বেনাপোল বন্দরে রাজনৈতিক নেতাদের হাতে শোষিত শ্রমিকরা

যশোর, দেশের খবর

আজিজুল হক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বেনাপোল, বার্তা২৪.কম | 2023-08-26 02:41:12

বেনাপোল স্থলবন্দরে শ্রমিকদের অধিকার ও ন্যায্য মজুরি বাস্তবায়নের নামে এক শ্রেণির রাজনৈতিক নেতারা খেটে খাওয়া মানুষদের আজও শোষণ করে চলেছে। এই রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারা আত্মসাৎকৃত শ্রমিকদের ঘাম ঝরানো উপার্জনের তিন কোটি ৪১ লাখ টাকা এখনো তারা ফেরত পায়নি। ফলে নিদারুণ কষ্টে তাদের মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে।

সাধারণ শ্রমিকেরা জানান, এখানে প্রভাব বিস্তার করে রাজনৈতিক নেতাদের ভাগ্য বদল হলেও যাদের রক্তঘাম ঝরিয়ে উপার্জন তাদের কোন পরিবর্তন ঘটে না। ন্যায্য অধিকারটুকু থেকেও সবসময় বঞ্চিত শ্রমিকরা। এমনকি এসব নেতারা বারবার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।

তারা বলেন, 'সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর বিশ্রামস্থল না পেয়ে কখনো ফুটপাথে আবার কখনো গাছ তলায় শুয়ে-বসে সময় পার করতে হয়। আর আহত হয়ে সময় মতো চিকিৎসা না পেয়ে হারাতে হয় জীবন।'

তবে রাজনৈতিক নেতারা জানান, শ্রমিকদের যৌক্তিক দাবি যেন বাস্তবায়ন হয়, তার জন্য তারা সব মহলে আলোচনা তুলবেন।

জানা যায়, দেশের সর্ববৃহত্তম এই বেনাপোল বন্দরের যাত্রা ১৯৭২ সাল থেকে। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বেনাপোল বন্দরের গুরুত্ব দুই দেশের ব্যবসায়ীদের কাছে অপরিসীম। এখানে রাজস্ব আদায় ও পণ্য ছাড় করানোর কাজে বন্দর ও কাস্টমসের কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে প্রায় পাঁচ শতাধিক। এছাড়া বন্দর থেকে আমদানি পণ্য ছাড় করানোর কাজ করছে ৭৫০টি সিএন্ডএফ এজেন্টের প্রতিনিধিরা। রয়েছে সমপরিমাণের ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি। আরও রয়েছে ব্যাংক, বীমাসহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।

এ পথে আমদানি হওয়া পণ্য খালাস কাজে প্রায় দুই হাজার হ্যান্ডলিংক শ্রমিক করছে। সবকিছু মিলিয়ে এই বন্দরের এসব প্রতিষ্ঠানে প্রায় ২০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান আর লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা রয়েছে। প্রতিবছর এ পথে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হচ্ছে। সেখান থেকে সরকারের আয় হচ্ছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা।

শ্রমিকরা বলেন, 'এক সময় এ বন্দরে সাধারণ শ্রমিকরা সংগঠনের নেতৃত্ব দিতেন। তখন শ্রমিকদের টাকা এমন লুটপাটের অভিযোগ শোনা যেত না। কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে এ বন্দরে সাধারণ শ্রমিকদের কাতারে প্রভাব বিস্তার করে ঢুকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। যারা কেউই প্রকৃত শ্রমিক না।'

বন্দরের ৯২৫ শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি রাজু আহমেদ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, 'বছর তিনেক আগে শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও আলী নেতা পৌর কমিশনার রাশেদ আলী বন্দর শ্রমিকদের তিন কোটি ৪০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন। এতে ১১ জনের নামে মামলা হয়েছে। এ পর্যন্ত তারা কেউ আটক হয়নি আর টাকাও ফেরত দেয়নি।'

তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'শ্রমিকদের বিশ্রামের জন্য বন্দর অভ্যন্তরে রেস্ট হাউজ, খাওয়ার পানির ব্যবস্থা ও তাৎক্ষনিক দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসার জন্য একটি হাসপাতাল নির্মাণের দাবি দীর্ঘদিনের। তাও পূরণ হয়নি। সবার ভাগ্য পরিবর্তন হলেও যাদের ঘামে, আয় তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটে না। দাবি পূরণে রাজনৈতিক নেতারাও কথা দেয় কিন্তু এ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি।'

৮৯১ শ্রমিক ইউনিয়নের সেক্রেটারি জানে আলম বার্তা২৪.কম-কে জানান, বন্দরে এসিডসহ ঝুঁকিপূর্ণ পণ্য খালাসে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামও তাদের সরবরাহ করা হয় না। কিছু দিন আগে তাদের একজন শ্রমিক বন্দরে এসিডের ড্রাম নামাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় শরীর ঝলসে মারা যায়। আরও মারা গেছেন চারজন। এছাড়া অনেক শ্রমিক আছে যারা কাজ করতে যেয়ে আহত হয়ে পঙ্গু হয়ে পড়ে আছেন। শ্রমিকরাই তাদের খোঁজ খবর নেয়। কিন্তু যাদের জন্য কাজ করছে সেই বন্দর অথবা ঠিকাদারের লোকজন কেউ দেখেন না।

বেনাপোল স্থলবন্দর ইমপ্লোয়েজ ইউনিয়নের সিনিয়র সহ-সভাপতি মনির মজুমদার বলেন, 'আজ শ্রমিকরা পরিশ্রম করছে বলে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তাই শ্রমিকদের ভাগ্য উন্নয়নে সবাইকে আন্তরিক হয়ে কাজ করতে হবে। বাণিজ্যের সাথে জড়িত বিশেষ বিশেষ মহলে এ নিয়ে কথা বলব।'

উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ও বন্দর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক অহিদুল ইসলাম অহিদ জানান, তিনি বন্দর শ্রমিক ইউনিয়নে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে শ্রমিকেরা পূর্বের চেয়ে অনেক ভাল আছে। বন্দরে কাজের স্বার্থে শ্রমিকদের যে দাবি দাবা তা যেন দ্রুত বাস্তবায়ন হয় তাতে তিনি সবরকম যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। এর আগে যারা শ্রমিকদের রক্ত ঘামের টাকা মেরে খেয়েছে তাদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের চেষ্টা চলছে বলেও জানান তিনি।

বাংলাদেশ বন্দরের খণ্ডকালীন মেম্বার জাহিদ হোসেন মোল্লা বার্তা২৪.কম-কে জানান, 'বেনাপোলে বন্দর আধুনিকায়নে নতুন জায়গা অধিগ্রহণের কাজ চলছে। সেখানে বাণিজ্যিক সুবিধাসহ শ্রমিকদের কল্যাণে সব ধরনের সুবিধা থাকবে।'

এ সম্পর্কিত আরও খবর