ইতিহাসের গল্পে সত্যের নির্যাস

, শিল্প-সাহিত্য

তাহমিদ হাসান | 2023-09-01 16:23:56

ইতিহাস আসলে এক প্রকারের গল্পই। তবে তা সাহিত্যের কল্পনাপ্রসূত গল্প থেকে আলাদা। কারণ, ইতিহাসের গল্পের শরীরে মিশ্রিত রয়েছে সত্যের নির্যাস। ইতিহাসের গবেষণা কাঠামোর ভেতর থেকে সাধারণ পাঠকদের জন্য মূল গল্পের চুম্বক অংশটুকু তুলে এনে উপস্থাপন করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম তাঁর 'গল্প কথায় ইতিহাস' গ্রন্থে।

..........

বইয়ের নাম: গল্প কথায় ইতিহাস

লেখক: ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম

ধরন: ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিষয়ক

পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১৯১ টি

...........

কঠিন ইতিহাসকে সহজবোধ্যভাবে জানার জন্য খুব কম সংখ্যক বইয়ের তালিকার মধ্যে এটি অন্যতম। লেখকের উপস্থাপনা মুগ্ধ করার মতো, যা এক কথায় অসাধারণ উপস্থাপনা। লেখক ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম পাবনা জেলার সাঁথিয়া উপজেলার সোনাতলা গ্রামে ১৯৬৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ হতে স্নাতক সম্মান, স্নাতকোত্তর এবং একই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ থেকে এম ফিল  ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৯৫ সালে  চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ২০১৬-২০২০ সাল  পর্যন্ত পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো- ভাইস চ্যান্সেলর পদে নিয়োজিত ছিলেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে বাংলার সংবাদপত্রের ইতিহাস, সংবাদপত্র ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়, আমাদের বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ- জাপান সম্পর্ক উল্লেখযোগ্য।

করোনাকালে ২০২২ সালে অমর একুশে বইমেলায় তাঁর প্রকাশিত 'গল্প কথায় ইতিহাস' বইটি পাঠকদের মনে জায়গা করে নেয় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণে। বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে ইতিহাস চর্চার বিষয়টি নিতান্তই কম। 'গল্প কথায় ইতিহাস' বইটিতে লেখক সহজ ও সাবলীনভাবে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো পাঠকদের উদ্দ্যেশ্যে তুলে ধরেছেন। বইটির মধ্যে বিরক্তি ও দুর্বোধ্যতা পরিহার করে লেখক ইতিহাস বিমুখী পাঠকদের জন্য উপহার দিয়েছেন তাঁর অসাধারণ কৃতি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখছিলেন, " সহজ কথা কইতে আময় কহ যে/সহজ কথা যায় না বলা সহজে।"

সহজ কথা হয়তো সত্যিই উপস্থাপন করা যায় না, তাই সহজে কোনো কিছু আমাদের তুলে ধরা কঠিন হয়ে যায়। বিষয়ের বাইরে গিয়ে একেবারে নতুন কিছু তৈরি করা বা গড়ে তোলা মোটেও সহজ কাজ নয়। কিন্তু 'গল্প কথায় ইতিহাস' বইয়ে লেখক ইতিহাসের মতো কঠিন জ্ঞানচর্চাকে সহজেই উপস্থাপন করেছেন। লেখক যেন তাঁর অসাধারণ কৃতির মাধ্যমে রবি ঠাকুরের এই দুই লাইন মিথ্যে প্রমাণিত করেছে।

রুজভেল্ট বলেছিলেন, "যে ব্যক্তি ইতিহাস সম্পর্কে যত বেশি জানে, সে ভবিষ্যতের জন্য তত বেশি প্রস্তুত।" একজন ইতিহাস বিভাগের ছাত্র হিসেবে আমাকে নির্ভর করতে হয় ইতিহাস সমৃদ্ধ বইগুলোর উপর। সেই বইগুলো পড়ার পাশাপাশি প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান সমৃদ্ধ স্থানগুলো ভ্রমণের কথা থাকলেও  বিভিন্ন জটিলতার কারণে তা আর হয়ে উঠে না। তাই একজন ছাত্র হিসেবে গতানুগতিক বই পড়ে নাম, সাল, স্থান রসকষহীন ভাবেই মনে রাখতে হয়।

কিন্তু চট্টগ্রাম বিশ্বিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম স্যার ধরাবাধা নিয়মকে ভেঙ্গে দিয়ে নতুন কিছু তৈরি করার চেষ্টা করেছেন। গল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন চরিত্র সৃষ্টি করে ইতিহাসের কঠিন বিষয়গুলোকে খুব সহজে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। ইতিহাস বিমুখী কোনো পাঠক যদি 'গল্প কথায় ইতিহাস' বইটি পাঠ করে তাহলে তাঁর বিরক্তিবোধ তৈরি না হয়ে নতুন কিছু জানার আগ্রহ জন্মাবে।

'গল্প কথায় ইতিহাস' বইটি বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান যেমন- মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর, বরেন্দ্র অঞ্চলসহ মোঘল সম্রাটদের কাহিনী, রবী ঠাকুরের জমিদারি, পর্তুগীজদের ইতিহাস, সাতচল্লিশের দেশভাগ নিয়ে ২২ টি ভাগে সজ্জিত

লেখক দাদু ও নাতি এই দুই চরিত্রের মাধ্যমে কিভাবে যুগের হিসাব করা হয় সেটি উল্লেখ করেছে। অতীত যুগগুলোকে তুষার যুগ, ধাতুর যুগ, লোহার যুগ বলে সময়টাকে নির্ধারণ করা হয়, সেটি চরিত্র দুইটির কথোপকথনের  মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। আবার এই চরিত্রের মধ্য দিয়ে ইতিহাস জানার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান মুদ্রা সম্পর্কে গল্প দিয়ে পাঠকদের জানার পথকে সহজ করে তুলেছেন।

লেখক ভ্রমণকাহিনীর মতো গল্প দিয়ে বইয়ের তৃতীয় অধ্যায় থেকে সপ্তম অধ্যায়ের মধ্যে পুন্ড্রনগরীতে একদিন, প্রাচীন পুন্ড্রনগরী ও মহাস্থানগড়, প্রত্ন নিদর্শন গোকুল মেধ, ইতিহাসের গল্পে করতোয়া নদী, পাহাড়পুরের গল্প, বরেন্দ্রভূমির দেশে, বাদল স্তম্ভলিপি শিরোনামে ইতিহাস-ঘেরা স্থানগুলোর সকল তথ্য গল্প ও কথোপকথনের আকারে সাবলীলভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। যা অন্যান্য ইতিহাস বই থেকে মুখস্ত করা ছাড়া বুঝার উপায় থাকে না। কিন্তু লেখক তাঁর বইয়ে ফুটন্ত ইতিহাস যেন পাঠকদের উপহার দিয়েছে। বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠা পড়ার সাথে সাথে পাঠকের পরবর্তী পৃষ্ঠার ইতিহাস পড়ার জন্য প্রবল আগ্রহ তৈরি হয়।

এদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলোর পাশাপাশি লেখক ওপারে অর্থাৎ ভারতবর্ষের প্রথম মহিলা শাসক সুলতানা রাজিয়ার সমাধিতে বেড়াতে যাওয়ার মাধ্যমে দিল্লির সুলতানী আমলের তাৎকালীন শাসনব্যবস্থা ও সিংহাসন আরোহণ নিয়ে দ্বন্দ্বের বিষয় উল্লেখ করেছেন। দিল্লির সুলতান ইলতুতমিশের চার সন্তানের মধ্যে তিন জন ছেলে ও একজন মেয়ে ছিলেন। সকল সন্তানের মধ্যে পিতা ইলতুতমিশের পর তাঁর কন্যা সুলতানা রাজিয়াকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। এই সিংহাসন আরোহণের ইতিহাস ও সুলতানা রাজিয়ার সমাধির করুণ ও বেহাল দশাগুলো লেখক 'গল্প কথায় ইতিহাস' বইটিতে ফুটিয়ে তুলেছেন।

বইয়ের এগারো থেকে তেরো অধ্যায়ে লেখক বাবর,  হুমায়ুন,  মোঘলদের প্রশাসন সম্পর্কে পাঠকদের জ্ঞানচর্চার বিষয়টি সহজ করে তুলেছেন। বাবর কিভাবে ভারত জয় করলেন, হুমায়ুন কিভাবে শেরখানের কাছ থেকে হারানো রাজ্য ফিরে পেলেন এবং মোঘলদের রাজ্য পরিচালনার যে প্রশাসন কাঠামো, তা সুন্দরভাবে বইটিতে ফুটিয়ে তুলেছেন।

'গল্প কথায় ইতিহাস' বইটিতে লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত শিলাইদহ,  শাহাজাদপুর ও পতিসরের গল্প তুলে ধরে পাঠকের মনে দোলা দিয়েছেন। একজন রবীন্দ্রপ্রেমী পাঠক এই বইটি পড়ে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তাঁর জ্ঞানকে প্রসারিত করতে পারবেন।

সতেরো থেকে একুশ অধ্যায়ে আত্রাইয়ের গান্ধি আশ্রম, বাংলায় পর্তুগিজদের ইতিহাস, বাড়ির কাছে আরশি নগর,  পঞ্চাশ টাকার নোটের বাঘা শাহী মসজিদ,  ঢাকাই মসলিনের কদর ছিল দুনিয়া জুড়ে, এইসব বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। লেখক গান্ধি আশ্রম ভ্রমণের সময় উত্তর বাংলার বন্যা দুর্গত এলাকায় তাৎকালীন রাজনেতাদের সহযোগিতা ও বন্যা পরবর্তীতে চরকার মাধ্যমে বিদেশি নির্ভরতা ত্যাগ করে স্বনির্ভর হবার প্রচেষ্টার দিকগুলোও উপস্থাপন করেছেন। পর্তুগিজদের ইতিহাস নিয়ে লেখক ভারত উপমহাদেশে পর্তুগিজদের আগমন ও ভারতীয় সংস্কৃতিতে পর্তুগিজদের জীবন ব্যবস্থার মিশ্রণ যেভাবে শুরু হয়, তার সুন্দর চিত্র তুলে ধরেছেন। সুলতানি আমলের স্থাপনা, সুফি সাধক, দরবেশ এবং ঢাকার হারিয়ে যাওয়া মসলিন কাপড়ের গৌরবের দিকটা পাঠকদের মাঝে তুলে ধরেছেন তিনি চমৎকারভাবে।

বইটির শেষ অধ্যায়ে লেখক ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ কর্তৃক ভারত-পাকিস্তান দুইটি নতুন দেশ তৈরির মধ্য দিয়ে ভারত ভাগের সময় বাস্তুচ্যুত মানুষের সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরেন। এই অধ্যায়ে দেশভাগ নিয়ে বিভিন্ন গুণীব্যক্তির অভিজ্ঞতার পাশাপাশি লেখক ও কবিদের উপন্যাস, কবিতার কথাও আলোচনা করা হয়েছে।

বইটি পড়ে আমার বিন্দুমাত্র অনাগ্রহ তৈরি হয়নি। একজন লেখক বই প্রকাশ করার সময় চেষ্টা করেন যেন পাঠক খুব সাচ্ছন্দ্যে বইটি উপভোগ করতে পারেন। লেখক চাইলেই বইয়ের মধ্যে থাকা ছবিগুলো রঙিন করে ছাপাতে পারতেন। এতে করে শুধু ইতিহাসের শিক্ষার্থী নয়, স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরাও উপকৃত হতো।

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর