হাওরে বোরো ধানে চিটা, দিশেহারা কৃষক

নেত্রকোনা, দেশের খবর

মো. জিয়াউর রহমান, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, নেত্রকোনা, বার্তা২৪.কম | 2023-08-02 09:17:47

ধানে চিটা ও টানা ঝড়-শিলাবৃষ্টির কারণে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন নেত্রকোনার হাওর পাড়ের কৃষক। উঠতি বোরো ধানের মৌসুমে এমন বিপর্যয়ে কৃষকরা এখন দিশেহারা।

মাত্র কয়েকদিন আগে যে কৃষক সোনার ফসল ঘরে তোলার স্বপ্ন দেখতেন। তারা এখন হতাশায় নিমজ্জিত। মাথায় হাত দিয়ে কাঁদছেন ধান ক্ষেতের আইলে বসেই।

৮ একর জমির ব্রিধান-২৮ মারাই করে মাত্র ৮০ মণ ধান পেয়েছেন জেলার খালিয়াজুরী উপজেলার সরকারহাটি গ্রামের কৃষক কাচু মিয়া। অর্থাৎ একর প্রতি তিনি ফলন পেয়েছেন মাত্র ১০ মণ ধান। অথচ বরাবর তার এ জমিতে কমপক্ষে ৩৬০ মণ থেকে ৪০০ মণ ধান উৎপাদিত হতো।

শুধু কাচু মিয়াই নয়, এই হাওরের হাজার হাজার কৃষকের হয়েছে এমন অবস্থা। এই কৃষকরা সব সময় বৈরী প্রকৃতি ও আগাম বন্যার ঝুঁকিতে থাকেন। পাহাড়ি ঢল ও অতি বৃষ্টিতে প্রায় প্রতি বছর আগাম বন্যায় তলিয়ে যায় কৃষকের সোনালী ফসল।

এখন হাওর পাড়ের কৃষক পরিবারগুলোতে বোরো ধান কাটা মাড়াইয়ের ধুম লাগার কথা ছিল। কিন্তু এবার সেই আমেজ নেই। অনেকের ঘরে শোকের আবহ। ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তার আহাজারি। কোনো কোনো কৃষক ধান কাটছেন ঠিকই কিন্তু ধানের ছড়ায় ধান নেই বেশীর ভাগই চিটা (ফাঁকা ধান)।

এসব দেখে কৃষি বিভাগও রীতিমত কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কৃষি বিভাগের বিশেষজ্ঞরা এ সমস্যাটির নাম দিয়েছেন কোল্ড ইনজুরি।

খালিয়াজুরী কৃষি অফিসের সূত্রমতে উপজেলার ৬টি ইউনিয়নে এবার ১৯ হাজার ৮৭০ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়। এর মধ্যে কৃষি বিভাগের হিসেব অনুযায়ী চিটায় আক্রান্ত হয়েছে ৫ হাজার হেক্টর জমি। তবে বেসরকারি সূত্র ও স্থানীয় কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রকৃত আক্রান্ত জমির সংখ্যা আরও অনেক বেশি।

বিশেষ করে, খালিয়াজুরীর পাংগাসিয়া, কীর্তনখোলা, কটিচাপরা, সেনের বিল, জালর বন, সোনাতোলা, বল্লীর চৌতরা, জগন্নাথপুরের বড় হাওর, বাজজোয়াইল, পাঁচহাট, নগর, বোয়ালী, চাকুয়ার হাওরের হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল চিটায় পরিণত হয়েছে।

জানা যায়, খালিয়াজুরীর সদরের মো. রাজু মিয়া ২০ একর জমিতে বোরো ধানের চাষ করেন। এর মধ্যে চিটা হয়েছে ১১ একর জমিতে। বহিরাগত কৃষক (জিরাতি) মো. হারুন-অর-রশিদ আবাদ করেছেন ৭০ একর। তার আক্রান্ত হয়েছে ৩০ একর। অনল মিয়ার ৫ একরের মধ্যে সম্পূর্ণ জমিতে চিটা হয়েছে।

একইভাবে বল্লী গ্রামের বাবুল মিয়া ১৫ একর জমি চাষ করেন। এর মধ্যে চিটা হয়েছে ১৩ একর। ওই গ্রামের নেহের মিয়া ৭ একর জমি চাষ করে এক মুঠো ধানও পাননি। একইভাবে খালিয়াজুরীর রফিকুল ইসলাম ছোটনের ৬ একরের মধ্যে ৩ একর, জাহের মিয়ার ৩ একরের মধ্যে ২ একর এবং গছিখাই গ্রামের শফিকুলের ১৫ একরের মধ্যে ১০ একর চিটায় আক্রান্ত হয়েছে। হাওরের গ্রামগুলোতে এরকম কৃষকের সংখ্যা আরও বহু।

আক্রান্ত কয়েকটি হাওর ঘুরে দেখা যায়, এসব জমির ধানের ছড়া সোজা হয়ে উপরের দিকে দাঁড়িয়ে আছে। স্বাভাবিক অবস্থায় ধানের ভারে ছড়া নিচের দিকে নুয়ে থাকে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা জানায় বিগত বছরগুলোতে ১ একর (১০ কাঠা) জমিতে কম করে হলেও ৬০ মণ ধান উৎপন্ন হয়েছে। এবার একরে ১০ মণ ধানও হয়নি। এতে করে অনেকের উৎপাদন খরচও উঠবে না।

কেনো হল এমন অবস্থা? এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ শফিকুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, জমির ফ্লাউয়ারিং স্টেজের পর ধানের ছড়ায় দানা গঠন (চাল) হয়। এজন্য নির্দিষ্ট তাপমাত্রার প্রয়োজন পরে। কিন্তু এবার তাপমাত্রা অপেক্ষাকৃত কম থাকায় ধানের মধ্যে ঠিকমত দানা গঠন হয়নি। এর ফলে অনেক জমিতে চিটা (ফাঁকা ধান) হয়। এ সমস্যাটিকে বলা হয় কোল্ড ইনজুরি বা ঠাণ্ডাজনিত কারণ।

কয়েকজন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা জানান, যে সমস্ত কৃষক জমিতে আগাম (ডিসেম্বরের শুরুতে) চারা রোপণ করেছেন তাদের জমি আক্রান্ত হয়েছে বেশি। এর মধ্যে বিশেষ করে ব্রিধান-২৮ ধানের জমিই বেশি আক্রান্ত হয়েছে।

তবে কৃষকরা জানান, অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকা হওয়ায় এবং আগাম পানি চলে যাওয়ায় তাড়াতাড়ি চারা রোপণ করা হয়। অতীতে এমন সমস্যা হয়নি।

এ ব্যাপারে খালিয়াজুরী উপজেলার মেন্দিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান লোকমান হেকিম বলেন, 'সমস্যা যেন কৃষকের পিছু ছাড়ছে না। সাধারণত এনজিও, ব্যাংক ও মহাজনি ঋণ নিয়ে হাওরের কৃষকরা জমি চাষাবাদ করে। কিন্তু এবার ফসল বিপর্যয় হওয়ায় অনেক কৃষকের পক্ষে গরু, বাছুর, বাড়িঘর বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হবে না।'

এ সম্পর্কিত আরও খবর