মায়ের স্বপ্ন বিয়ে দেয়া, তবে মেয়ে শিক্ষক হতে চায়

ময়মনসিংহ, দেশের খবর

রাকিবুল ইসলাম রাকিব, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, গৌরীপুর (ময়মনসিংহ), বার্তা২৪.কম | 2023-08-19 13:22:54

মেয়েটির বয়স ষোলো কি সতেরো। সে একজন বাকপ্রতিবন্ধী। নিজের মনের অনুভূতি মুখের ভাষায় প্রকাশ করতে পারে না। ইশারা-ইঙ্গিতে কথা বোঝানোর চেষ্টা করে। কখনো আবার হাতে লিখে।

তবে বিশেষ গুণ হলো- সে অনেক বিষয় খুব সহজেই আয়ত্ত করতে পারে। অভাব-অনটনের সঙ্গে যুদ্ধ করে প্রতিবন্ধীদের বিশেষ স্কুলে না পড়েও ২০১৮ সালে দাখিল (এসএসসি সমমান) পাশ করেছে। বর্তমানে উপজেলার ইসলামাবাদ সিনিয়র মাদরাসা আলিম শ্রেণিতে প্রথম বর্ষে অধ্যয়ন করছে।

বলছিলাম গৌরীপুর উপজেলার লামাপাড়া গ্রামের মেয়ে সালমা আক্তারের কথা।

সালমা আক্তারের বাড়ি উপজেলার মইলাকান্দা ইউনিয়নের লামাপাড়া গ্রামে। বাবা মৃত আবুল কাশেম। মা মমিনা খাতুন। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে সালমা সবার ছোট। সে ২০১২ সালে লামাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সমাপনী, ২০১৫ সালে লামাপাড়া বালিকা দাখিল মাদরাসা থেকে জেডিসি ও ২০১৮ সালে একই মাদরাসা থেকে দাখিল পাশ করে।

শুক্রবার (২২ মার্চ) দুপুরে মাদরাসা প্রাঙ্গণে বসে সালমা আক্তারের সঙ্গে ইশারা-ইঙ্গিত ও খাতায় লিখে কথা বিনিময় হয় বার্তা২৪.কমের এ প্রতিনিধির। তবে কিছু ক্ষেত্রে কথা ও প্রশ্নের ধরন বুঝতে সমস্যা হওয়ায় উত্তর দিতে গিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ে সালমা। এ সময় তাকে সহযোগিতা করেন মাদরাসার উপাধ্যক্ষ এমদাদুল হক ও তার সহপাঠী শুকতারা।

প্রথমেই পারিবারিক অবস্থা ও পড়াশোনা সম্পর্কিত কিছু প্রশ্ন খাতায় লিখে দেয়া হয় সালমার কাছে। ঝটপট সে উত্তর লিখে দেয়- ‘আমি অভাবের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছি। ভাবতে পারিনি লেখাপড়া করতে পারব। আমার একটা স্বপ্ন আছে। আর সে স্বপ্নটা হলো নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার। ভাইয়া পড়াশোনার খরচ দেয়। শিক্ষকরাও সহযোগিতা করে। বাড়ি থেকে মাদরাসা অনেক দূরে হওয়ায় মা প্রতিদিন আসতে দিতে চায় না। বিয়ের কথা বলে। কিন্তু মাস্টার্স পর্যন্ত পড়াশোনা করতে চাই। প্রতিবন্ধী বলে পিছিয়ে থাকব এটা আমি মানতে পারি না।’



উপাধ্যক্ষ এমদাদুল হক জানান, ছোটবেলায় গ্রামের ছেলে-মেয়েরা যখন বই-খাতা নিয়ে বিদ্যালয়ে যেত, তখন সালমাও তাদের সঙ্গে গিয়ে বিদ্যালয়ে বসে থাকত। এই আগ্রহ দেখে তার ভাই সাইদুল তাকে ভর্তি করে দেয়। এরপর ভাই তাকে বাড়িতে বসে পড়াশোনা করাত। মুখে পড়তে না পারলেও চোখ বুলিয়ে বিশেষ কায়দায় পাঠ্যবইয়ের পড়া আয়ত্ত করে নেয় সালমা। তার হাতের লেখা সুন্দর, ছবিও আঁকতে পারে। অভাবের সংসারে নিজের পড়াশোনার খরচ জোগাতে সম্প্রতি সালমা সেলাই কাজ শিখেছে। কিন্তু টাকার অভাবে সেলাই মেশিন কিনতে পারছে না।

খাতায় লিখে পরিবারের মোবাইল নাম্বার চাইলে নিজের মায়ের নাম্বারটি লিখে দেয় সালমা। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে সালমার মা মমিনা খাতুন বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘সালমা জন্ম থেইক্যা বোবা (বাকপ্রতিবন্ধী)। চিকিৎসা করানির পর ডাক্তার কইছিন ওর একটা কান ভালা আছে। চিকিৎসা করাইলে ভালা অইবো। তয় টেকার অভাবে চিকিৎসা করাইতে পারি নাই।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাড়ি থেইক্যা সালমার মাদরাসা ৬ মাইল দূরে। অহন বোবা মাইয়্যারে একলা ছাড়তে ডর লাগে। আর অভাবের সংসারে ওরে (সালমা) লেহাপড়া করাইয়্যা কী লাভ? ও কি কিছু অইতে পারবো? ভালা একটা জায়গায় বিয়া দিতারলে সুখে থাকবো। এইডাই অহন আমার স্বপ্ন।’

মায়ের কথার রেশ টেনে ‘বড় হয়ে কী হতে চাও’ খাতায় লিখে প্রশ্ন করা হয় সালমাকে। উত্তর না লিখে মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকে সালমা। এরপর মাদরাসা প্রাঙ্গণ থেকে সোজা চলে যায় শ্রেণিকক্ষে। মার্কার পেন দিয়ে ব্ল্যাক বোর্ডে লিখে দেয়- ‘আমি সালমা আক্তার। বাকপ্রতিবন্ধী। বড় হয়ে শিক্ষক হতে চাই।’

এ সম্পর্কিত আরও খবর