বাংলাদেশের কাঁধে ১১ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা

কক্সবাজার, দেশের খবর

মুহিববুল্লাহ মুহিব ও নুরুল হক, কক্সবাজার, বার্তা ২৪.কম, কক্সবাজার | 2023-09-01 19:39:10

২০ জুন, বিশ্ব শরণার্থী দিবস। মিয়ানমার থেকে চার দফায় ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা এসে শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে অবস্থান করছে। ফলে দেশে রোহিঙ্গারা বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের পাহাড়ের চূড়ায় এসব রোহিঙ্গাদের অবস্থান। তাদের শিবিরগুলো অরক্ষিত থাকায় তারা সর্বত্র বিচরণ করে বেড়াচ্ছে। রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থাসহ আশ্রিত রোহিঙ্গাদের নোয়াখালীর ভাসানচরে স্থানান্তরের দাবি তুলেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। পাশাপাশি দ্রুত মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া চালু করারও দাবি জানান তারা।

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আগমন

বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হয়ে আসাটা নতুন নয়। ১৯৭৮ সালে প্রথম মিয়ানমার থেকে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা এদেশে পালিয়ে আসে। ওই সময় সে দেশে মানবাধিকার লংঘিত হচ্ছিল বলে অভিযোগ করা হয়েছিল। ১৯৭৮ সালে সাড়ে তিন লাখের মত রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে কক্সবাজার, রামু, নাইক্ষ্যংছড়ি, উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয় নেয়। তবে আন্তজার্তিকভাবে কোনো সাহায্য ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা ছিল না তখন। তাই স্বল্প সময়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সরকারের দ্বি-পাক্ষিক বৈঠকের মাধ্যমে দুই লাখ রোহিঙ্গাকে ফেরত নেয় মিয়ানমার। বাকিরা বাংলাদেশেই থেকে গেছে। তারা এখন দেশের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়ে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। এর পর ১৯৯২ সালে আবার নির্যাতনের মুখে আড়াই লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।

তারা বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলায় ১৪টি ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়। ক্যাম্পগুলোর বেশির ভাগ বন বিভাগের জমিতে স্থাপন করা হয়েছিল। পরে ২০১২ সালের জুনে মিয়ানমারে জাতিগত দাঙ্গা মংডু থেকে আকিয়াব পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়লে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন শুরু হয়। এরপর ২০১৬ সালের অক্টোবরে রাখাইন রাজ্যে পুলিশ ফাঁড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে। এতে কয়েকজন পুলিশ হতাহত হয়। মিয়ানমার এ হামলায় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা জড়িত বলে দাবি করে। পরদিন হঠাৎ সেনারা সন্ত্রাসী দমনের নামে রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায়। এতে ৮৭ হাজার রোহিঙ্গারা প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আসে এদেশে।

সর্বশেষ গত ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইন রাজ্যের ২৪টি পুলিশ ফাঁড়িতে একযোগে হামলার ঘটনা ঘটে। সে দেশে সেনারা অপরাধী দমনের নামে শুরু করে রোহিঙ্গা নিধন অভিযান। এতে প্রাণে বাঁচতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এ সময় সাড়ে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয় উখিয়া-টেকনাফের পাহাড় ও সমতলে। কক্সবাজারের দুই উপজেলায় বর্তমানে ৩৪টি রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে তারা। প্রায় ১০ হাজার একর বনভূমি ধ্বংস করে রেহিঙ্গা শিবির তৈরি করা হয়।

প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া
সম্প্রতি রোহিঙ্গা শরনার্থীদের ফেরত নিতে দেশি-বিদেশি সংস্থার চাপের মুখে মিয়ানমার সরকার ২০১৭ সালে ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। এরপর দুই দেশের মধ্যে একাধিক বৈঠক হলেও প্রত্যাবাসন শুরু হয়নি। পরে এক বৈঠকে ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর প্রত্যাবাসন শুরুর দিন ঠিক করা হয়। এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যথা সময়ে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। প্রথম দফায় রোহিঙ্গাদের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্ত ট্রানজিট পয়েন্ট দিয়ে পাঠানোর কথা ছিল। এ সময় মিয়ানমারে নিপীড়ন ও বৈষম্যে কারণে রোহিঙ্গারা দেশে ফিরতে রাজি হয়নি। রোহিঙ্গাদের মধ্যে ভয়, তারা এভাবে ফেরত গেলে আবারও নির্যাতনের শিকার হবে। তবে রোহিঙ্গারা ফেরত যেতে ইচ্ছুক না, তারা তাদের নিরাপত্তা ও স্বদেশের জমি ফেরতের দাবি করেছে। এর ফলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া থমকে যায়।

নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা
বর্তমানে নতুন ও পুরাতন মিলিয়ে দু’টি উপজেলায় ১১ লাখ ২৮ হাজার ৫৫৪ রোহিঙ্গা বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের আওতায় রয়েছে। বর্তমানে সে কার্যক্রম বন্ধ। ইমিগ্রেশন বহিরাগমন বিভাগ ও পাসপোর্ট অধিদফতর রোহিঙ্গাদের এই কাযক্রম পরিচালনা করেন। তবে শিবির থেকে রোহিঙ্গারা পালিয়ে যাচ্ছে এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। যার ফলে বায়োমেট্রিক পদ্ধতির আওতায় আসা রোহিঙ্গারা শিবিরে আছে কিনা খতিয়ে দেখা জরুরি বলে মনে করে সচেতন মহল।

বাড়ছে অপরাধ
পুলিশের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দুই বছরে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে হত্যাসহ ২৩০টির মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড হয়েছে। তার মধ্যে ২৫টির মত খুন হয়েছে। এসব ঘটনায় দু’শ’ রোহিঙ্গাকে আসামি করা হয়। এর মধ্যে অস্ত্র আইনে ২৫টি মামলায় ৫৫ জন, মাদক আইনে ১০০ মামলায় ১৫০ জন, পাসপোর্ট আইনের ৬৫ মামলায় ৫০ জন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের দুই মামলায় দু'জন, অপহরণের পাঁচ ঘটনায় ১০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এছাড়া চোরাচালান আইনের সাত মামলায় ১৫ জন, চুরির কয়েকটি মামলায় ১০ জন এবং ডাকাতির আট মামলায় ২৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। এছাড়াও, গত দেড় বছরে রোহিঙ্গা শিবির থেকে পালিয়ে সাগরপথে মালয়েশিয়া পাড়িসহ বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায় ৫৬ হাজার রোহিঙ্গাকে আটক করে ক্যাম্পে ফেরত আনা হয়।

স্থানীয়দের আশঙ্কা
উখিয়া ও টেকনাফের সর্বত্র শরণার্থী শিবির। দুই উপজেলার জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ। অথচ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে ১১ লাখেরও বেশি। যা স্থানীয়দের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। এছাড়া দিন যতই গড়াচ্ছে, রোহিঙ্গা শিবিরে বাড়ছে অস্থিরতা। একই সঙ্গে বাড়ছে হত্যা, গুম, অপহরণসহ নানা অপরাধ। রোহিঙ্গাদের কাছে স্থানীয়রাই এখন চাপে আছে। প্রতিদিন রোহিঙ্গাদের কারণে কোনো না কোনো সমস্যায় পড়ছে স্থানীয়রা। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় বড় ধরনের ঘটনার আশঙ্কা করছে সংশ্লিষ্টরা।

রোহিঙ্গা ক্যাম্প, ছবি: বার্তা২৪.কম

 

আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ) মুহিব উল্লাহ বার্তা২৪.কমকে বলেন, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে থাকবে এটা কিন্তু আমরা চাই না। বাংলাদেশ আমাদের বাড়ি নয়। চিরদিন বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবিরে থাকতে চাই না। আমরা নিজ দেশে ফিরতে চাই। প্রায় দুই বছরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ওআইসিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদল, গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন দেশের মন্ত্রী-এমপিরা রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন। কিন্তু তাতে খুব একটা সুফল আসেনি।

টেকনাফ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুল আলম বার্তা২৪.কমকে বলেন, মিয়ানমারের মিথ্যাচারের কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বন্ধ রয়েছে। বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা এখন বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যাচ্ছে। তবে এসব সঙ্কট নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে সরকার।

কক্সবাজার শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ আবুল কালাম বার্তা ২৪.কমকে বলেন, বর্তমানে নতুন ও পুরাতন সব মিলিয়ে উখিয়া-টেকনাফ দু’টি উপজেলায় ১০ লাখের মত রোহিঙ্গা রয়েছে। বিশ্ব শরণার্থী দিবস উপলক্ষে কয়েকটি রোহিঙ্গা শিবিরে তা পালনের আয়োজন করা হয়েছে। শিবিরগুলোতে র‌্যালি, আলোচনা, খেলাধুলা ও রোহিঙ্গাদের জীবনীর ওপর চিত্র প্রদর্শন করা হবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর