শিক্ষকতায় ফিরতে চান সেদিন বেঁচে যাওয়া হাসি

টাঙ্গাইল, দেশের খবর

অভিজিৎ ঘোষ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, টাঙ্গাইল | 2023-09-01 11:02:52

আঘাতের চিহ্ন নিয়ে বেঁচে আছেন টাঙ্গাইলের পৌর এলাকার ২নং ওয়ার্ডের এনায়েতপুর দক্ষিণ পাড়ায় সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তা হুমায়ূন কবিরের মেয়ে ইমরানা কবির হাসি। তিনি রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

২০১৮ সালের ১২ মার্চ ইমরানা কবির হাসি ও তার স্বামী মো. রকিবুল হাসান নেপালে ঘুরতে যাওয়ার সময় ইউএস বাংলার একটি ফ্লাইটে দুর্ঘটনার শিকার হন। সে সময় সেখানেই তার স্বামী রকিবুলের মৃত্যু হয়। বেঁচে যান তিনি। কিন্তু হাসি বেঁচে থেকেও যেন সেই বিভীষিকা স্মৃতি আজও ভুলতে পারছেন না।

তবে তিনি জানিয়েছেন, যতদিন বেঁচে থাকবেন এই দুঃসহ স্মৃতি নিয়েই বেঁচে থাকবেন। দীর্ঘ ১১ মাস পর শুধু বাবা-মায়ের সাথে দেখা করতে গত ৮ ফেব্রুয়ারি বাসায় আসেন তিনি। আরও কয়েকটি অপারেশন বাকি আছে তার। এখনো চিকিৎসাধীন আছেন ইউএস বাংলার তত্ত্বাবধানে।

তার বাবা হুমায়ন কবির জানান, গত বছরের ১২ মার্চ তার মেয়ে ও মেয়ের জামাই সাত দিনের ভ্রমণে ঢাকা বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর ইউএস বাংলা বিমান যোগে নেপালের উদ্দেশে রওনা হয়। তাদের বিমানবন্দর পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার পর তিনি বাড়ি চলে আসেন। ট্রেনে আসার সময় হাসির মামাতো ভাই তাকে ফোন করে জানতে চায় হাসি ও তার স্বামী নেপালের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে কিনা। হুমায়ন কবির রওনা হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করলে ওই মামাতো ভাই জানান তাদের বিমানটি দুর্ঘটনার স্বীকার হয়েছে। টেলিভিশনে খবরে হাসিকে দেখার পর তিনি অজ্ঞান হয়ে যান।

তিনি আরও জানান, দুর্ঘটনার স্বীকার যাত্রীদের আত্মীয়-স্বজনদের নেপালে নেওয়া হবে এমন সংবাদ পাওয়ার পর ওইদিন রাত ১২টায় তিনি ইউএস বাংলার অফিসে গিয়ে পৌঁছান। তার পাসপোর্ট না থাকায় হাসির বান্ধবীর স্বামীকে নেপাল পাঠান। নেপাল থেকে হাসিকে সিঙ্গাপুর নেওয়া হবে এমন খবর পাওয়ার পর হুমায়ন কবির দ্রুত সময়ের মধ্যে পাসপোর্ট করে ১৫ মার্চ নেপাল গিয়ে পৌঁছান। সমস্ত শরীরে ব্যান্ডেজ থাকায় নিজের মেয়েকে চিনতে পারছিলেন না। কম্পিউটারে মুখ দেখে তিনি নিশ্চিত হন।

হুমায়ন কবির জানান, ১৬ মার্চ ইউএস বাংলার কর্মকর্তা ও বাংলাদেশের মেডিকেল টিম বৈঠক করে হাসিকে সিঙ্গাপুরে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেন। ১৭ মার্চ রাত ১২টার ফ্লাইটে তিনি ও তার মেয়ে হাসিকে সিঙ্গাপুর নেওয়া হয়। পরদিন সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে হাসিকে ভর্তি করা হয়। সেখানে নয় দিন চিকিৎসা নেওয়ার পর হাসি সুস্থ হন।

হাসির এক জায়গার চামড়া কেটে আরেক জায়গায় লাগানো হয়েছে। সে ব্যাথায় অনেক কান্না করেছে। এতো কষ্টের পরও হাসি বেঁচে থাকায় আল্লাহ তালার কাছে শুকরিয়া কামনা করি।

প্লেন দুর্ঘটনা নিয়ে ইমরানা কবির হাসি বার্তা২৪.কমকে জানান, ১২ মার্চ সবকিছু স্বাভাবিক থাকায় দুপুরের দিকে তাদের বহনকৃত প্লেনটি ফ্লাই করে। ঘণ্টাখানেক যাওয়ার পরই একটি পাহাড় দেখে হাসি বুঝতে পারেন তারা নেপাল পৌঁছে গেছেন। বিমানটি ল্যান্ড করবে এমন ভেবে হাসি ও তার স্বামী কথা বলছিলেনি এবং ছবি তুলছিলেন। কিছুক্ষণ পর অস্বাভাবিক ঝাঁকুনি লেগে বিমানটি মাটিতে পড়ে যায়। হাসি বুঝতে পারেনি প্লেনটি দুর্ঘটনা কবলিত। ততক্ষণে তার স্বামী উল্টে সিটের তলায় গিয়ে পড়েন। স্বামীকে একাধিকবার ডাকার পরও কোনো সাড়া শব্দ পাচ্ছিলেন না। প্লেনটি দুই ভাগ হয়ে গিয়েছিল। অনেকেই বের হচ্ছে। কিন্তু বাম হাত দিয়ে সিট বেল খোলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন হাসি। হাসি ভেবেছিলেন প্লেন দুর্ঘটনায় কেউ বাঁচে না, হয়তো তিনিও বাঁচবেন না। মারা যাবেন ভেবে কালেমা পড়ছিলেন। তার সামনেও এক নারী কালেমা পড়ছিলেন। প্লেনের পেছন দিক থেকে ভয়াবহ আগুন আসা শুরু করেছে। প্লেনে যারা ছিলেন তারাও আগুনে পুড়তে লাগল। ততক্ষণে হাসির পিঠে, মাথায়, চুলে এবং হাতেও আগুন ধরে যায়। আগুনে পুড়তে থাকায় নিরুপায় হয়ে তার স্বামীকে ডাকতে লাগলেন। কিন্তু তখনও কথা বলছিলো না স্বামী মো. রকিবুল হাসান। প্রচণ্ড আগুন ও অধিক পরিমাণে ধোয়া থাকায় মুখে ওড়না নিয়ে নিশ্বাস নিচ্ছিলেন হাসি। তখন তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কেউ একজন তার পাশে আছে।

তিনি আরও জানান, সেভ মি, সেভ মি বলে ডাকার পর ফায়ার সার্ভিস অথবা সেনাবাহিনীর কেউ একজন এসে হাসিকে উদ্ধার করেন। সামনে থাকা মহিলা ও তার স্বামী এবং তাকে সেভ করতে বলেন। তার হাত ভাঙা থাকায় খুব যত্মে তাকে অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হয়। তিনি মারা যাবেন এমনটাই ভাবছিলেন। খাবারের পানি চাচ্ছিলেন। তার পর কী হয়েছিল হাসি আর কিছুই বলতে পারেননি। নয় দিন পর তার জ্ঞান ফেরার পর স্বামীর কথা জানতে চাইলে নেপালে আছেন বলে জানান তার বাবা। আড়াই মাস চিকিৎসা নেওয়ার পর দেশে ও ১১ মাস পর বাড়িতে ফিরেছেন তিনি। এখনো আরও কিছু চিকিৎসা বাকি আছে তার।

হাসি বলেন, ‘আল্লাহ পাক চেয়েছেন বলে আমি বেঁচে আছি। আইসিইউতে চিকিৎসা নেওয়া অবস্থায়ও আমার চোখে আগুন ভাসতো। শারীরিক ট্রিটমেন্ট সবাই করতে পারে, কিন্তু মানসিক ট্রিটমেন্ট কেউ করতে পারে না। পুরোপুরি সুস্থ হয়ে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে পুনরায় দায়িত্ব পালন করতে চাই। সেখানে সহকর্মী ও শিক্ষার্থীদের সাথে থেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে থেকে সুস্থ থাকতে চাই।’

এ সম্পর্কিত আরও খবর