বেনাপোল বন্দরে চলছে শুল্ক ফাঁকির মহোৎসব!

যশোর, দেশের খবর

আজিজুল হক, স্টাফ করসেপন্ডেন্ট, বেনাপোল (যশোর), বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 04:43:32

দেশের বৃহত্তম বেনাপোল স্থলবন্দরে বিভিন্ন সংস্থার নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যেওে চলছে অবৈধভাবে পণ্য আমদানি করে শুল্ক ফাঁকির মহোৎসব। অপরাধীদের বিরুদ্ধে বিচার ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় কোনোভাবেই থামছে না এসব কার্যক্রম।

সাধারণ ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এসব অবৈধ আমদানির সাথে কেবল আমদানিকারক ও  সিঅ্যান্ডএফ নয়, কাস্টমস এবং বন্দরের কর্মকর্তারাও জড়িত থাকে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলেও অনিয়মে মূল সহযোগিতাকারী কাস্টমস ও বন্দরের সংশিষ্টরা থাকে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

অর কাস্টমস কর্মকর্তারা বলছেন, সংঘবদ্ধ পাচারকারীরা এসব কর্মকাণ্ডের চেষ্টা  চালালেও শুল্ক ফাঁকি রোধে কাস্টমস ইতোমধ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। আন্তরিক হয়ে কাজ করছেন তাদের সদস্যরা। অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্টতা পেলে কারও ছাড় নেই।

এদিকে বুধবার (২০ মার্চ) বিকেল ৫টায় বৈধ পথে চোরাচালানের মাধ্যমে আমদানির অভিযোগে প্রায় ২০ লাখ টাকা মূল্যের জিলেট সেভিং ফোমের একটি চালান আটক করেছে কাস্টমস সদস্যরা। তবে এ সময় ভারতীয় ট্রাক জব্দ করা হলেও কাউকে আটক করা যায়নি।

অভিযোগ উঠেছে, এর অবৈধ আমদানিকারক সনাক্ত হলেও অনেকে ফাঁসতে পারেন, তাই কেউ কেউ বিষয়টি আড়াল করার চেষ্টা করছেন।

এ বিষয়ে বেনাপোল কাস্টমসের সহকারী কমিশনার আকরাম হোসেন বার্তা২৪.কমকে জানান, গোপন সংবাদ পাওয়ায় পণ্য চালান নিয়ে ভারতীয় একটি ট্রাক বেনাপোল স্থলবন্দরের বাংলাদেশে প্রবেশের সাথে সাথে নজরে রাখে কাস্টমসের ইনভেসটিগেশন রিসার্চ অ্যান্ড ম্যানজেমন্টের সদস্যরা। এক পর্যায়ে ট্রাকটি বন্দরের ৯নম্বর পণ্যাগারে কিছু পণ্য খালাস করে দাঁড়িয়ে থাকে। এ সময় ট্রাকে থাকা অবশিষ্ট পণ্য অবধৈভাবে এসেছে নিশ্চিত হয়ে ট্রাকটি আটক করা হয়। পরে ওই ট্রাকের ভেতর থেকে ৬৫১টি কাটনে ৭ হাজার ৮১২টি জিলেট সেভিং ফোমের বোতল পাওয়া যায়। যার বাজার মূল্য প্রায় ২০ লাখ টাকা। আটককৃত পণ্যের প্রতিটি কাটনে (প্রক্টার অ্যান্ড গ্যামবল বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেড) লেখা ছিল। তবে আমদানিকারকের মনোনীত সিঅ্যান্ডএফ পণ্য চালানটি তাদের নয় বলে জানিয়েছে।

এ বন্দরের একজন সাধারণ আমদানিকারক ইদ্রিস আলী বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘অবৈধ আমদানিকারকদের বিরুদ্ধে বেশিরভাগ সময় কেবল জরিমানা করে ছেড়ে দেওয়া হয়।  তাদের কারণে আমরা ছোট ব্যবসায়ীরা ভালভাবে ব্যবসা করতে পারি না। আর কাস্টমস ও বন্দরের সহযোগিতা ছাড়া শুল্ক ফাঁকি হয় না। কিন্তু তারা তো থাকে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।  অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা কঠিন হলে তবেই অবৈধ আমদানি রোধ হবে।’

বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মফিজুর রহমান সজন বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘কিছু মানুষের কারণে এ বন্দরের বদনাম হবে এটা মেনে নেওয়া যায় না। অভিযুক্তদের সনাক্ত করা দরকার। এ ক্ষেত্রে আমরা কাস্টমসকে সব ধরনের সহযোগিতা করব।’

বেনাপোল কাস্টমস কমিশনার বেলাল হোসেন চৌধুরী  বলেন, ‘একটি সংঘ বদ্ধ চক্র এ চোরাচালানের সাথে জড়িত। তারা বিভিন্নভাবে শুল্কফাঁকির অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তবে কাস্টমস কর্মকর্তারা সজাগ থাকায় গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকটি চালান আটক করা হয়েছে। এসব বিষয়ে তদন্ত চলছে।  অভিযুক্ত যেই হোক না কেন তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

জানা যায়, দেশে ২৩টি স্থলবন্দরের মধ্যে চলমান ১৩টির অন্যতম বেনাপোল স্থলবন্দর। ১৯৭২ সাল থেকে এ পথে ভারতের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক লেনদেন চলছে। প্রতিবছর এ বন্দর দিয়ে ভারত থেকে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার পণ্য আমদানি হয়ে থাকে। যা থেকে সরকার প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় পেয়ে থাকে।

যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজের কারণে প্রথম থেকে এ পথে বাণিজ্যে আগ্রহ বেশি দেখা যায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে। বন্দরে আমদানি-রফতানি পণ্যের নিরাপত্তায় তিনটি সংস্থ্যা আনসার, প্রেমা ও আর্মস ব্যাটালিয়ন পুলিশ মিলে প্রায় তিন শতাধিক নিরাপত্তাকর্মী রয়েছে।

২০১২-১৩ অর্থবছরের বেনাপোল বন্দরে আমদানি পণ্য থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কাস্টমসকে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয় দুই হাজার ৬২০ কোটি টাকা। বছর শেষে ঘাটতি হয়েছে ৪৫২ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল দুই হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। বছর শেষে ঘাটতি ছিল ১৯৪ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ৪ হাজার ১৯৫ কোটি ৮৮ লাখ টাকার বিপরীতে আদায় হয়েছিল ৪ হাজার ১৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এতেও ঘাটতি ছিল ১৭৯ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।

চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা । প্রথম ৬ মাসে লক্ষ্য মাত্রা ছিল ২ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে  আদায় হয়েছে মাত্র ২ হাজার ৪৪ কোটি ৮৪ লাখ  টাকা। ঘাটিত রয়েছে ৬০৪ কোটি ১৬ লাখ টাকা।

বন্দরের অব্যবস্থাপনায় আমদানি কমে যাওয়া আর মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে শুল্ক ফাঁকির কারণে  এ বছর নির্ধারিত পরিমাণে রাজস্ব আদায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বলে জানা যায়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর