জয়নব আরা বেগমের কবিতায় মনস্বিতা

, শিল্প-সাহিত্য

মমতাজ উদ্দিন আহমদ | 2023-08-31 11:45:41

 

জয়নব আরা বেগম (২৭ ডিসেম্বর ১৯৭৮) বাংলা কবিতার রথে উঠে আসা একটি নাম। পেশায় শিক্ষক হলেও লিখনিতে সিদ্ধহস্ত অর্জন করছেন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। তাঁর কবিতায় ধরা পড়েছে প্রনষ্ট সময়ের অভিঘাতের বিষন্নতা। আবার কখনোবা প্রকাশ ঘটে নস্টালজিয়া, কখনো অন্তর্বিহীন মৌন-নিস্তব্ধতা, মানবীয় ভালোবাসার অন্তর্লীনতা এবং নির্মোহ সম্পর্কের গভীর আকাঙ্ক্ষার পূর্ণ প্রকাশ।

জয়নব আরা বেগমের কবিতায় রয়েছে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য। কবিতাগুলো অনুরাগী পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। অনতিদীর্ঘ, অনলস, তেজস্বী ও মনস্বী অনুশীলনের চাপ লক্ষ্যণীয় তাঁর কবিতায়। প্রচলিত আধুনিক কবিতার ধারায় রচিত হয়েছে তাঁর কাব্যের শরীর। এতে রয়েছে গভীর রসবোধ, সমাজচিন্তন, নারী-পুরুষের চিরকালীন প্রেম-বিরহ ও উদার-নৈতিকতার সুসমন্বয়। কবিতাগুলোতে রয়েছে বিদগ্ধ আত্মমগ্নতা। আবার কখনো বা ইহজাগতিক ভাবনার সাথে পরলৌকিকতার সংমিশ্রণ।

সাহিত্যের নানান শাখার তুলনায় বোদ্ধা মহলে কবিতার আলোচনাই সর্বাধিক। কবিতা অনন্ত শক্তির উৎসধারাও বটে। তাই কবিতার সংজ্ঞা পুরোপুরি দেয়া কঠিন। কবিতার কল্পনার সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা কী কবিও দিতে পারেন কিনা তা পাঠকমাত্রই সন্দিহান থাকেন। জয়নব আরা বেগমের আধুমিক কবিতাগুলো পড়লে মনে লাগে সুর-ছন্দের তীব্র আকস্মিক শব্দতীর, পৌঁছে যায় অন্তরেরও ভেতর!

‘কবিতা অনন্ত শক্তির উৎসধারা’। সে ভাবনা থেকে বলা যায়, জয়নব আরা বেগমের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘সমর্পিত শব্দাবলী’ ও ‘আঁধার ক্ষেতে বুনেছি ভোরের বীজ’ এর কবিতাগুলোয় রয়েছে নিজস্ব একটি গতিধারা। আছে ভাবের প্রাচুর্য। তাঁর প্রতিটি কবিতায় যে তৃষ্ণাবোধ রয়েছে তা দৃশ্যমান বাস্তবতা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। কবিতায় রয়েছে দৃশ্যমান বাস্তবতা থেকে ভিন্ন দৃশ্য তৈরীর সক্ষমতা।

কবি অসাধারণ সব শব্দের বুননে তৈরী করেন নিজের ক্ষুরধার লিখনীতে কবিতামালা। সাধারণ কল্পনার উর্ধ্বে উঠে কবিতায় তিনি নিজস্ব কল্পনায় শিল্পবুনেন। কবি মূহূর্তের অভিজ্ঞতা থেকে চলে যান সুদূরে। মাঝে মাঝে কল্পলোকের সিংহধারে পৌঁছে বেদনার বেদীমুলে অনর্থক শাপবর্ষণ করেন প্রিয়জনের উদ্দেশ্যে। সেখানে থাকে না বাস্তবতার কোন সীমারেখাও! সেখানে শুধুই কল্পলোকের ঘরবসতি!

বসন্তের নিদাঘ-শোভা আমাদের শরীর-মনকে জাগিয়ে তোলে। সে অনুভূতি যৌবনের। কবিতায়ও বসন্তের দৃশ্য ও বাতাসের ঝড়োগতি ও আত্মজাগরণ নিয়ে আসতে পারেন কবিরা। যেমন- আমাদের জাতীয় কবির ‘বিদ্রোহী’ কবিতা একটি আত্মজাগরণের কবিতা। সুদৃঢ় আত্মবিশ্বাসের জয়গান ‘বিদ্রোহী’ কবিতার চরণে চরণে সুস্পষ্টরূপে দেদীপ্যমান। এ কবিতায় ১২১ বার ‘আমি’ শব্দ ব্যবহার করে কবি প্রতীয়মান করেছেন মানুষ অসম শক্তির অধিকারী!

কবি মূলতঃ অনন্ত কল্পনা শক্তি দিয়ে শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে ছন্দ-মাত্রায় কবিতা বুনেন। এটি অত্যন্ত দূরহ কাজ বটে। জয়নব আরা বেগম তাঁর কবিতায় সাম্য, সত্য-সততা, প্রেম-অনুরাগ, ক্ষোভ, চাওয়া-পাওয়া, আশাহত জীবনের ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধতা এবং সমাজের মিল-অমিল বিষয়গুলোকে ফুটিয়ে তুলেছেন নিজ মনের আয়নার ফ্র্রেমে।

কবিতায় মনের ভাবপ্রকাশের অবদান বিশ্ববিশ্রুত। কবির কবিতা শরীর-মনের চারদিকে অনুভূতি জাগিয়ে দিতে সক্ষম। সে অনুভূতি যৌবনের, সে অনুভূতি পাওয়া-না পাওয়ার বেদনাকাব্য। পল্লী মানুষের জীবন নির্ভর আধুনিক কবিতায় সিদ্ধহস্ত কবি জয়নব আরা বেগম।

ছোট্ট পরিসরে কবিতার সংজ্ঞা দেওয়া কঠিন। কবিতার শক্তির উৎসধারার নাগাল খুব কম মানুষই পান। কবিতার রূপ-আকৃতি-প্রকৃতি একেক জনের কাছে একেকভাবে ধরা দেয়। তাই প্রত্যেক কবির আলাদা আলাদা ভাবের জগতের সাথে আমরা পরিচিত। মৌলিক কবির ভাবের জগৎ সর্বদাই আলাদা। যেমন গত শতকে রবীন্দ্র বলয়ে প্রদক্ষিণ করেও নজরুল তাঁর স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেই হয়েছেন কালজয়ী।

কবিতা কি! কী তার পরিচয়? তার সহজ বর্ণনা পাই কবি আল মাহমুদের ‘কবিতা এখন’ কবিতাটি পাঠে। কবিতাটির শেষাংশটি এমন-

‘কবিতা চরের পাখি, কুড়ানো হাঁসের ডিম, গন্ধভরা ঘাস

ম্লান মুখ বউটির দড়ি ছেঁড়া হারানো বাছুর

গোপন চিঠির প্যাডে নীল খামে সাজানো অক্ষর

কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার।’

কবিতা এক-একজনের কাছে ধরা দিয়েছে ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতি দিয়ে। কবিতার সহজ বর্ণনায় যেভাবে ‘মক্তবের চুলখোলা আয়েশা আক্তার’ এর বর্ণনা উঠে আসে তেমনি আমরা দেখতে পাই জটিল-কঠিন বর্ণনার পক্তিমালাও। যাঁর মাথামু-ু সাধারণ পাঠকের বোধগম্যতাই বাইরে। এদিক দিয়ে কবি জয়নবের কবিতাগুলোর শব্দগাঁথুনি বেশ সাবলিল ও ঝরঝরে।

কবি জয়নব আরা বেগমের কাব্যগ্রন্থ ‘সমর্পিত শব্দাবলী’র কবিতা ‘শব্দের তাঁতী’তে কবিতার রূপ ধরা পড়েছে এভাবে-

‘সোনার সুতোয় রূপোর গিট মেরে

বুনন করি রেশমী কবিতা।

অজানার অতৃপ্তি ঘুচাতে

নিজেকে পিপাসার্ত করে তৃষ্ণা নিবারণের জন্য

গণ্ডুষ ভরে পান করি

সাহিত্য-সংস্কৃতির রস।

তারপর নিজের মত কলম ঘুরাই

কখনো স্বপ্নে হারাই।’

তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘আঁধার ক্ষেতে বুনেছি ভোরের বীজ’ এর ২৫-২৬ পৃষ্ঠার একটি কবিতার নাম ‘কবিতা’। এ কবিতাটির শেষাংশে ‘কবিতা’র পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে এভাবে-

‘বোমার আগুনে ধ্বংস ও বিরান হয়ে যাওয়া

দগ্ধ প্রান্তরে

নতুন আশ্বাসের বাণী শোনায়।

জীবনের সঞ্চিনী বাড়ায়-

বিমর্ষ তালিকার নাম মুছে দিয়ে।

সে অন্য কেউ নয়- ‘কবিতা’।’ (চম্বুক অংশ: কবিতা, আঁধার ক্ষেতে বুনেছি ভোরের বীজ)।

তাঁর কবিতায় মাঝে মাঝে ধরা পড়ে শিল্পিত ভাবনার স্বাধীন প্রকাশ। কবির বিরহী ভাবনা, কবিতার ঝাঁঝালো ভাষা আর পঙতি যেন এক একটি বুলেট। এতে ধরা পড়ে তাঁর অন্তরের প্রবল শক্তি। যে শক্তি জ্ঞানগম্মিদের ধারণারও উর্ধ্বে। কবি তাঁর ‘অশ্রুপ্লাবন’ কবিতায় লিখেন-

‘বিশ্বাসের একাগ্রতায় আমার বুকে

তোমার প্রেমকে ধারণ করে

প্রাণের মধ্যে খুঁজেছি প্রাণের বাঁধন।’ 

তখন পাঠকমাত্রেই হৃদয়ের অলিন্দে খুঁজে পান কবির প্রেমারাধানার সাধনা আর ভাবনার সীমারেখা। একইসাথে খুঁজে পান কবির ব্যথিত হৃদয়ের প্রকাশের ব্যাপ্তির গভীরতা। আবার যখন দেখি-

‘পাষাণে পরান বেঁধে,

ম্লান বেশে সজল নয়নে

নিজের বোবা দৃষ্টির শূন্য চাহনি

আজ আমাকে করছে ক্ষত-বিক্ষত’।

                                (‘অশ্রপ্লাবন’ : সমর্পিত শব্দাবলী)

এখানে পাঠকমাত্রই কবির হৃদয়ে বেদনার অনুরণন দেখে ব্যথিত হন। যখন কবি বলেন, ‘বেদনার শতদল হয়ে ফুটে আছি যন্ত্রণা দিঘীর মাঝখানে‘ তখন পাঠকের হৃদয়ে কবির যন্ত্রণা দিঘীতে শাপলা ফুটানোর আকুলতা সৃষ্টি করে। কবি পাঠকের মনকে আকাঙ্খিত করে তোলেন কষ্টের দিঘীতে শাপলা ফোটানোর। কবি যখন লেখেন-

‘অকারণে শুধু আজ মনে বাজে বেদনার তান,

বুকে বাজে হাহাকার করতালি-

অশ্রুপ্লাবনে হাবুডুবু খাই বেদনার উপকূলে’।

                                (‘অশ্রুপ্লাবন’ : সমর্পিত শব্দাবলী)

কবি এখানে নিজেই স্বীকার করেছেন ‘অকারণে আজ মনে বাজে বেদনার তান’। এখানে কবির কল্পনা ধরা পড়ে। কবির দুঃখের কারণে যোগ হয়েছে অকারণ ভাবনা-কল্পনা। কবির এ বিরহের মধ্যে বাস্তব অনুষঙ্গ নেই। আছে শুধু প্রিয়জনের প্রতি অকারণ দ্বেষ আর অনুচিত শাপবর্ষণ। কবির বিরহ এখানে শুধুই কল্পনাপ্রসুত। যাতে বাস্তবতার সংশ্লেষ নেই।

কবি জয়নব আরা বেগমের কাব্যগ্রন্থ ‘সমর্পিত শব্দাবলী’ এবং ‘আঁধার ক্ষেতে বুনেছি ভোরের বীজ’ এর ১০৩ টি কবিতার মধ্যে অনেকগুলো কবিতাই বেশ উঁচুমর্গের বলে মনে হয়। সাহিত্য সমালোচকের পাশাপাশি বিশ্বসাহিত্যের বিভিন্ন বিখ্যাত কবিও কবিতাকে দেখেছেন বিভিন্ন রূপে। সেদিক দিয়ে তাঁর কবিতার মূল অনুষঙ্গ কি তা সময়ই বলে দেবে একদিন।

কবিতাই কবির মননের পরিচয় বহন করে। দু’টি কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোয় পরিবেশ-প্রকৃতি, প্রেম, সমাজ-সভ্যতা, সুখ-দুঃখ, প্রতিবাদ, ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধতা-মৌনতা, রাগ-অনুরাগ, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের নানান প্রসঙ্গ ফুটে উঠেছে শব্দ-তরঙ্গে।

নারী প্রেমিকা; নারী কবিতার শক্তির উৎস। কবিতার অন্যতম উপজীব্যও বটে নারী। যেমনিভাবে নারী কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম লিখেন-

‘নারীর বিরহে, নারীর মিলনে, নর পেল কবি-প্রাণ,

যত কথা তার হইল কবিতা, শব্দ হইল গান।

নর দিল ক্ষুধা, নারী দিল সুধা, সুধায় ক্ষুধায় মিলে’

জন্ম লভিছে মহামানবের মহাশিশু তিলে তিলে!’

কিন্তু নারীই যখন হয়ে উঠেন কবি তখনও প্রাধান্য পায় এমন কাউকে ঘিরে। যা তার মানসসঙ্গী! কবি জয়নব আরা বেগম লিখলেন,

‘হৃদয়ের সোনালী কুঞ্চন ভেঙ্গে

নক্ষত্র হয়ে এসেছিলে তুমি

কোন এক বুধবার সন্ধ্যায়।

স্নায়ুর ভেতর টগবগ করেছিলো রক্তরস।

স্বাদে-গন্ধে সিক্ত হয়েছিলাম,

নিমফুলের স্নিগ্ধ গন্ধের মতো

একটা গন্ধ আমাকে মাতিয়ে রেখেছিলো;

ধুকপুক হৃদয়ে অনুভব করেছিলাম

এক রহস্যময় ভালোলাগা।

(প্রথম স্পর্শ : সমর্পিত শব্দাবলী)

তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘আঁধার ক্ষেতে বুনেছি ভোরর বীজ’ এর কবিতা ‘অস্তিত্বের রেণু’তে কবি লিখলেন-

‘যদি কখনো তোমার প্রত্যাখানের কৃষ্ণবলয়

আমাকে এসে গ্রাস করে,

তবে সেই দিন যেন পৃথিবীর

অন্তিম দিন হয় আমার।

আমার যাত্রা-পথের দিন-রাত্রির

উত্থান-পতনে তুমি রোমাঞ্চ পুলক।

তোমার ভালোবাসার রহস্য সৃজনের পঞ্চভূত

আমার বুকের তপস্যা।’

এ কবিতাগ্রন্থ দু’টির কবিতাগুলোয় প্রেম-পরিবেশ-প্রকৃতি ধরা পড়েছে বেশ আধুনিক কবিতার পঙ্তিমালায়। পাঠককে দোলা দেয় কবিতাগুলো। পাশাপাশি তাঁর কবিতায় শিল্প-প্রকরণ, আদর্শ-চেতনা, চিন্তা প্রভৃতির গভীরতা অনেকখানি গভীর। কবিতায় তার অন্তর্নিহিত শক্তি ও বলিষ্ঠতা এবং ইচ্ছাশক্তির প্রচ-তা কবিতার শব্দের ভারী ওজন প্রভৃতি গুণ আমরা ভবিষ্যতেও লক্ষ্য করবো বলে আশা করি। এছাড়া ভাষার-বৈচিত্র্য এবং নিজস্বতায় আলাদা সুর সৃষ্টি হোক তাঁর কবিতায় এ প্রত্যাশা।

মানুষ ঐতিহ্য অনুসন্ধানে এবং দেশপ্রেমে আগ্রহী। ঐতিহ্যসন্ধান মানেই তার অস্তিত্ব অনুসন্ধান করা। দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ। সমাজের চারপাশকে ঘিরে গড়ে ওঠে সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতির সঙ্গে মানুষের জীবনাচরণ। কবি তাঁর চারপাশ থেকে কবিতার উপকরণ সংগ্রহ করেন। প্রকাশ করেন নিজস্ব ভঙ্গিতে। ‘স্বদেশ’ কবিতায় কবি জয়নব আরা বেগম লিখলেন-

‘বটের ডালে কালো কোকিল

ডাকছে কুহুতানে,

তারই সুরে মন ভরে যায়

স্বপ্ন জাগে প্রাণে-

এমনি সুখের স্বপ্ন পারে

ভাসছি সুখের তারে।’

দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে অন্তবির্হিন মৌননিস্তব্ধ সৌন্দর্যের দিগন্ত বিস্তৃত গ্রন্থিল পাহাড়ি জনপদ বান্দরবান। এই অপরূপ বান্দরবান জেলাকে নিয়ে কবি জয়নব আরা বেগম লিখেছেন ১০০ লাইনের ৫০০ শব্দের দীর্ঘ একটি কবিতা। কবিতাটি শুরু এবং শেষের পঙ্তিগুলো এই-

‘পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে সবুজের মেলা,

তারি সাথে মেঘ খেলে লুকোচুরি খেলা।

ঝর্ণা-পাহাড়-নদী আর সবুজ বন,

অপরূপ রূপ দেখে হারায় এ মন।

---

পাহাড়ি-বাঙ্গালী সম্প্রীতি অটুট এখানে

ছুটে আসে সব সুখ তাই এই পানে।

জন্মেছি এইখানে কী চাই আর,

আমার জেলা ‘বান্দরবান’ আমার অহংকার।’

(বান্দরবান : আঁধার ক্ষেতে বুনেছি ভোরের বীজ)।

কবি জয়নব আরা বেগম লোকজ-উপাদানে শৈল্পিক করে সাজিয়েছেন তার কবিতার অবয়ব। মা, বাবা, গন্তব্য, প্রথম স্পর্শ, সুঁই সুতো, বেদনার শব্দ, নালিশ, মিনতি, হৃদমাঝার, বাজখাই অধিকার, বিশ্বাসের ঝুলি, অনন্ত তৃপ্তি, স্বর্গীয় পুলক, স্বপ্নস্নান, অনন্ত সুখ, জৈব বিষ, আমি মুক্তি চাই, সোনালী সূর্য, ধিক্কার ধ্বনী, শব্দের তাঁতী, হিরক রাজা, মন পদ্মের ঢেউ, তোমাকে ভালোবাসি বলে, ভীনগ্রহবাসী, সলজ্জ আস্তানা, বান্দরবান, চন্দ্রালোকের সিঁড়ি, আগামীর প্রত্যাশা , অথৈ যমুনা, যন্ত্রণার ঐশ্বর্য্য, স্বদেশ, সর্বগ্রাসী, নারী, বিশ্বাস, দৈবধন, ভালোবাসা ও ঘৃণা, নিন্দাবাদের বৃন্দাবন, হে অমানিশা, অস্তিত্বের রেণু, সুপ্রিয়’ ইত্যাদি কবিতায় ব্যবহৃত হয়েছে স্মৃতিকথার উপাদান। কয়েকটি নস্টালজিক কবিতা পড়লে পাঠক ফিরে যাবেন অতীতে।

কবি জয়নব আরা বেগমের কবিতায় ইসলামী মিথ এবং পুরাণের ব্যবহার তেমন লক্ষ্যণীয় নয়। বাঙ্গালী মুসলিম কবিদের মাঝে যাঁরা তাঁদের কবিতায় ইসলামী মিথের ব্যবহার করেছেন তারা বাঙ্গালী মুসলিম মনে স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। তদ্রুপভাবে কবিতায় পুরানের ব্যবহারও বাঙ্গালী মানসকে সমানভাবে আকর্ষণ করে। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে কবি আল মাহমুদ তাঁর কবিতায় এ দু’টি মিথ এর দারুণ সমন্বয় করেছেন। ফলে তার অনেক কবিতাই মানুষের বোধ-বিশ্বাস, অস্তি-মজ্জার কথা বলে বিধায় কবিতাগুলো নিত্য প্রাসঙ্গিক।

পাশাপাশি কবিতায় ইংরেজি, আরবি, উর্দু-ফারসি, প্রাচীন সংস্কৃত ও সাধু ভাষার শব্দের জুঁতসই ব্যবহার করলে কবিতাগুলো আরো সুখপাঠ্য হয়ে উঠবে বলে মনে করি। তাঁর কবিতায় উঠে আসুক প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দুঃখ-বেদনা, হাসি-কান্না, অনুভব-অনুভূতির শৈল্পিক বুনন। লোকজ শব্দ, ঐহিত্য চেতনা, ধর্মাশ্রয়ী কবিতা সৃষ্টির মাধ্যমে তাঁর কাব্যের দুয়ার আরো খোলে অপূর্ব সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হোক! ‘সমর্পিত শব্দাবলী’ কবির প্রথম দিকের কবিতার সমারোহের গ্রন্থিত রূপ।

কবি জয়নব আরা বেগম পেশায় একজন শিক্ষক। ১৯ বছরের শিক্ষকতা জীবনে তাঁর রয়েছে অনেক অর্জন। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের একসেস টু ইনফরমেশন পরিচালিত ‘শিক্ষক বাতায়নে’ একজন সক্রিয় ও সেরা শিক্ষক। ২০১৪ সালে শিক্ষামন্ত্রী থেকে সেরা শিক্ষক এ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। তাঁর তৈরি মাল্টিমিডিয়া মডেল কন্টেন্টগুলো দেশের মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরূমে পাঠোপযোগী। মাল্টিমিডিয়া কন্টেন্ট প্রতিযোগিতা ২০১৭-এ এটুআই কর্তৃক তিনি দেশসেরা শিক্ষক নির্বাচিত হন। বান্দরবান জেলায় একাধিকবার তিনি শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হওয়ায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক তাঁকে স্টাডি ট্যুরে মালয়েশিয়া সফরে পাঠানো হয়।

গ্লোবাল লার্নিং এর উপর উচ্চতর অভিজ্ঞতার জন্য ২০১৫ সালে তিনি লন্ডন সফর করেন। তাঁর এ সফরের ব্যয়ভার বহন করে সরকার ও ব্রিটিশ কাউন্সিল। লন্ডনের স্কটস প্রাইমারি স্কুলে তিনি অতিথি শিক্ষক ছিলেন। ইউকে ভিজিটকালে লন্ডনের হেভারিং এর মেয়র ব্রায়ান ইগলিং তাঁর কাজে সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে রানীর পোষাক পরিয়ে সম্মাননা এবং এ্যাওয়ার্ড প্রদান করেন। এছাড়াও কবি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পেয়েছেন একাধিক সম্মাননা।

একটি সভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জয়নব আরা বেগমের জন্ম ও বেড়ে উঠা। পৈত্রিক বাড়ি কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার পূর্ব কাকারা গ্রামে। বাবা জয়নাল আবেদীন একজন ব্যবসায়ী। মাতা হোছনে আরা বেগম গৃহিনী। চাকুরিসূত্রে তিনি বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দা।

লেখক: মমতাজ উদ্দিন আহমদ, সভাপতি, আলীকদম প্রেসক্লাব, বান্দরবান

এ সম্পর্কিত আরও খবর