে আঘাত লাগে বলা মুশকিল। নন্দন শুধু কানকথা শুনেছিল ওর ফ্ল্যাট কার নাকি পছন্দ। অনেকদিন ওঁত পেতে আছেন, নন্দন সরে গেলেই তিনি এই ঘরের দখল নেবেন। তাহলে ঐ ব্যক্তিই কি পাঠালেন এই দুইজনকে। তাদের অত্যাচারে সটকে পড়বে নন্দন, এমন নকশা এঁকে বসে আছেন ঐ মানুষটা? নন্দন ওর বারান্দায় লতিয়ে ওঠা মাধবীলতার দিকে তাকিয়েই যেন শপথ নেয়, পুরো মহল্লা হামলে পড়লেও  এই ঘর ছেড়ে ও যাবে না।

পুরো ঘর উল্টেপাল্টে কাঙ্ক্ষিত কিছু না পেয়ে যেন হতাশ দম্পতি। নন্দনকে প্রতিবেশিনী শীতল কণ্ঠে বললেন, আপনার মোবাইল ফোনটি কোথায়? নন্দন অবাক হয়, ওর মোবাইল ফোন দিয়ে এই দম্পতি কী করবেন। জানতে চায়, আমার ফোন দিয়ে  আপনাদের কী দরকার? কারো নম্বর লাগবে? বলেন যদি থাকে দিয়ে দেবো। কর্তার কণ্ঠে কঠোরতা, কারো নম্বর লাগবে না। আপনার মোবাইল সেটটা দরকার। নন্দনের কণ্ঠেও এখন শীতলতা, আমার সেট দিয়ে আপনাদের কী কাজ? প্রতিবেশিনীর কণ্ঠে উষ্ণতা, ওটা সার্চ করে দেখতে হবে। নন্দন অবাক, আমার মোবাইলে সার্চ দেবেন আপনারা? আমার ব্যক্তিগত বিষয়ে আপনারা নাক গলিয়ে দিচ্ছেন জোর করে? আমার ব্যক্তিগত গোপনীয়তায় উঁকি দেওয়ার অধিকার আপনাদের নেই। ওমা, অগ্নিরূপ নিলেন প্রতিবেশিনী, আপনার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা আছে আমাদের নেই? নন্দন মুখে হাসি আনার চেষ্টা করে, অবশ্যই আছে। শতভাগ আছে। কেউ কি উঁকি দিয়েছে আপনাদের সেই গোপনীয়তায়? কর্তা আরো কর্কশ হয়ে ওঠেন, কাল ভোরে আমরা যখন বিদ্যুতের তারে দোল খাচ্ছিলাম। উড়ে গিয়ে করবীর ডালে বসলাম। তখন আপনাকে ছবি তুলতে বলেছিল কে? প্রতিবেশিনী বললেন, সেই ছবি আবার ফেইসবুকে তুলে দিয়ে রাষ্ট্র করবার অধিকার দিলো কে? নন্দন চুপসে যায়। নিজেকে সত্যিই এবার তার অপরাধী মনে হয়। মনে পড়ে কাল বৃষ্টি থেমে আসার পর এই দুইজনকে ঘনিষ্ঠ হতে দেখে লোভ সামলাতে পারেনি। মোবাইলের ক্যামেরায় সেই মুহূর্তটি ধরে ফেলে। নন্দন এখন আর ওদের দিকে তাকাতে পারছে না চোখ তুলে। কিন্তু বুঝতে পারছে ওর বারান্দা ঘেঁষে যাওয়া বিদ্যুতের তারে একটা বড়সড় সমাবেশ হতে চলেছে। টগরগাছের ডালপালা এরই মধ্যেই ওদের দখলে। চারদিক থেকে প্রতিবাদের কর্কশধ্বনি প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। নন্দন মনে করতে পারছে না, কাল মোবাইল ফোনটা কোথায় হারিয়ে এসেছে ও।

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

এ সম্পর্কিত আরও খবর