রোহিঙ্গা সংকটের ২ বছর আজ

কক্সবাজার, দেশের খবর

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম, কক্সবাজার | 2023-08-31 16:21:07

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট। ঐদিন মিয়ানমারের সেনা চৌকিতে হামলার অভিযোগে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন শুরু হয়। এরপর থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের আকাশে উড়ছে আগুনের কালো ধোঁয়া। সেই দৃশ্য দেখা গিয়েছিল বাংলাদেশের উখিয়া-টেকনাফের সীমান্ত দিয়ে।

তারপরই হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশের প্রবেশের আকুতি জানায়। সিদ্ধান্তহীনতায় পড়ে বাংলাদেশ সরকার। কিছুক্ষণ পরই ঘোষণা আসল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ মানবিক বিবেচনায় রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়ার। সেই নির্দেশ সীমান্ত এলাকায় পৌঁছার সাথে সাথে রোহিঙ্গারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে উখিয়া-টেকনাফে ঢুকতে থাকে। নৌ পথে বাংলাদেশে আসতে গিয়ে ট্রলারডুবিতে মারা যায় প্রায় তিন শতাধিক নারী, পুরুষ ও শিশু।

কেউ এসেছে গুলিবিদ্ধ, কেউ এসেছে ধর্ষিত হয়ে। নির্মম নির্যাতনের শিকার অনেক রোহিঙ্গাকে দেখে হতবাক হয়েছে স্থানীয়রা। তাই নিজেদের ভাত খাইয়েছেন রোহিঙ্গা মুসলিমদের। এমন কি, নিজেদের থাকার ঘরেও ভাগাভাগি করে থেকেছেন স্থানীয়রা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিশ্বের বড় বড় এনজিও ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এসে রোহিঙ্গাদের জন্য বিভিন্ন ক্যাম্প তৈরি করে। উখিয়া-টেকনাফের প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার একর ভূমিতে ৩২টি ক্যাম্পে ভাগ হয়ে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার বসবাস।

রোববার (২৫ আগস্ট) রোহিঙ্গা সংকটের দুই বছর পূর্ণ হয়েছে। দুই বছর ধরে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিকভাবে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। চাপের মুখে এক পর্যায়ে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে সম্মতি দেয়। পর পর দুই বার প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলোচনা করে।

তবে এ আলোচনা কোনো ধরনের আলোর মুখ দেখেনি। দুই বার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সব প্রস্তুতি নিয়েও তা শুরু করা যায়নি। তার পেছনে কিছু এনজিও সংস্থার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনবিরোধী প্রচারণাকে দায়ী করছে স্থানীয়রা।

রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে কী পেয়েছে বাংলাদেশ? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলেই উঠে আসে ভয়াবহ এক চিত্র। যার মধ্যে রয়েছে, নিজেদের জমির উপর যাদের আশ্রয় দিয়েছেন সেসব রোহিঙ্গারা এখন বাংলাদেশিদের অপহরণ ও হত্যা করছে। পাশাপাশি বেপরোয়া আচরণে এখন আতঙ্কিত উখিয়া-টেকনাফবাসী।

কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, উখিয়া ও টেকনাফের সবুজ পাহাড়ে রোহিঙ্গাদের বসবাসের ঘর তৈরির জন্য কেটে ফেলা হয়েছে পাহাড়ি ছোট-বড় অসংখ্য গাছপালা। একসময়ের সবুজ পাহাড় এখন বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়েছে।

ফলে সেখানে পরিবেশ, বনভূমি ও জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়েছে। পাহাড়ে রোহিঙ্গাদের বসতি স্থাপন করতে গিয়ে হাতির আবাসস্থল ও বিচরণক্ষেত্রও বিনষ্ট হয়েছে। এছাড়া প্রতি মাসে রোহিঙ্গাদের রান্নাবান্নার কাজে ছয় হাজার ৮০০ টন জ্বালানি কাঠ প্রয়োজন। রোহিঙ্গারা স্থানীয় পাহাড়ি বনাঞ্চল থেকেই এই কাঠ সংগ্রহ করে।

গত জুলাই মাসে কক্সবাজারের দক্ষিণ বন বিভাগের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, বালুখালী ঢালা, ময়নারঘোনা, থাইংখালী তাজনিমার খোলা, হাকিমপাড়া, জামতলি বাঘঘোনা, শফিউল্লাহ কাটা ও টেকনাফের চাকমারকুল, উনচিপ্রাং, লেদা, মৌচনী, জাদিমুরা ও কেরানতলী এলাকাসহ বন বিভাগের গেজেটভুক্ত প্রায় ছয় হাজার ১৬০ একর বনভূমিতে বসতি স্থাপন করেছে।

বনভূমিতে রোহিঙ্গাদের এভাবে বসতি স্থাপনের কারণে টাকার হিসাবে সৃজিত ও প্রাকৃতিক বনের ক্ষতি হয়েছে ৪৫৬ কোটি আট লাখ টাকা। একইভাবে জীববৈচিত্র্যের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এক হাজার ৪০৯ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। সে হিসাবে বনজ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির পরিমাণ অন্তত এক হাজার ৮৬৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা।

ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার আবুল কালাম বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম-কে বলেন, ‘প্রত্যাবাসন শুরুর লক্ষ্যে দ্বিতীয় বারের মতো রোহিঙ্গাদের বুঝানো হয়েছে। কিন্তু তারা রাজি না হওয়ায় সে প্রক্রিয়া চালু করতে আরও কিছু সময় লাগছে।’

প্রসঙ্গত, ১৯৮০’র দশকে নাগরিকত্ব আইনে মিয়ানমারের জান্তা সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের অধিকার কেড়ে নেয়। গত বছরের অক্টোবরের শুরুর দিকে ধাপে ধাপে সামরিক প্রচারণা চালিয়ে সেখানকার বাসিন্দাদের রোহিঙ্গাবিদ্বেষী করে তোলা হয়। এরপর ৯ অক্টোবর রোহিঙ্গাদের ওপর সেনা ও স্থানীয় মগদের নির্যাতন শুরু হয়। ঐদিন থেকে কয়েক দফায় বাংলাদেশে এসেছিল রোহিঙ্গারা।

এর আগেও ১৯৭৮ ও ১৯৯২ সালে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। ১৯৭৮ ও ১৯৯২ সালে যারা বাংলাদেশে আসে, তাদের কুতুপালং ও টেকনাফের নয়াপাড়ায় দুইটি ক্যাম্পে রাখা হয়। সেখানে তারা এ পর্যন্ত ছিল।

কিন্তু ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট আবারও নিপীড়নের মুখে বাংলাদেশে আসতে হয় রোহিঙ্গাদের। কিন্তু এবার প্রায় সাত লাখের বেশি। নতুন পুরাতন মিলিয়ে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সংখ্যা এখন প্রায় ১১ লাখ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর