কিউরেটর

গল্প, শিল্প-সাহিত্য

এনামুল রেজা | 2023-09-01 23:12:43

বিকেলটা নিস্তেজ হয়ে আসছে। রোদের উত্তাপ ও আলো দুটোই ম্রিয়মাণ। বর্ষার দ্বিতীয় মাস অথচ আকাশ পরিষ্কার। ভাসমান সফেদ তুলোর মতো শরৎঘেঁষা মেঘ। চার রাস্তার একটা মোড়ে দাঁড়িয়ে মন খারাপ হলো। ফুলহাতা শার্টের ডান আস্তিনে কপালের ঘাম মুছলাম। একটা খালি রিকশা আসছে সোজাসুজি। সরে দাঁড়ালাম একপাশে।

রাস্তার ওই ধারে একটা দশতলা বিল্ডিংয়ের নিচে ছোট্ট চায়ের দোকান। ঢালু কংক্রিটের সঙ্গে ভারসাম্য রেখে তৈরি সিমেন্টের দু সারি বেঞ্চ। তীব্র চায়ের তৃষ্ণা পেল। গরমে প্রাণ বেরিয়ে যেতে চাইছে কিন্তু চায়ের ঘ্রাণ নাকে এলে কবে আর ঠিক থেকেছে মাথা! বহুক্ষণ ধরেই ঘুরছি পায়ে হেঁটে। রিপনদের বাসাটা কেউ চিনল না। এতজনকে জিজ্ঞেস করলাম। গেটের দু পাশে বড় দুটো নারিকেল গাছওয়ালা একতলা পুরানো বাড়ি, ছাদ ভরে আছে টবে বেড়ে ওঠা অজস্র গাছপালায়। একদম যেন ঝুলন্ত বাগান।

পীরের মহল্লা শহরটির নাম। হবে, আজ থেকে কয়েকশো বছর আগে এখানে আস্তানা গেড়েছিলেন একজন বা বহুজন পীর। লোকজন আসত, মানত করত বটবৃক্ষে সুতো বেঁধে, দরগায় চড়ত শিন্নি। কল্পনা করে নিতে বেশ লাগে। রিপনরা এলাকার পুরনো পরিবারগুলোর একটি। কখনো তাকে বা তার বাবা নঈমুল হক সাহেবকে জিজ্ঞেস করে অমন পীর বিষয়ক জটিলতার কথা শুনিনি অবশ্য। এর আগে এসেছিলাম একবারই। রিপনের বোন তমালিকার বিয়েতে। সাজানো গোছানো এক ছোট্ট শহর মনে হয়েছিল পীরের মহল্লাকে, বাসার ছাদ থেকেই শহরের পাশ ঘেঁষে বয়ে চলা নদীটা দেখা যেত। বেশ প্রশস্ত হলেও শান্ত সমাহিত নদী, ওইপারে গ্রাম।

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মাঝবয়সী লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘নঈম ডাক্তারের বাসাটা কোনদিকে জানেন?’ চাঅলা গরম পানির বলক ওঠা একটা কেতলিতে শুকনো কালো চা পাতা ঢালতে ঢালতে বলল, ‘কোন নঈম ডক্তর?’
ওই যে পীরের বাজারে বড় চেম্বার আছে, বাড়িটা পুরনো ধাঁচের, ছাদ ভরা গাছপালা।
দুইটা বড় নারিকেল গাছ আছে বাড়ির সামনে?
হ্যাঁ হ্যাঁ। একদম। আপনি চেনেন?
জ্বি চিনি। কিন্তু এসবে লাভ নাই।
চাঅলার উত্তরটা বুঝলাম না। কিসে লাভ নেই? দেখলাম অন্যপাশের বেঞ্চে বসা দুজন লোক আগ্রহী দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আমার দিকে। একজনকে বেশ চিনলাম। ওই লোকটিকেই না রিকশা থেকে নেমে জিজ্ঞেস করেছিলাম রিপনদের বাসা কোনদিকে? কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে আবার বললাম, ‘রিপন আর আমি একই অফিসে কাজ করি। এসেছি মায়ানগর থেকে। ঠিক কোন দিক দিয়ে গেলে পৌঁছতে সুবিধা হবে বলবেন?’

আচমকা কাঁধে কেউ হাত রাখলে ঘুরে চাইলাম বাঁ দিকে। কম্পিত মিহি কণ্ঠে রুগ্ন এক বৃদ্ধ কাঁধ থেকে হাতটা না সরিয়েই কথা বলে উঠলেন। ‘নঈম ডাক্তারের বাড়ি খুঁজতাছেন শুনলাম। তা নাম কী আপনের? কুনখান থাইকা আসা হয়?’

বুঝতে বাকি রইল না। ঘণ্টাখানেক ধরে এই সর্পিল অলিগলির ছোট্ট শহরটায় ঘুরে বেড়াচ্ছি রিপনদের বাসার সন্ধানে এবং বেশ রটে গিয়েছে একজন অচেনা লোকের ওধারা অনুসন্ধান। আজকের যুগে বাসাবাড়ির নম্বর ছাড়া কেউ কোথাও যায়? মোবাইল ফোনই বা আছে কেন? তবে সঙ্গে থাকা নম্বরটি যে বন্ধ, বহুবার ডায়াল করেও সংযোগ মেলেনি, কাকে বোঝাব?

দশ বছর একসঙ্গে কাজ করেছি রিপন আর আমি। ঠিক দু সপ্তাহ আগে হুট করেই সে অফিসে আসা বন্ধ করে দিল। একদিন, দুদিন এমনকি তিনদিনকেও অস্বাভাবিক মনে হয়নি। ভেবেছিলাম হয়তো বাড়িতে গিয়েছে জরুরি কাজে। কিন্তু এমন বিনা নোটিশে এতদিনের কামাই অফিস মানবে কেন? শেষে আমিই বাধ্য হয়ে ম্যানেজমেন্টকে অনুরোধ করেছিলাম। রিপনের সঙ্গে পারিবারিক যোগাযোগ আমার, আসছে উইকেন্ডে অন্তত একবার দেখে আসি ওদের বাসায় কোনো ঝামেলা হলো কিনা। এরপর অফিস যা সিদ্ধান্ত নেবে, সেটা নিশ্চিই অবিচার হবে না। এতদিনের অভিজ্ঞ কর্মী, ওর মতো কন্টেন্ট ডেভলপার চাইলেও যে বাজারে হুট করে মিলবে না, ম্যানেজমেন্টের বেশ ধারণা ছিল। উইকেন্ডের দুদিন আর একদিন বাড়তি যোগ করে মায়ানগর থেকে একশো নব্বই মাইল দূরের মফস্বল শহর পীরের মহল্লায় এসেছি আমি। কিন্তু সাত বছর আগের সেই পুরনো ধাঁচের বাড়িটি খুঁজতে এমন হোঁচট খেতে হবে কে জানত? শহরটির ভুতুড়ে পরিবর্তন হয়েছে এই আধা যুগে, না মেনে উপায় নেই।

বৃদ্ধের প্রশ্নের জবাবে কিছু বলবার আগেই আরো কিছু লোক চায়ের দোকানটিতে জড়ো হয়ে গেল। আমি এক আগন্তুক বসে আছি, আমাকে ঘিরে জনা দশেক মানুষ।
‘শেষ কবে এসেছেন এদিকে আপনি?’ প্রশ্নকর্তা আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে, মুখটা দেখা গেল না। তবু উত্তর করলাম, ‘বছর সাতেক আগে। কিন্তু কী বিষয় বলেন তো ভাই?’
চারপাশে একটা মৃদু শোরগোল উঠল। বিষয় আর কী.. শহর কি আর ছোট আছে.. নাকি সেই শহর আছে…
কিন্তু, ওই যে চাঅলা ভাই তো ঠিকই চিনেছিলেন। কী ভাই, চেনেন নাই?
আমার প্রশ্নে চাঅলা হতাশ দৃষ্টিতে দূরে কোথায় চেয়ে রইল। বৃদ্ধ লোকটির কণ্ঠ বেজে উঠল তখন রোদ পড়ে আসা ঘিঞ্জি শহরটির এই কোনে, ‘ও তো সবই চেনে। আপনাকেও চেনে। কী রে চিনিস না?’
চাঅলা বলল, ‘জ্বি। ইনি গল্প লেখেন। এনার স্ত্রীর আটমাসের পেট। কিন্তু এসবে লাভ নাই।’
‘মানে কী?’ অবাক হয়ে প্রশ্নটা নিজেকেই করলাম বিড়বিড় করে। আমি লেখক কিন্তু বিখ্যাত কেউ তো নই। মাসখানেক পর পদ্ম-র ডেলিভারি ডেট, এই তথ্যও নির্ভুল। ওর কথা মনে পড়তেই কীরকম অদৃশ্য ওজন চেপে বসল আমার কাঁধে। ব্যাখ্যা করা যায় না এমন এক আতঙ্ক টের পেলাম। কী করছে পদ্ম এখন? এমন বিকেলগুলো গল্পের বই পড়ে কাটাতেই ও ভালোবাসে। নধর উপান্তের লেখা ওই বইটা কি এখন পড়ছে ও? সেই যে এক লোক অনেক বছর শেষে নিজের গ্রামে ফিরে দেখল পুরো গ্রামটাই ফাঁকা। ঘরবাড়িগুলো জনশূন্য। ঘেসো জমির মাঝখান দিয়ে পায়েহাঁটা পথ। দড়িতে মেলে দেওয়া কাপড় উড়ছে। টিউবওয়েলের নিচে জমে আছে জল। কিন্তু প্রাণের চিহ্ন নেই কোথাও। কিছু আগেই যেন সবাই ছিল। হঠাৎ উধাও হয়েছে। তারপর…

আমরা দুইটা কাম করবার পারি বাবাসাহেব। এক, আপনারে মায়ানগরের ফিরতি গাড়িতে উঠায়া দেওয়া, দুই…’—বৃদ্ধটির মুখে বাবাসাহেব সম্বোধন শুনে কিছুটা ধাতস্ত হওয়া গেল। কমে এলো আতঙ্কের ভার। অজানা জায়গায় অপরিচিত জনগণের কৌতূহলের কারণ হতে কার স্বস্তি লাগবে? আমি আরেক কাপ চায়ের কথা বললাম। ব্যাকপ্যাক থেকে একটা সিগারেট বের করে টংয়ের খুঁটিতে ঝুলন্ত গ্যাসলাইটারে সেটা ধরিয়ে দীর্ঘ একটা টান দিলাম। নিকোটিনের তিতকুটে আর কষটা স্বাদ মুখ হয়ে আমার কণ্ঠের দেয়ালে ঘাঁ মারল। খুশখুশে কাশি উঠে এলো প্রতিক্রিয়ায়।
বৃদ্ধ বললেন, মায়ানগর ফিরত যান আপনি। আমগো এলাকায় নঈম ডক্তর বইলা কেউ থাকে না।
জ্বি। আমি বুঝেছি চাচামিয়া।
বুঝলে তো ভালাই। এখন ছয়টা বাজে। ঠিক রাইত পৌনে নয়টায় এখ্যান ট্রেন নরসিংহ থেকে মায়ানগরে ফেরে। আমগো ইস্টিশন থিকা সেইটায় উঠবার পারবেন। সোজা চইলা যান। উইটিং রুমে বইসা অপেক্ষা নিবার পারেন। চাইলে একটু ঘুমায়াও নিলেন।

মিয়াভাই, আপনার পরিচয় তো খোলাসা হলোনা। নাম কি আপনার? ভিড়ের মাঝখান থেকে সুদর্শন এক যুবক জানতে চাইল হঠাৎ। বয়সে আমার ছোট হবে। এক ধরনের উপহাসই হয়তো খেলা করে উঠল ভিতরে, বিরূপ পরিবেশকে সামাল দেবার মেকানিজম কি বলা যায় ব্যাপারটাকে?
আমার নাম শিপলু। তবে ওই চাঅলা ভাই তো জানেন আমার পরিচয়। তার থেকে সব জেনে নেবেন আমি চলে যাওয়ার পর।
খুব একটা কাজ হয়েছে বলে মনে হলো না। যুবকটি কৌতূহলের সুরে প্রশ্ন ছুড়ল আবার, আপনি লেখেন। সাংবাদিক আপনি, ঠিক ধরেছি?
না রে ভাই।
আপনার ব্যাগে তাহলে কী? ক্যামেরা? আমাদের খুলে দেখাবেন?
কথাবার্তার এই পর্যায়ে বৃদ্ধটি সেই একইরকম কাঁপা কিন্তু মিহি কণ্ঠে ধমক লাগাল। ‘হইছে, থাম তো মুরশিদ। ইনি লোক ভালো, দেইখা বুঝোস না? সত্য কইতাছে।’

কোনো উপায় না দেখে হাত উঁচিয়ে একটা রিকশা ডাকলাম। লোকগুলো আমাকে ঘিরে রাখা বৃত্ত ভেঙে বেরোবার পথ করে দিল। মায়ানগরে ব্লকের পর ব্লক বহুতল দালানের গ্রাস চোখ সওয়া আমার কিন্তু এই ভুতুড়ে শহরটি কীরকম ঘিঞ্জি হয়ে উঠেছে উঁচু উঁচু দালানে, দৃষ্টি বাধা পাচ্ছে প্রতি মুহূর্তেই। ঘিয়ে, ছাইরঙা কিংবা সাদা বাড়িগুলো মাঝখানে সড়ক রেখে দু পাশে সীমানা দেয়াল তুলেছে। অধিকাংশই নতুন। ছোট ছোট জানালা, বারান্দা নেই, কংক্রিটের খাঁচা যেন। কিছু আবার আছে সুপরিসর, ঝুলন্ত বারান্দায় নারী পুরুষ কিংবা শিশু।

এভাবে কে চায় সেধে বিপদে পড়তে? খুব খারাপ কিছু ঘটতে পারে কখনোই ভাবিনি। আগেরবার পীরের মহল্লায় এসে বেশ তো লেগেছিল। তিনদিনের ছুটি রিপনদের বাসায় শুয়ে বসে আড্ডা মেরে কাটিয়ে দেওয়া চলবে, এই ছিল পরিকল্পনা। অনুমান ছিল, মায়ানগর থেকে এভাবে কাউকে না বলে ওর অকস্মাৎ অন্তর্ধানের কারণ বিয়ে। জানি না, হয়তো দীর্ঘদিনের প্রেমিকার সঙ্গে পরিণয় এগিয়ে এসেছিল তার। খুব রিজার্ভ ধরনের মানুষ রিপন। এত বছর একসঙ্গে কাজ করলাম, কত জায়গায় গিয়েছি একসঙ্গে আমরা। অথচ কোনোদিন নিজের একান্ত বিষয়ে মুখ খুলেছে তা হয়নি।

সে তুলনায় রিপনের আব্বা-আম্মাকে মনে হয়েছিল প্রাণখোলা। গাছপালার দারুণ শখ ছিল। তমালিকার বিয়েতে এসে দিন চারেক ছিলাম আমি। বোঝা চলছিল, একদম একলা হয়ে পড়বেন তারা। রিপন শহরে ফিরবে আমার সঙ্গে, তখন এ দুজনের কাটবে হাতছাড়া হওয়া দু সন্তানের স্মৃতিচারণ করে। নিঃসঙ্গতার প্রশ্নেই একদিন নঈম চাচা আমাকে বলেছিলেন, ‘বুঝলে শিপলু, ঘরের চেয়ে শক্তিশালী বন্ধু কিছু আর নেই। দেখো, মানুষ কেমন কাছের মানুষকে ছেড়ে চলে যায়, ঘর কিন্তু কখনো মানুষকে ছাড়ে না। সে আশ্রয়দাতা, সঙ্গী হিসেবেও চমৎকার। এই যে বনে-বাদাড়ে ভর্তি বাড়িটা দেখছো, আমার পরদাদার হাতে তৈরি। এতগুলো প্রজন্ম সে পার করল। এ বাড়ি কথা বলে, তা জানো তো?’ চাচি হেসে উঠেছিলেন, ‘ছেলেটার মাথা খারাপ করা আর কী! বাড়ি কথা বলবে কেন?’

কিন্তু এখন? খোঁজ তো দূর, যেনবা এই এলাকায় রিপন আর ওদের কথাবলা বাড়িটার অস্তিত্বই ছিল না কোনোদিন।

সন্ধ্যা নামল ধীরে ধীরে। দোকানপাটে জ্বলে উঠল লালচে বা শাদাটে বাল্ব। পীরের বাজার ছাড়িয়ে আরো অনেকটা দূরে রেল স্টেশন। রিকশার নিচে বাঁধা হারিকেন ঝাপসা আলো ফেলছে আধো-অন্ধকার পথের শরীরে। দু পাশে দালানগুলো কমে গিয়ে বেড়ে চলেছে গাছপালা আর খানাখন্দের সারি। হঠাৎ করেই যেন বা গিরিপথ ছেড়ে সমভূমির দিকে এগিয়ে চলেছি। আকাশের চেহারা এখন আর পরিষ্কার নয়, বেশ মেঘ জমেছে, বৃষ্টি আসলে বিপদে পড়ব। ছাতা কিংবা রেইনকোট, কোনো কিছু আনবার দরকার মনে করিনি রওনার আগে। অন্য সময় হলে এমন দৃশ্য আর পরিবেশ আমাকে আনন্দ দিত। মায়ানগরে এমন নিরালায় রিকশা ভ্রমণের উপায় তো আর নেই। শব্দে দূষণ, বাতাসে দূষণ, মানুষেও।

সোজা রাস্তাটা ডানে মোড় নিয়ে সম্ভবত স্টেশনের দিকে চলে গেছে। সেদিকটায় দাঁড়িয়ে একটা ছায়ামূর্তি হাত উঁচিয়ে কিছু ইশারা করছে। কাছাকাছি হতে দেখলাম, সেই সুদর্শন যুবকটি, কী নাম যেন? বিষণ্নতায় ভার হয়ে থাকা হৃদয়কেও একটা নিরুত্তাপ কৌতূহল দখল করে নিল মুহূর্তে। রিকশাঅলাকে বললাম, ‘ভাই, একটু সাইড করেন তো একপাশে।’

‘মিয়াভাই, আমাকে চিনেছেন? আমার নাম মুরশিদ। ভয় পেয়ে চম্পট দিচ্ছেন নাকি?’ অন্ধকারেও লোকটার সাদা দাঁত দেখে বোঝা গেল নিঃশব্দে হাসছে। এবার কিছু মুহূর্ত আগের কৌতূহল ছাপিয়ে হৃদয় দখল করল একটা ভয়ানক ক্রোধ।
ফাজলামো করার জায়গা পান না? রাজধানীতে ফিরে আপনাদের ছেড়ে দেব ভেবেছেন?
এই যে মিয়াভাই, রাগ করছেন দেখি। রাগের কিছু নেই। আবার ধরেন, আপনি বন্ধুর সন্ধান ভালোমতো না করেই পালিয়ে যাচ্ছেন…
আমি মোটেই পালিয়ে যাচ্ছি না।
বললেই কি মেনে নেব? কলিগের সন্ধানে এসে তাকে না পেয়ে সঙ্গে সঙ্গেই বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন না?
অনুমতির প্রয়োজন বোধ না করেই রিকশায় উঠে এলো মুরশিদ। আমুদে কণ্ঠে রিকশাঅলাকে বলল, ‘নেন দেখি ভাই। সামনে নেন আবার।’

হেলেদুলে রিকশা চলতে শুরু করল। মোরশেদ ছোটখাট স্বাস্থ্যবান মানুষ। কালো সুতি প্যান্টের ওপর নীল সাদার চেকচেক ফতুয়া পরেছে, অচেনা পারফিউমের সুবাস আসছে তার গা থেকে। ফাঁকে ফাঁকে জরদার ঘ্রাণও। সে যে পান খায় আগে খেয়াল করিনি। কিছুদূর চুপচাপ রিকশা এগিয়ে গেল, কাছাকাছি কোথাও থেমে থেমে ঝিঁঝিঁ ডাকছে। ফতুয়ার বুক পকেট থেকে এক খিলি পান বের করে মুখে পুরল সে।

দেখতেই তো পাচ্ছেন শহরটা বদলে গেছে কীরকম? সাত বছর আগে যেমন দেখেছেন, এতদিন পর আপনার জায়গায় অন্য কেউ হলেও অবাক মানত। একতলা বাড়ি পেয়েছেন একটাও? পাবেন না হাজার খুঁজলেও। সব ছয়তালা সাততালা দালান। নানান এলাকার মানুষে মাছির মতো ভনভন করছে। তবু ছোট শহরের এই সুবিধা। কিছুদিন গেলেই সবাই সবাইকে চিনে ফেলে।
আমার একটা কথার জবাব দেবেন দয়া করে?
কী কথা?
নঈম ডাক্তার বা রিপন নামটা কি সত্যিই এমন অপরিচিত? কী এমন হয়ে গেল এর মাঝে? একবারও আমার মনে হচ্ছে না যে ভুল এলাকায় এসে ওদের সন্ধান করছি।
না মিয়াভাই, অপরিচিত কেন হবে? সব ঘটনা সবার সামনে তো বলাও যায় না।
কী বলব তা ভেবে উঠবার আগেই আমাদের রিকশা থেমে গেল। কিন্তু রেল স্টেশন কোথায়? এদিকটা দেখছি শহরের পরিত্যক্ত অংশ। চারদিকে বাড়িঘর কিছুই নেই। একসময় ছিল তার প্রমাণ হিসেবে অসমতল ভিতগুলো রয়ে গেছে। বাজারটা কেউ গুঁড়িয়ে দেয়নি তবে ম্লান অন্ধকারে ছায়া ছায়া শাটারবিহীন দোকানের সারি, খাওয়ার হোটেলগুলোর সামনে উঁচু মাটির বিশাল চুলোতে ধ্বস নেমেছে। মুরশিদ বলল, ‘ওই পশ্চিমে সোজা হেঁটে যান, বাজারটা পার হলেই রাস্তার পাশে দেখবেন দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটা। ওইটাই খুঁজছেন আপনি। এগিয়ে যান।’

যুবকটির কথাবার্তা বোধের অগম্য হয়ে উঠেছে। তবু কিছু বলার চেয়ে মনে হলো নেমে যাই রিকশা থেকে। ব্যাকপ্যাকটা কোলের ওপর থেকে কাঁধে চড়িয়ে পশ্চিমে অস্থির পায়ে হাঁটা ধরলাম। ওই তো, নঈম ডাক্তারের বাড়ি ছাড়া ওটা আর কী?

হ্যাঁ, অবিকল সেই বাড়ি। গেটের দু পাশে নারিকেল গাছ দুটির মাথা বাতাসে নৃত্যরত। কিছু আগের গুমোটভাব কেটে গেছে। বাসার ছাদে এক ছোটখাটো মিনিয়েচার অরণ্যের মতো তৈরি হয়েছে টবে লাগানো গাছে, সেখানে জমাট বেঁধে আছে অন্ধকার। কিন্তু মানুষ কোথায়? আলো জ্বলছে না যে ভিতরে? কয়েকবার রিপনের নাম ধরে ডাকলাম। কোনো সাড়া এলো না। গেট পেরিয়ে ছোট্ট একটা উঠোনের মতো ছিল, এখন ঠিক উঠোনের কোন দিকটায় দাঁড়িয়ে আছি ঠাহর করা যাচ্ছে না। আঁধার বাড়ছে প্রতি মুহূর্তেই।

‘পেলেন কাউকে?’ মুরশিদের প্রশ্নে চমকে উঠলাম। নিঃশব্দে কখন পাশে দাঁড়িয়েছে।
না, কেউ তো সাড়া দিল না।
কেউ থাকলে নিশ্চয়ই দিত।
দেখেন ভাই, আপনাদের শহরে ঢুকবার পর থেকে কোনো কিছুই আমার মাথায় ঢুকছে না। খুলে বলবেন প্লিজ?
প্লিজের কিছু নেই আসলে। মাথায় ঢুকবে সব, ধীরে ধীরে।
মানে?
একটু আগেই আপনাকে জিজ্ঞেস করলাম না? আবার করি, গোটা পীরের মহল্লায় একতলা বাড়ি দেখেছেন কোনো?
ভুল বলছে না মুরশিদ। বারবার যে মনে হচ্ছিল শহরটা আগের মতো নেই, এই কি সেই বদলের কারণ?
কী ভাবেন? দেখেন নি তো? এখন এই যে নঈম ডক্তরদের ভিটায় দাঁড়িয়ে আছেন, গোটা শহরে এই একটাই বাড়ি যেটা একতলা। শহরের সমস্ত লোকজন ধীরে ধীরে ছেড়ে দিচ্ছিল তাদের পুরনো নিবাস। বহুতল ভবনের সংখ্যা যেমন বাড়ছিল শহরের নতুন অংশে, এর পক্ষে জনমতও। এমনকি যাদের অর্থ নেই, তারাও চাইছিল উঁচুতে উঠতে। দেখছেন না, শহরের এই দিকটা কীরকম পরিত্যক্ত হয়ে আছে? এ মহল্লাটা ধীরে ধীরে সমান করে দিয়েছে নগরভবনের বুলডোজার এসে। শুধু ওনারাই ছিলেন সবকিছুর বিপক্ষে। আপনার কলিগ আর তার বাবা-মা। এ বাড়িটা তাই রয়ে গেল। অবিকল। কেউ একটা টোকা পর্যন্ত দেয় নাই কোনো দেয়ালে।
বাড়ি রয়ে গেল। কিন্তু ওরা কোথায়? কী করেছেন আপনারা তাদের সঙ্গে?

আমরা একটা বিপ্লব শুরু করেছিলাম। সেই বিপ্লবের প্রথম প্রতিপক্ষ ছিল নঈম ডক্তরের পরিবার। সবাই এই পুরনো দিকটা ছেড়ে গেলেও তারা মাটি কামড়ে পড়ে রইল। একঘরে হয়ে গেলেও, দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আর তাদের অবিবাহিত পুত্র, মেয়েটার বসবাস তো বিদেশেই ছিল বিয়ের পর থেকে। তাদের আর বিশেষ প্রয়োজন কী সমাজের কাছে? কিন্তু আপনি তো অস্বীকার করবেন না যে, সমাজের সিদ্ধান্তে যারা নেই, সমাজে থাকবার কোনো দরকারও তাদের নেই।
নেই মানে? ওরা কোথায় এখন? আপনারা এই সামান্য কারণে তিনজন মানুষকে ভিটেছাড়া করেছেন?

নাহ। আমরা কি ছোট লোক? ঠিক এক সপ্তাহ আগে টাউন হলে সভা হয়েছিল। ভোটাভুটি। পীরের মহল্লা হবে দেশের প্রথম বহুতল শহর। আমরা সেইটা থেকে মাত্র একধাপ দূরে ছিলাম। নগরপিতা বললেন, ‘নঈম ডক্তর যদি এখনো তার সিদ্ধান্ত থেকে না সরে আসে, তবে ভিন্ন উপায় আমাদের সামনে নেই। একজন মানুষ আমাদের বৃহৎ লক্ষ্যের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াবে তা হতে দেব না আমরা।’ পুলিশ কমিশনারের দিকে চেয়ে নগরপিতা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তাই কি দেওয়া উচিত?’ উঠতি বয়সের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক তরুণী তখন বলেছিল, ‘এমন ডিসিশান পুরো শহরটাকে বিপদের মুখে ফেলতে পারে। কেস-কামারি হবে, পত্রিকায় সংবাদ হবে, নানান আশঙ্কা। তার জবাবে নগরপিতা উত্তর দিয়েছিলেন, আহা, সে কী চমৎকার উত্তর, ‘এত বড় একটা বিপ্লব হতে যাচ্ছে, আর লোকে জানবে না? দরকার পড়লে লোকে আন্দোলন করবে দিন রাত। পায়ে হেঁটে লং মার্চে যাবে মায়ানগর অভিমুখে। অনশন চলবে সংসদের সামনে। একটা ব্রাইট ফিউচারের জন্য এমন সংগ্রাম কি নগরবাসি করবে না?’

অন্ধকার গাঢ় হবার আগেই আকাশ জুড়ে অজস্র নক্ষত্র ফুটে গেল। সেই নক্ষত্রের আলোর নিচে দাঁড়িয়ে মনে হলো, যে পৃথিবীতে আমি আছি এখন, একে ঠিক চিনি না। মুরশিদ আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘চলেন, আপনাকে ইস্টিশন পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।’
পায়ে হেঁটে পরিত্যক্ত বাজারটা পেরিয়ে এলাম। যেখানে রিকশাটা ছিল, অবিকল দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু রিকশাঅলা নেই। কী করব ভেবে পেলাম না কয়েক মুহূর্ত। মায়ানগর ফিরে কী বলব ম্যানেজমেন্টকে?

আমার চিন্তার সুতো কাটল অজস্র মানুষের পায়ের শব্দ। একদল লোক যেন মিছিল করে এদিকেই আসছে এগিয়ে। প্রায় সবার হাতে চার্জার লাইট। মিছিলের সামনের দিকে সেই বৃদ্ধটি। পাশে রুগ্ন আর অস্বাভাবিক লম্বা এক লোক। সাদা পাঞ্জাবী-পাজামা পরে থাকায় যাকে দীর্ঘ এক মৃতদেহ বলে ভ্রম হলো এক মুহূর্তের জন্য।

মিছিলটি আমার খুব কাছে এসেই থেমে গেল। যতজনের চোখের দিকে তাকাবার সুযোগ হলো, তাদের দৃষ্টিতে একধরনের চেপে রাখা বেদনা। বৃদ্ধটি অনুযোগ করে বললেন, ‘কাজটা তুই ঠিক করোস নাই রে মুরশিদ। বাবাসাহেবরে ইস্টিশনে পাঠায়া দিলেই ভালো করতি।’

বৃদ্ধের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অস্বাভাবিক দীর্ঘাঙ্গ লোকটিই কি নগরপিতা? শোনা যায় না প্রায় এমন খসখসে কণ্ঠে সে বলল, ‘আপনিই শিপলু? রিপনের বন্ধু?’
জ্বি।
শুনলাম রাজধানীতে ফেরত যাচ্ছেন?
হ্যাঁ যাচ্ছি।
কেমন দেখলেন আমাদের শহর?

কিছু বলবার মতো শব্দ খুঁজে পেলাম না আর। এলোমেলো হাওয়া দিচ্ছে। কোন এক অফুরন্ত ক্লান্তির ভাণ্ডার থেকে যেন পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে ঘুমের আরক। অবসন্ন হয়ে উঠল মন ও শরীর। লোকগুলোর হাতে চার্জার জ্বলছে। মেঘ ডাকছে আকাশে। হালকা বৃষ্টি ঝরতে শুরু করল। আম্মা এর নাম দিয়েছিলেন সুঁইসুঁই বৃষ্টি। কিছুক্ষণের এক অসহ্য নীরবতা শেষে লোকটা বলল, ‘মায়ানগর আর ফেরা হবে না আপনার। বহুতল বিপ্লবের একটা স্থায়ী স্মৃতিচিহ্ন রাখবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা। একটা স্মৃতির বাগান। তার দেখাশোনা করতে যোগ্য লোকও তো চাই আমাদের।’
‘মানে?’
নগরপিতার সেই অপরিবর্তনীয় খসখসে কণ্ঠ ঘোষণা করলো, ‘নঈম ডক্তরের বাড়িটাকে আমরা জাদুঘর হিসেবে সংরক্ষণ করব। আপনি হবেন এই জাদুঘরের কিউরেটর।

এ সম্পর্কিত আরও খবর