ধারাবাহিক উপন্যাস ‘রংধনু’-৫

, শিল্প-সাহিত্য

মাহফুজ পারভেজ | 2023-08-31 06:38:59

 

[পঞ্চম কিস্তি]

ম্যারির হাত থেকে ক্যাভিনের পাণ্ডুলিপি নেওয়ার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনা কর্তা উইলিয়াম জন নিজের আনন্দ আড়াল করতে পারলেন না। “তার মতো একজন মেধাবী লেখকের বই প্রকাশ করতে পারা আমাদের জন্য সম্মান ও মর্যাদার বিষয়। তোমার যদি সুযোগ হয়, তাহলে আমাদের পক্ষ থেকে তাকে ধন্যবাদ দিও।”

ম্যারি ভদ্রতার হাসিতে মাথা নাড়েন। কাজ শেষে তিনি চলে আসার কথা বলতেই উইলিয়াম রে রে করে উঠেন। “লেখককে তো আর পাচ্ছি না। লেখকের প্রতিনিধিকে অন্তত এক কাপ কফি অফার করা প্রকাশন হিসাবে আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।” কোনো কথা না বলে ম্যারি এবার বেশ শব্দ করে হেসে ফেলেন। চট করে উইলিয়াম নিজে গিয়ে কফি বানিয়ে ডেস্কে ফিরে এলেন।

করিৎকর্মা প্রকাশক কফির কাপে চুমুক দেওয়ার আগেই পাণ্ডুলিপির পাতা উল্টাতে শুরু করেছেন। তার চোখ ঝলমল করছে উচ্ছ্বাসে। তিনি কফির কথা যেন ভুলেই গেলেন। কয়েক মিনিট বাদে বিস্ময়াভিভূত দৃষ্টিতে পাণ্ডুলিপি থেকে মুখ তুললেন তিনি। ততক্ষণে ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া কফিটুকু এক চুমুকে পান করে তিনি শুধু বললেন, ‘ওয়ান্ডারফুল’।

পাণ্ডুলিপিটি ম্যারি পড়েন নি। ফলে এর চমৎকারিত্ব সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল নন। চলে আসার অপেক্ষায় তিনি চুপ করে বসে আছেন। আর তখনই ম্যারিকে চমকে দিয়ে উইলিয়াম অকল্পনীয় একটি প্রস্তাব দিলেন,

‘তোমাকে একটা অনুরোধ করছি, তুমি না করতে পারবে না।’

‘কি অনুরোধ?’

ম্যারির কণ্ঠে বিস্ময়। কিন্তু উইলিয়ামের গলা নির্বিকার,

‘এই পাণ্ডুলিপি তোমাকে সম্পাদনা করতে হবে?’

‘আমি?’

আঁতকে উঠেন ম্যারি। উইলিয়ামের কথাগুলো তিনি ঠিক বুঝতে পারেন না।

“তুমি জানো, আমরা প্রতিটি পাণ্ডুলিপি একজন রিভিউয়ার কাম সম্পাদককে দিয়ে পড়িয়ে তারপর বই আকারে প্রকাশ করি। একজন লেখক যত সতর্কই হোন, মানুষ হিসাবে ছোট-খাট ভুলের ঊর্ধে থাকেন না। সম্পাদক সেগুলো দেখেন। আর সম্পাদক হন তিনিই, যিনি লেখক সম্পর্কে ও তার লেখা সম্পর্কে ভালোভাবে ওয়াকিবহাল। ক্যাভিনের জীবন ও সৃষ্টিকর্মের ক্ষেত্রে তোমার চেয়ে যোগ্য আর কেউ আছে বলে আমি মনে করি না।”  

ম্যারিকে আর কোনো কথা বলতে না দিয়ে উইলিয়াম একটি চুক্তিপত্রের কপি এনে তাতে ম্যারির স্বাক্ষর নিলেন। ম্যারি জানেন, সম্পাদনার কাজটি অ্যাকাডেমিক সার্কেলে অত্যন্ত মর্যাদার। আর্থিক সম্মানীর টাকাটাও বেশ মোটা অঙ্কের। এসব মাথায় এলেও তিনি ভাবলেন আরেকটি বিষয়। উইলিয়ামকে যদি সম্পাদনার বিষয়টি না করা হয়, তাহলে নিজেকে ও ক্যাভিনকে ছোট করা হবে। ম্যারির অসম্মতি জানানোকে অনেকেই ভুল বুঝতে পারেন। ভাবতে পারেন, ছাড়াছাড়ি হয়েছে বলে ক্যাভিনের বইটি সম্পাদনা করতে রাজি হয়নি ম্যারি। অতএব, কথা না বাড়িয়ে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করে ম্যারি চলে আসেন। আসার আগে পাণ্ডুলিপির ফটোকপি ম্যারির হাতে ধরিয়ে দেন উইলিয়াম।

লাইব্রেরিতে এসে মিসেস ন্যান্সির সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন ম্যারি। তিনি অত্যন্ত খুশি হলেন। নিজে বইয়ের তাক থেকে সম্পাদনা ও রিভিউ সংক্রান্ত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বই বেছে এনে ম্যারিকে পড়ার জন্য দিয়ে বলেন, 

“শোন, সুযোগ সব সময় আসে না। কাজটিকে তুমি প্রফেশনালি গ্রহণ করবে। আমি চাই তোমার ক্যারিয়ারের আরেকটি এভিনিউ ওপেন হোক। এডিটর ও রিভিউয়ার হিসাবে গ্রহণযোগ্য কাজ দেখাতে পারলে তোমার পেশাগত জীবনের দিগন্ত আরো প্রসারিত হবে।”

ম্যারি ভেবে দেখেন, উইলিয়াম বা ন্যান্সি উভয়ের তার শুভার্থী। তারা ম্যারিকে একটি প্রোডাক্টিভ কাজের দিশা দিচ্ছেন। ম্যারি নিজেও বিচ্ছিন্নতা ও নিঃসঙ্গতার প্রকোষ্ঠ থেকে বের হতে কাজে মগ্ন থাকাটাকেই একমাত্র মুক্তির পথ বলে বিশ্বাস করেন। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, ক্যাভিনের পাণ্ডুলিপি সম্পাদনার কাজকে তিনি গভীর মনোযোগ, পরিপূর্ণ পেশাদারিত্ব এবং সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েই সম্পন্ন করবেন।

পাণ্ডলিপি নিয়ে কাজ শুরুর আগে ক্যাভিনের প্রকাশিত বইগুলো নিয়ে বসেন ম্যারি। বইগুলো অনেকবার পড়েছেন তিনি। কোনো কোনো বই বা অধ্যায়ের প্রথম পাঠকও তিনি। বাগানের পাইন গাছের নিচে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্যাভিন তার লেখা পড়ে শুনিয়েছে। তিনি মুগ্ধ হয়ে শুনেছেন। এবার তিনি সম্পাদকের নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিতে ক্যাভিনের বইয়ের পাতা উল্টালেন। হাতে নিলেন নোটবই। উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো টুকে রাখবেন তিনি।

ক্যাভিনের বইগুলো দিন সাতেক একটানা রিভিউ করে ম্যারি কয়েকটি পয়েন্ট লিখে নিলেন। মোটে চারটি বই লিখেছে ক্যাভিন। কিন্তু প্রতিটি বই-ই গভীর গবেষণা, পর্যবেক্ষণ ও পড়াশোনার ফসল। ক্যাভিন তার বই লেখার কাজকে বলতো ‘প্রজেক্ট’। কোনো বিষয় নিয়ে লেখার আগে প্রচুর পড়াশোনা করতো ক্যাভিন। তারপর সরেজমিনে সেসব বিষয়ে জানতে বেশ কয়েক দিনের জন্য চলে যেতো সাবজেক্টের কাছে। বইগুলোতে তারপর তাত্ত্বিক ও ফলিত বিষয়ে চমৎকার সংশ্লেষ ঘটাতো ক্যাভিন। এ রকম একজন সিরিয়াস লেখকের বই পড়ার লোকও কম। বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের লোকজনই মূলত তার বইয়ের পাঠক।

ম্যারি যতদূর সম্ভব ক্যাভিনের লেখার স্টাইল, বিশ্লেষণের পদ্ধতি, যুক্তির ধরণ ইত্যাদি নোট করলেন। ম্যারি জানেন, ক্যাভিন বহু বছর ধরে ভ্রাম্যমাণ। স্থায়ী অফিস বা লাইব্রেরি ওয়ার্ক করার সুযোগ কমই পেয়েছে বেচারা। ফলে তথ্য বা বিবরণের কিছু কমতি ও অসঙ্গতি থাকা স্বাভাবিক। ম্যারি সম্পাদক হিসেবে এসব অসম্পূর্ণতার দিকগুলো খেয়ার করার উপর গুরুত্ব দিলেন এবং ক্যাভিনের এই বইটিও যেন আগের বইগুলোর মতো মানসম্পন্ন হয়, সেটা নিশ্চিত করতে উদ্যোগী হলেন।

ক্যাভিন এবারের বইটি লিখেছে রুশ দেশ নিয়ে। প্রধানত রুশীয় সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোককথার মাধ্যমে রাশিয়ার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গতিশীলতার প্রবণতাগুলো খুঁজে বের করাই ক্যাভিনের উদ্দেশ্য। বইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো বর্তমান রাশিয়ার সঙ্গে অধুনা-লুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের তুলনা করা। ম্যারি লাইব্রেরি থেকে রাশিয়া সংক্রান্ত একগাদা বই সংগ্রহ করলেন। প্রয়োজনে ক্রসচেক বা কোনো তথ্য সংযুক্ত করার ইচ্ছা আছে তার। তিনি সর্বান্তকরণে প্রত্যাশা করেন, ক্যাভিনের বইটি নির্ভুল ও সমৃদ্ধ আকারে প্রকাশিত হয়ে পাঠকের হাতে পৌঁছাক।             

পাণ্ডুলিপি হাতে পাওয়ার এক মাস পর ম্যারি সম্পাদনার কাজে হাত দিলেন। প্রকাশনা কর্তা উইলিয়াম আগেই জানিয়ে দিয়েছেন যে, দুই মাসের মধ্যে পাণ্ডুলিপি চূড়ান্ত করে দিতে হবে। ততদিনে আর্টিস্ট প্রচ্ছদ তৈরি করবেন। তারপর কম্পোজ, টাইপসেটিং, লেআউট, মেকাপ, করে সর্বমোট চার মাসের মাথায় বইটি তিনি প্রকাশ করতে চান। মাঝে একদিন তিনি ম্যারিকে ফোনে জানান যে, ক্যাভিনের বইয়ের প্রিঅর্ডার বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে এবং তাতে বেশ সারা পাওয়া যাচ্ছে।

ম্যারি ঠিক করেছেন, সারা দিন তিনি লাইব্রেরির কাজ ও ক্যাভিনের বইটির জন্য রাশিয়া সম্পর্কে প্রয়োজনীয় পড়াশোনা করবেন। তারপর বিকেলে বাসায় ফিরে সন্ধ্যার পর থেকে কয়েক ঘণ্টা বইটির সম্পাদনার কাজগুলো করবেন। ম্যারি তার মাকে ভীষণ অবাক করে দিয়ে বাগানে পাইন গাছের নিচে একটি অস্থায়ী আস্তানা তৈরি করলেন। ছোট্ট টি টেবিল ও চেয়ার সাজালেন সেখানে। টেবিলে রাখলেন একটি টেবিল ল্যাম্প, টিপট ও পানির বোতল। সঙ্গে কিছু কাগজ ও লেখা সংশোধনের জন্য বিভিন্ন রঙের কলম।

এসব উদ্যোগের সময় ম্যারির মনে একটি সন্দেহ দোলা দিয়েছে। এতোসব আয়োজন তিনি করছেন কাকে ভালোবেসে? সম্পাদনার কাজকে? নাকি ক্যাভিনকে? উত্তরহীন প্রশ্নের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নিয়েই গভীর মমতায় ম্যারি পাণ্ডুলিপির পাতায় নজর দিলেন। এতোদিন শুধু পাণ্ডুলিপির প্রচ্ছদটি দেখেছেন তিনি। মূল লেখার প্রথম লাইন পড়ে ম্যারি বিদ্যুৎপৃষ্ট হলেন যেন। ক্যাভিন লিখেছেন,

“রুশ দেশে অনেক লেখক। প্রতিটি লেখকের কল্পনায় তৈরি হয়েছে অনেক নায়িকা। আমার বাস্তব নায়িকা ম্যারি,  যে থাকে মার্কিন মুলুকে। রুশ দেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাসে আমি আমার নায়িকা ম্যারিকে খুঁজবো।”

এই প্রথম ম্যারি টের পেলেন, কখনো কখনো একটি মাত্র লাইন কোনো মানুষকে আমুণ্ডু নাড়িয়ে দিতে পারে।

[পরবর্তী কিস্তি আগামী শুক্রবার]

আরো পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস ‘রংধনু’-৪

এ সম্পর্কিত আরও খবর