কুমিল্লা থেকে ডুয়ার্স: বিস্মৃতপ্রায় ডুয়ার্স গান্ধীর গল্প

প্রবন্ধ, শিল্প-সাহিত্য

ড. রূপ কুমার বর্মণ | 2023-08-30 23:56:05

উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের প্রথমার্ধে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির বিরুদ্ধে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মুক্তিসংগ্রাম আধুনিক বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক বহুচর্চিত বিষয়। স্বাভাবিকভাবেই ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা-আন্দোলণের বহুকৌণিক বিশ্লেষণের পাশাপাশি সমান্তরাল ধারা হিসাবে সৃষ্টি হয়েছে রাজনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত প্রধান নেতৃবর্গকে “আইকন” বানানোর প্রয়াস। এর অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ বিশ শতকের ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের জাতীয় ইতিহাসে “ব্যক্তির ভূমিকা” শ্রেণিকক্ষের পাঠ্যপুস্তকের সঙ্গে সঙ্গে গণমাধ্যমেরও আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। এর জন্যই আমরা রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) শুরু করে ‘বঙ্গবন্ধু’ পর্যন্ত আরোও অন্যান্য জাতীয় চরিত্রকে আমাদের দৈনন্দিন আলোচনার বৃত্তে নিয়ে আসি। আর এক্ষেত্রে যার কথা সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয় তিনি হলেন “অহিংস আন্দোলনের পূজারি” মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী বা মহাত্মা গান্ধী (১৮৬৯-১৯৪৮)। বস্তুতঃ ‘সত্যাগ্রহ আন্দোলন’ (১৯১৭), ‘অসহযোগ আন্দোলন’ (১৯২০-১৯২২),  ‘আইন-অমান্য আন্দোলন’ (১৯৩০-৩২) ও ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলনের’ (১৯৪২-১৯৪৪) মাধ্যমে তিনি হয়ে উঠেছিলেন গণ-আন্দোলনের প্রতীক। তাঁর নেতৃত্ব ও সকলকে একত্রিত করে ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন করার পদ্ধতি তৎকালীন ভারতকে (১৯২০-১৯৪৮) এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে তাঁর মতো সংগ্রামী নেতা-নেত্রীদের তুলনার ক্ষেত্রে গান্ধীই হয়ে উঠেছিলেন Point of Reference। ফলে ঔপনিবেশিক শাসনের শেষ তিন দশকে ভারতীয় উপমহাদেশ হয়ে উঠেছিল ‘বহু গান্ধীর দেশ’। স্বাভাবিকভাবেই “সীমান্ত গান্ধী” (খাঁন আব্দুল গফফর খাঁন: ১৮৯০-১৯৮৮), মেদিনীপুরের “গান্ধী বুড়ি” (মাতঙ্গিনী হাজরা : ১৮৭০-১৯৪২), “উড়িষ্যা গান্ধী” (গোপবন্ধু দাস : ১৮৭৭-১৯২৮) বা “বিহারি গান্ধীর” (রাজেন্দ্র প্রাসাদ: ১৮৮৪-১৯৬৩) মতো আর অনেক স্থানীয় গান্ধীই স্থান পেয়েছেন ইতিহাসের পাতায়। তবে অনেক গান্ধীই রয়ে গেছেন ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকের বাইরে। কেউবা আবার হারিয়ে গেছেন স্মৃতির অতল গহ্বরে। এরকমই একজন প্রায় বিস্মৃত গান্ধী ছিলেন “ডুয়ার্স গান্ধী” বা নলিনীমোহন পাকরাশী (১৮৯৪-১৯৭৬)।

নলিনীমোহন পাকরাশীর (ভট্টাচার্য) জন্ম ১৮৯৪ সালে ব্রিটিশ-শাসিত অবিভক্ত বাংলার কুমিল্লা (তিপ্রা/ত্রিপুরা) জেলায়। বহু পণ্ডিত ও সংগ্রামীর জন্মস্থান বাংলার অন্যতম সংস্কৃতিবান এই জেলার গুরুত্বপূর্ণ মহকুমা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থানা এলাকায় ছিল তাঁর পৈত্রিক বাড়ি। মিথিলা থেকে ‘ন্যায়রত্ন’ উপাধিপ্রাপ্ত তাঁর পিতা নবীনচন্দ্রের যখন মৃত্যু হয় (১৯০৪ সালে) তখন নলিনীমোহনের বয়স তখন মাত্র ১১ বছর। স্বাধীনচেতা নলিনীমোহন বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের (১৯০৫) সময় থেকেই জাতীয়তাবাদী কার্যকলাপের প্রতি আকৃষ্ট হন। তাঁর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ও পারিবারিক দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে নলিনীমোহনকে পাঠানো হয় ময়মনসিংহে। জমিদার, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক আন্দোলনের অন্যতম পীঠস্থান ময়মনসিংহে এসে নলিনীমোহন জড়িয়ে পড়লেন যুগান্তর দলের সঙ্গে। যুগান্তর দলের সুরেন্দ্র মোহন ঘোষের [১৮৯৩-১৯৭৬) সান্নিধ্যে এসে তিনি ঔপনিবেশিক শক্তির বিরোধিতার মনোভাবকে আরও শক্তিশালী করেন। কিন্তু পারিবারিক পরিস্থিতির চাপে নলিনীমোহনকে চলে আসতে হয় রংপুরে। এখানে উচু বেতনে কাজ নেন এক ঠিকাদারি সংস্থায়। তাঁর তত্বাবধানে তৈরি হয় রংপুরের কারমাইকেল কলেজের [Carmichael College (1916)] বাড়ি।

স্বাধীন রাজনৈতিক চিন্তা ও বহু মানুষকে একত্রিতভাবে কাজ করানোর অভিজ্ঞতা নিয়ে নলিনীমোহন ডুয়ার্স অঞ্চলে আসেন ১৯২১ সালে। ততদিন ডুয়ার্সের রাজাভাতখাওয়ায় গড়ে উঠেছে জঙ্গলের কাঠ বিক্রির Auction Centre। বাবু রামরূপ সিংহের অধীনে ১৫০ টাকার বেতনে চাকরি নিয়ে ১৯২৯ থেকে নলিনীমোহন পাকাপাকিভাবে আলিপুরদুয়ারে বসবাস শুরু করেন এবং ধীরে ধীরে ডুয়ার্স অঞ্চলের জাতীয় আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ভূটান থেকে অধিকৃত ডুয়ার্সকে নিয়ে ১৯৬৯ সালে গঠিত হয় জলপাইগুড়ি জেলা। জলপাইগুড়ি মহকুমার সঙ্গে আলিপুরদুয়ার মহকুমার বক্সা, ফালাকাটা, আলিপুরদুয়ার, কুমারগ্রাম, শামুকতলা, মহাকালগুড়ি, কামাখ্যাগুড়ি ও অন্যান্য অঞ্চলেও নতুন ধরনের ভুমি বন্দোবস্ত শুরু হয়। শুরু হয় কৃষিজমি, নদী, ঘাট ও হাট থেকে খাজনা আদায়ের নতুন প্রথা।

পাশাপাশি ইংল্যান্ডের “শিল্পায়নজনিত উদ্বৃত্ত মুলধনের” বিনিয়োগ করার জন্য আসাম ও ডুয়ার্স হয়ে ওঠে চা-বাগিচার বিকাশের কেন্দ্রবিন্দু। ডুয়ার্স রূপান্তরিত হয় “ঔপনিবেশিক শক্তির বাগানে” (Garden of the Empire)। আলিপুরদুয়ার মহকুমার ভুটান ঘেঁষা অঞ্চলে দেশীয় ও ইউরোপীয় উদ্যোগীদের প্রচেষ্টায় স্থাপিত বেশ কিছু চা-বাগান। কালচিনি, হ্যামিলটনগঞ্জ, মাদারিহাট, রাজাভাতখাওয়া, কার্তিক, রায়ডাক, তুরিতুরি ও কুমারগ্রামের চা-বাগানগুলি ভরে ওঠে আদিবাসী শ্রমিক ও বাঙালি ‘বাবুদের’ ভিড়ে।

চা-বাগান অর্থনীতি, কাঠ ও প্রশাসনিক কারনে জলপাইগুড়ি হয়ে ওঠে এক গুরুত্বপূর্ণ জেলা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, চা-নিলাম কেন্দ্র, আদালত, নগরায়ন ও ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার কেন্দ্ররূপে বিশ শতকের প্রথমার্ধে জলপাইগুড়ি শহর পরিণত হয় তার  প্রাণকেন্দ্রে। রাজনৈতিক চেতনা ও শিক্ষা-সংস্কৃতির মূল ধারক হয়ে ওঠে জলপাইগুড়ি শহরের পাশ্চত্য শিক্ষায় আলোকিত আইনজীবী ও তাদের সহযোগী শ্রেণি। খুব সংগত কারণেই ডুয়ার্সের চা-বাগানের শ্রমিক ও “উৎপাদনের প্রাথমিক ক্ষেত্রে নিযুক্ত” স্থানীয় জাতি-জনজাতি সম্প্রদায়গুলি থেকে যায় জলপাইগুড়ির “অভিজাত- নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক ক্ষমতার বৃত্তের” বাইরে।

অন্যদিকে, জলপাইগুড়ি শহর থেকে অনেক দূরে অবস্থিত আলিপুরদুয়ার মহকুমা শহর ছিল অপেক্ষাকৃত অনুন্নত। গুটিকয় হাইস্কুল গড়ে উঠলেও এই শহরে ছিল না কোন কলেজ। পাশ্ববর্তী গ্রামগুলির অবস্থা ছিল আরও শোচনীয়। বিশ শতকের গোড়ায় মিশনারিদের চেষ্টায় বেশ কিছু প্রাইমারি ও মিডল ইংলিশ স্কুল গড়ে উঠলেও কুমারগ্রাম, মহাকালগুড়ি, কামাখ্যাগুড়ি, শামুকতলা, ফালাকাটা, মাদারহাটি ও বীরপাড়ার স্থানীয় মানুষেরা উচ্চশিক্ষায় সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিল। তাঁদের পক্ষে এলিট-রাজনীতির কেন্দ্রে প্রবেশ করা বা রাজনৈতিক কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হওয়া ছিল একেবারেই অসম্ভব।

বিশ শতকের গোড়ার দিকের আলিপুরদুয়ারের এরকম পরিস্থিতিতে ১৯২১ এ নলিনীমোহন আলিপুরদুয়ারে এসে দেখলেন যে এখানে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ(১৮৮৩), কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজ (১৮৯৯)  বা রংপুরের কারমাইকেল কলেজের মতো কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। নেই পূর্ববাংলার জমিদার শ্রেণির কৃষক শোষণ। এমনকি পূর্ববাংলার মতো রাজনীতি চেতনাও নেই। তবে এখানে আছে অন্য ধরনের শাসন ও শোষণ। শাসিতের হয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার মানুষের বড় অভাব। জলপাইগুড়ির এলিট নেতৃবর্গের ডুয়ার্সের সাধারণ মানুষের সমস্যা নিয়ে চিন্তাভাবনা করার মতো মানসিকতাই ছিলোনা। এরকম পরিস্থিতিতে নলিনীমোহন চুপ থাকতে পাড়েননি। মাসিক ১৫০ টাকা বেতনের কাজ ছেড়ে নলিনীমোহন ঝাঁপিয়ে পড়লেন জনগণকে সংগঠিত করার কাজে। নিজেকে উৎসর্গ করলেন ডুয়ার্সের সাধারণ মানুষকে নেতৃত্ব  দেওয়ার জন্য। তাঁর নেতৃত্বে শামুকতলার শুক্রবারের হাটে সাইমন কমিশন বিরোধী আন্দোলন (১৯২৯) ও ফালাকাটায় আইন অমান্য আন্দোলন (১৯৩০) তাঁকে ডুয়ার্সের রাজনৈতিক মহলে পরিচিত করে তোলে। কুমারগ্রামদুয়ার থেকে মাদারিহাট, ভলকা থেকে ফালাকাটা---ডুয়ার্সের সবত্রই নলিনীমোহন হয়ে ওঠেন “নলিনী ঠাকুর”। কুমারগ্রামদুয়ার, আলিপুরদুয়ার, ফালাকাটা ও মাদারিহাটের অন্যান্য কৃষক সম্প্রদায়ের ব্রিটিশ-বিরোধী মনোভাবকে সংগঠিত করেন নলিনীমোহন।

ভারত শাসন আইন (The Government of India Act, 1935) গৃহিত হওয়ার পরে ১৯৩৭ এর বিধানসভার নির্বাচনে ডুয়ার্সের নির্বাচনী রাজনীতিতে ভাগ বসানোর জন্য এগিয়ে আসেন জলপাইগুড়ির এলিট-রাজনীতিকগন। প্রসন্নদেব রায়কত, খগেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত (১৮৯৮-১৯৮৫) ও উপেন্দ্রনাথ বর্মন (১৮৯৮-১৯৮৮) জলপাইগুড়ি থেকে বাংলার বিধানসভায় প্রবেশ করেন। জলপাইগুড়ি-শিলিগুড়ি বিধানসভা ক্ষেত্রের তপশিলিজাতির প্রতিনিধি উপেন্দ্রনাথ ফজলুল হকের দ্বিতীয় মন্ত্রীসভার (১৯৪১-৪৩) মন্ত্রী হয়ে ডুয়ার্স অঞ্চলের কৃষকদের খাজনা কমানোর আর্জি জানিয়েছিলেন বিধানসভায়। কিন্তু এটা বাস্তবায়িত হয়নি। ডুয়ার্স অঞ্চলের মাটি পূর্ববাংলা বা দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলির মতো এতোটা উর্বর ছিল না। ফলে এখানকার জোত জমির কৃষকদের পক্ষে ভূমি রাজস্বের হার হয়ে উঠেছিল একটা বড় বোঝা। কৃষকদের মনে দানা বাঁধতে শুরু করেছিল খাজনা না দেওয়ার প্রবণতা।  “No Rent” বা খাজনার বন্ধের আন্দোলন কুমারগ্রামদুয়ার এলাকায় প্রখর রূপ ধারন করেছিল নলিনীমোহনের নেতৃত্বে। কুমারগ্রামের জোতদার মঘা দেওয়ানী বা মদন সিং বরুয়ার মতো কংগ্রেসি কৃষকেরা খাজনা বন্ধের আন্দোলনকে গণ-আন্দোলনে রূপান্তরিত করেছিলেন। খাজনা বন্ধের প্রভাব পড়েছিল কুমারগ্রামের কুলকুলি, দলদলি ও শামুকতলার হাটেও।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন (১৯৩৯-১৯৪৫) ভারতের রাজনীতির জটিল পরিস্থিতিতে ১৯৪২ এর ৮ই আগস্ট জাতীয় কংগ্রেসের “ভারত ছাড়ো” (Quite India) আন্দোলনের ডাক দেয়। “করেঙ্গে-ইয়ে-মরেঙ্গে” ধ্বনিতে ভেসে ওঠে ভারতের আকাশ বাতাস। ৯ই আগস্ট গান্ধীজী সহ জাতীয় কংগ্রেসের কেন্দ্রিয় নেতৃবর্গকে গ্রেফতার করা হয়। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অভাবে স্থানীয় কংগ্রেসী নেতৃবর্গ তাঁদের নিজস্ব মত ও কর্মপন্থানুযায়ী ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতায় মেতে উঠেন। ব্রিটিশ শাসনের প্রতীক (বিশেষত রেললাইন, টেলিগ্রাফ, পোস্ট অফিস ও যোগাযোগ ব্যবস্থা) সমূহের উৎপাটনে মেতে উঠে উন্মত্ত জনতা। ডুয়ার্সের মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলেও তাঁর প্রভাব অনুভূত হল। নলিনীমোহনের নেতৃত্বে কুমারগ্রাম থানা আক্রমন করে টেলিগ্রাম লাইন কেটে দিয়ে কাঠের তৈরি সেতুগুলির পাটাতন উপরে দিয়ে কুমারগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করেছিলেন এখানকার স্থানীয় জনগণ। ‘তারকাটা আন্দোলন’ নামে পরিচিত এই গন-আন্দোলনের পর নলিনীমোহন ডুয়ার্সের সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত হলেন “ডুয়ার্স গান্ধী” নামে।

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ইতিহাসের পরবর্তী পর্যায় আমাদের সকলেই জানা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর ভারতের রাজনৈতিক দলসমূহের সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের আলাপ-আলোচনার ফলস্বরূপ বিভিন্ন পরিকল্পনা গৃহিত হয়। ১৯৪৬ এর নির্বাচনের পর ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে গঠিত হয় ভারতের সংবিধান সভা (The Constituent Assembly)। ১৯৪৭ এর আগষ্ট মাসে ব্রিটিশ-ভারত দ্বিখন্ডিত হয়ে জন্ম নেয় ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি জাতিরাষ্ট্র (Nation State)। পশ্চিম বাংলার অন্যান্য জেলার মতো জলপাইগুড়িও ভরে যায় পূর্ববঙ্গীয় উদ্বাস্তুদের ভিড়ে। পূর্ববাংলার ময়মনসিংহ, পাবনা ও রংপুর থেকে উৎখ্যাত মানুষের ভিড়ে দ্রুত পাল্টে যায় ডুয়ার্সের জনবৈচিত্র। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ডুয়ার্সের জনগণ নলিনীমোহনকে ভুলতে শুরু করেন। পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায় (১৯৭২-১৯৭৭) কোচবিহারে এসে নলিনীমোহনকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেও বা তাঁকে ‘স্বাধীনতা সংগ্রামীর’ পদক দিয়ে ভারত সরকার সম্মানিত করলেও পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্টের শাসনকালে (১৯৭৭-২০১১) নলিনীমোহনের মতো ‘ডুয়ার্স গান্ধী’ চলে যান বিস্মৃতির অন্তরালে।

লক্ষ্য করার বিষয় হল জাতিয়তাবাদী দৃষ্টিতে লেখা পাঠ্যপুস্তকে ঔপনিবেশিক শাসনের ইতিবাচক সুযোগ থেকে বঞ্চিত ও ঔপনিবেশিক শাসনের দ্বারা সরাসরি শোষিত ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চল, কৃষক, আদিবাসী, শ্রমিক ও অন্যান্য প্রান্তিক মানুষেরা গুরুত্ত্ব পান নি। মার্ক্সবাদী ও নিম্নবর্গীয় ঐতিহাসিকেরা কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলনকে ইতিহাসের আলোচনায় স্থান দিলেও তাঁরা ডুয়ার্স অঞ্চলের ঔপনিবেশিক শক্তির বিরোধিতার আন্দোলন বা নলিনীমোহনের মতো নিস্বার্থ দেশসেবকের অবদানকে স্বীকৃতি দেননি। তবে ঔপনিবেশিক শাসন-সৃষ্ট আধুনিক শিক্ষা, মুদ্রনযন্ত্র, সংবাদ পত্র ও সাহিত্যের দ্বারা প্রভাবহীন ডুয়ার্সের সাধারণ মানুষের ঔপনিবেশিক শক্তির বিরোধিতাকে অনুভব করতে হলে ‘কুমিল্লা থেকে আসা নলিনীমোহনের ডুয়ার্স গান্ধী হয়ে ওঠাকে’ স্মরণ করতে হবে ।

ড. রূপ কুমার বর্মণ, কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আম্বেদকর চর্চা কেন্দ্রের সমন্বয়ক

এ সম্পর্কিত আরও খবর