কীর্তনরত সাধুদের হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা

ফরিদপুর, দেশের খবর

রেজাউল করিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, ফরিদপুর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-21 21:49:49

১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল। ফরিদপুরের শ্রীধাম শ্রীঅঙ্গন আশ্রমে ঘটেছিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে জঘণ্যতম নারকীয় গণহত্যার একটি। পাকিস্তানি সেনারা আশ্রমে হামলা চালিয়ে হত্যা করেছিল কীর্তনরত আট সাধুকে।

সেদিন অলৌকিকভাবে বেঁচে যান শ্রী অঙ্গন প্রভু জগদ্বন্ধু ব্রহ্মচারী আশ্রমের সেবায়েত হরিপ্রিয় ব্রহ্মচারী। ঘাতকদের চোখ এড়িয়ে পালিয়ে গিয়ে প্রাণে বেঁচে যান বর্তমানে ৮৫ বছরের এই সাধু।

হরিপ্রিয় ব্রহ্মচারী সেদিনের ঘটনার বিবরণে বলেন, ‘আমার চোখের সামনেই গুলি করে মারল আট জন সন্ন্যাসীকে। ব্রাউনিয়া ফুল গাছ আর জঙ্গলের আড়ালে লুকিয়ে বেঁচে গেলাম।’

শ্রীধাম শ্রীঅঙ্গনে সেদিনের শহীদেরা হচ্ছেন- কীর্তনব্রত ব্রহ্মচারী, নিদান বন্ধু ব্রহ্মচারী, অন্ধকানাই ব্রহ্মচারী, বন্ধু দাস ব্রহ্মচারী, ক্ষিতি বন্ধু ব্রহ্মচারী, গৌঢ়বন্ধু ব্রহ্মচারী, চির বন্ধু ব্রহ্মচারী ও রবি বন্ধু ব্রহ্মচারী। মুক্তিযুদ্ধের পর শ্রী অঙ্গন মন্দিরের চালতে তলার নিচে আট শহীদ সাধুর স্মরণে আটটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়।

ফরিদপুর শহরের গোয়ালচামট এলাকায় অবস্থিত শ্রীধাম শ্রী অঙ্গন। অহোরাত্র নামকীর্তন হয় এখানে। এভাবে প্রভুর নাম জপতে জপতেই মানবমুক্তি ও জগতের কল্যাণ হবে- এ গভীর বিশ্বাসে অষ্টপ্রহরই কীর্তন করেন গৃহত্যাগী সন্ন্যাসীরা।

মানবমুক্তির অগ্রপথিক প্রভু শ্রী শ্রী জগদ্বন্ধু সুন্দরের আরাধনা করে তারা দিনরাত জপেন ‘বলো জয় জগৎ বন্ধু বোল’। আর হানাদার পাকিস্তানী ঘাতকেরা এটাকেই রূপান্তর করে ‘ জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে।

শ্রীঅঙ্গনে পাকিস্তানিদের হাতে নিহত আট সন্ন্যাসীর স্মরণে নির্মিত ফলক/ ছবি: বার্তা২৪.কম

সঙ্গী এ দেশীয় রাজাকার আর বিহারীরাও সেদিন হায়েনাদের এটাই বুঝিয়ে ছিল। ফলে দানবেরা ব্রাশফায়ার করে কীর্তনরত আট সাধুকে হত্যা করে।

ফরিদপুরে পাকিস্থানি সেনারা আসছে এ খবর পেয়ে প্রভু জগৎ বন্ধুর ভাবশিষ্য মহানাম সম্প্রদায় প্রধান মহানামব্রত ব্রহ্মচারী সহ অন্য সাধু-সন্ন্যাসীরা হামলার নির্ধারিত দিন ২১ এপ্রিল এর আগেই শ্রী অঙ্গন থেকে সরে গেলেও থেকে যান ৯ সাধু। এ ৯ জনের আট জনই সেদিন আত্মোৎসর্গ করেন।

শ্রীঅঙ্গনের সাধুরা জানান, মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি মিলিটারি ২১ এপ্রিল ভোরে গোয়ালন্দঘাট হয়ে সন্ধ্যায় রাজবাড়ী রাস্তার মোড়ে অবস্থান নেয়। সেখান থেকেই শহরের দিকে গোলাবারুদ নিক্ষেপ করতে থাকে। সন্ধ্যার পরে শহরে ঢুকে প্রথমেই গোয়ালচামট শ্রী অঙ্গনে মহানাম সম্প্রদায়ের আট সাধুকে কীর্তনরত অবস্থায় হত্যা করে। এ সন্ন্যাসীরাই হচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধে ফরিদপুরের প্রথম শহীদ।

শ্রীধাম শ্রীঅঙ্গন আশ্রমের বর্তমান প্রধান মহানাম সম্প্রদায়ের সভাপতি শ্রীমত কান্তি বন্ধু ব্রহ্মচারী জানান, সেদিন পাকিস্তানি মিলেটারি কীর্তনরত সাধুদের বলে ‘বাহার মে আও’। কিন্তু সাধুরা সেদিকে ভ্রক্ষেপ না করে কীর্তন চালিয়ে যান। তখন পাকিস্তানি মিলিটারি প্রথমে মন্দিরে ঢুকে কীর্তনরত সাধুদের বের করে মন্দিরের পাশে চালতা তলায় নিয়ে আসে।

এ সময় পেছন দিক থেকে সাধু হরিপ্রিয় ব্রহ্মচারী পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন। এরপর মাঠে নিয়ে আট সাধুকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। সাধুরা তখন একমনে ‘জয় জগদ্বন্ধু’ জপছিলেন। পাকিস্তানি সেনারা তখন মনে করেছিল তারা ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলছেন। তাই সাধুদের হত্যা করা হয়।

হরিপ্রিয় ব্রহ্মচারী/ ছবি: বার্তা২৪.কম

পরদিন ২২ এপ্রিল ভোরে ফরিদপুর মিউনিসিপ্যালটির ট্রাক এসে লাশগুলো নিয়ে যায়। এদিন পাকিস্তানি সেনারা শ্রী অঙ্গনে বিহারী ও রাজাকারদের দিয়ে লুট চালায়। ২৬ এপ্রিল ডিনামাইট দিয়ে শ্রী অঙ্গনের মূল ভবনের একাংশ ও মন্দিরের চূড়া ধ্বংস করে দেয়।

বেঁচে যাওয়া হরিপ্রিয় ব্রহ্মচারী বলেন, ‘সেদিন সন্ধ্যার আগ মহূর্তে নিত্যদিনের মতো নামকীর্তন করছিলাম আমরা। হঠাৎ হামলা, কামান আর গুলির শব্দ। তারপরও কীর্তন বন্ধ করিনি। তারপর মিলিটারিরা ঢুকলো কীর্তনের আশ্রম ঘরে।’

‘তাদের সঙ্গে কয়েকজন বাঙালি, কয়েকজন বিহারি। আমি ঘরের থামের আড়ালে লুকিয়ে রইলাম। সেখান থেকে পেছনমুখো হয়ে পা টিপে টিপে কয়েক গজ পিছিয়ে লুকিয়ে পড়লাম জঙ্গলের আড়ালে।’

এ সম্পর্কিত আরও খবর