কবিতাই মহাদেব সাহার সুখ-দুঃখের সঙ্গী 

নিবন্ধ, শিল্প-সাহিত্য

ইজাজ আহমেদ মিলন | 2023-09-01 15:50:19

মহাদেব সাহা। কবি, কবি এবং কবিই। কবিতার সঙ্গেই কেটে গেছে জীবনের প্রায় পুরো অংশ। কবিতায় তিনি মন্ত্রের সন্ধান করেছেন, দর্শন-আধুনিকতারও। কোথাও সমর্পণও করেছেন কোনো এক মহাশক্তির কাছে। বেদনায় ভরা একটি জীবন যাপন করেছেন মহাদেব সাহা। দুঃখ, কষ্ট যাতনা-সব আছে এর ভেতরে। কবি অকপটে স্বীকারও করেছেন সে কথা। এক সাক্ষাৎকারে মহাদেব সাহা বলেছেন ‘ভুল জীবন কাটানোর জন্যই জীবন কাটিয়ে গেলাম। দুঃখই আসলে মানুষের জীবন। আমার আর কী দুঃখ আছে! রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- দুঃখের তপস্যাই জীবন। গীতবিতানের প্রতিটি পাতাই ভেজা। দুঃখ কবিতা। মানুষের যতো দুঃখ সেই দুঃখ আমি কবিতায় লিখতে পারি নাই। মানুষ যদি সত্যিকারে নিজেকে চেনে তাহলে সে না কেঁদে থাকতে পারে না। হাসি হচ্ছে তার অহংকার।’

৫ আগস্ট কবি মহাদেব সাহার ৭৮তম জন্মবার্ষিকী। এদিন তিনি জন্ম গ্রহণ করেন সিরাজগঞ্জের ধানঘড়া গ্রামে। বঙ্গবন্ধু একবার মহাদেব সাহার কণ্ঠে নিজের লেখা কবিতা শুনে মুগ্ধ হয়ে পরম মমতায় তার কপালে চুম্বন করেছিলেন। তখন কবির বয়স মাত্র এগারো বার বছর। কবিতাটি ছিল এরকম ‘ তুমি আসিয়াছো ছায়া ঘেরা আমাদের এই গ্রামে/ পাতার তোরণ গড়েছি আমরা মুজিব তোমার নামে।’ সিরাজগঞ্জের এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তব্যে ভূয়সী প্রশসংসা করেছিলেন মহাদেব সাহার। প্রত্যাশা করেছিলেন কিশোর মহাদেব একদিন অনেক বড় কবি হবে।

তারপর প্রায় ছয় দশক পেরিয়ে গেছে। বিধাতা নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধুর সে আর্শীবাদ অপূর্ণ রাখেননি। মহাদেব সাহা কবি হয়েছেন। এবং বড় কবি। শুধু বড় কবিই নন, দেশ বরেণ্য কবি। অন্যতম প্রধান কবি। তাঁর এই এতো বড় কবি হয়ে উঠার পেছনে হয়তো বঙ্গবন্ধুর দেওয়া সেই দায়ভারটাই কাজ করেছে সবচেয়ে বেশি। তাঁর কাব্য প্রতিভার চূড়ান্ত স্বাক্ষর ‘এই গৃহ এই সন্ন্যাস’১৯৭২ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর চারদিকে হৈচৈ পড়ে যায়।  কাব্য সাধনায় মহাদেব সাহা জীবনের প্রায় পুরোটা অংশই বিনিয়োগ করেছেন। সফলতার শিখরে আরোহন করেছেন বহু আগেই। কবি মহাদেব সাহার কবিতা পড়ে কত পাঠকের হৃদয়ে যে প্রেম জন্মেছে, হাবুডুবু খেয়েছেন ভালোবাসার গভীর জলে। এই কবির কবিতা পড়ে নিরাশা দূরে ঠেলে দিয়ে পাঠক আশায় বুক বেধেছেন। তার কবিতায় যে ছন্দময়তা, কাব্যের যে ব্যবহার, চিন্তার গভীরতা দেখে কখনো কখনো পুলকিত হই। অবাক হই। কল্পনার জগতে এই কবিকে মুকুটহীন সম্রাট বললেও অক্ত্যুক্তি হবে না।

এদেশের মাটি, জল আর প্রকৃতি তাকে কবি হতে উৎসাহিত করেছে। রক্ত মাংস, শিরা উপশিরা, হৃদয় এবং হৃদপিন্ড থেকে উৎসারিত নানা সৌরভে ভরপুর মহাদেব সাহার সব কবিতা। তিনি প্রেমের কবি, প্রকৃতির কবি, একাকিত্বের কবি। মহাদেব সাহা ফুল,বৃক্ষ আকাশ, মেঘ, নদী, ঢেউ, ভালোবাসা, দুঃখ কষ্ট আর যাতনাকে সাবলিল ভাষায় পরম দরদ দিয়ে চমৎকার সব চিত্রকল্প ব্যবহার করে বিনিমার্ণ করেছেন একেকটি কবিতা। কবিতায় চিত্রকল্পের ব্যবহার দেখে মনে হয় তিনি চরম বাস্তবতাকে চন্দময় ভঙ্গিমায় পাঠককে উপহার দিচ্ছেন নতুন সব কবিতা। মহাদেব সাহার মতো এতো চিত্রকল্প অন্য কোন কবির কবিতায় খুব কমই পাওয়া যায়।

কাব্য বির্নিমাণে তাঁর যে দরদ আর মমতা সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠে যখন পড়ি ‘বন্ধুর জন্য বিজ্ঞাপন, ‘আবুল হাসানের জন্য এলিজি’, ‘মানব তোমার কাছে যেতে চাই’, ‘দেশপ্রেম, ’ফিরে আসা গ্রাম’ কিংবা ‘ চিঠি দিও’, বা আজীবন একই চিঠি’, ইত্যাদি কবিতা। কবি মহাদেব সাহার কবিতায় নিজস্ব একটা বৈশিষ্ট্য আছে। কোন কবিতার আগে বা পরে কবির নাম না উল্লেখ করলেও যদি মহাদেব সাহার কবিতা থাকে তাহলে তার পাঠকরা নিশ্চিত করে বলে দিতে পারবেন যে এটা মহাদেবের কবিতা। তাঁর কবিতার প্রতিটি পঙক্তিতে প্রেম, দ্রোহ, শান্তি , আশা আর মানবতার জয় গান গেয়েছেন তিনি। 

কবি মহাদেব সাহা বারবার আঘাত প্রাপ্ত হয়েছেন। কিন্তু কখনো তাকে নিরাশা নামক ব্যাধি গ্রাস করতে পারেনি। তিনি নৈরাশ্যবাদীর দল নন। আশাবাদী দলভুক্ত কবি মহাদেব সাহা আমাদের পরিবেশ ধবংস এবং সমাজে বিভক্তের অমানবিক প্রবণতা দেখে প্রবলভাবে আঘাত প্রাপ্ত হন। মহাদেব অসম্ভব আবেগ দিয়ে শক্তিশালী দুর্বিনীত অনুভূতি উচ্চারণ করে সৃষ্টি করেন হৃদয়গ্রাহী পঙক্তিমালা। তাঁর সৃষ্টি প্রতিটি পঙক্তিই যেন দেশের জন্য, মানব জাতির জন্য এমনকি পৃথিবীর জন্য একেকটি গুরুত্বপূর্ণ বেদবাক্য। সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি মহাদেব সাহা সকল ধর্ম বর্ণের মানুষকে এক কাতারে আনার চেষ্টা করেছেন তাঁর কবিতায়। আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসন যখন মানুষকে গ্রাস করতে শুরু করেছে ঠিক তখন আপাদমস্তক এই কবি তার সম্মোহনী কবিতার পঙক্তি দিয়ে কাব্য প্রেমিক পাঠককে ফিরিয়ে এনেছেন কবিতার টেবিলে। রক্তপাত, সংঘাত আর কোন রকম নিষ্ঠুরতা অসহনীয়। বিশ্ব শান্তি আর মানবতার জন্য তার কলম সব সময় রেখেছেন সচল।

নিমগ্ন চৈতন্যের কবি মহাদেব সাহা তার পুরোটা জীবন তাঁর নীতি থেকে বিন্দুমাত্রও সরে দাঁড়াননি। ইচ্ছে করলে তিনি প্রচুর বিত্ত বৈভবের মালিক হতে পারতেন। বিশাল অট্টালিকা, বিলাশবহুল গাড়ি কিংবা শহরের বুকে নিজস্ব কোন শপিংমল তৈরি করতে পারতেন। কিন্তু কাব্যের ভালোবাসায় আসক্ত হয়ে এসব ত্যাগ করেছেন নির্দ্বিধায়। মহাদেব সাহা কবিতাকেই চির আরাধ্য ভেবেছেন, জেনেছেন। কবিতাই তার সুখ-দুঃখের সঙ্গী। মহাদেব সাহার কবিতার প্রতিটি স্তবক থেকে যেন ভেসে আসে সুগন্ধি ফুলের সৌরভ। মাতৃভূমিতে কৃষকের ফলানো সুস্বাদু কোন ফলের রসালো স্বাদ যেন পাওয়া যায় কবিতার গভীরে অবগাহন করলে। অকারণ দূর্বোধ্য শব্দ দিয়ে বাক্য সৃষ্টি করে কবিতা লেখার পক্ষে নন তিনি। তার কবিতা সহজ সরল ভাষাশৈলিতে নির্মিত। অথচ কত হৃদয়গ্রাহী। কত ভাবাবেগ ফুটে উঠে কবিতার স্তবকে স্তবকে।

লেখক: ইজাজ আহমেদ মিলন, মোবাইল: ০১৭১৯০৮০১৯১

এ সম্পর্কিত আরও খবর